দীপা বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। তারপর তাড়াতাড়ি দেবাশিসের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হল।
প্রবালের মনের অবস্থাটা ভেবে দেখ। অন্য কারুর সঙ্গে দীপার বিয়ে হলে সে বোধহয় এমন ক্ষেপে উঠত না। কিন্তু দেবাশিস! হিংসেয় রাগে তার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে লাগল।
বিয়ের সম্বন্ধ যখন স্থির হয়ে গেল তখন সে ঠিক করল দেবাশিসকে খুন করে তার বিধবাকে বিয়ে করবে। দীপা তখন স্বাধীন হবে, বাপের বাড়িয় শাসন আর থাকবে না। দীপাকে বিয়ে করলে দেবাশিসের সম্পত্তি তার হাতে থাকবে। একসঙ্গে রাজকন্যে এবং রাজত্ব। দেবাশিসের আর কেউ নেই প্রবাল তা জানত।
কিন্তু প্রথমেই দেবাশিসকে খুন করা চলবে না। তাহলে সে যখন দীপাকে বিয়ে করবে তখন সকলের সন্দেহ তার ওপর পড়বে। ক্রূর এবং নৃশংস প্রকৃতির প্রবাল এমন এক ফন্দি বার করল যে, কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। শজারুর কাঁটার নাটকীয় খেলা আরম্ভ হল। তিনটি মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিল।
যাহোক, প্রবাল দেবাশিসকে মারবার সুযোগ খুঁজছে। আমার বিশ্বাস সে সর্বদাই একটা শজারুর কাঁটা পকেটে নিয়ে বেড়াত; কখন সুযোগ এসে যায় বলা যায় না। একদিন হঠাৎ সুযোগ এসে গেল।
নৃপতির আড্ডাঘরের পাশের ঘরে টেলিফোন আছে। দোরের পাশে পিয়ানো, প্রবাল সেখানে বসে ছিল; শুনতে পেল খড়্গ বাহাদুর দেবাশিসকে টেলিফোন করছে, জানতে পারল ওরা রবীন্দ্র সরোবরের এক জায়গায় দেখা করবে। প্রবাল দেখল এই সুযোগ। শজারুর কাঁটা তার পকেটেই ছিল, সে যথাস্থানে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। তারপর–
প্রবাল জানত না যে প্রকৃতির দুর্জেয় খামখেয়ালির ফলে দেবাশিসের হৃৎপিণ্ডটা বুকের ডান পাশে আছে। দীপা অবশ্য জানত। কিন্তু প্রবাল যে দেবাশিসকে খুন করে তাকে হস্তগত করার মতলব করেছে তা সে বুঝতে পারেনি। হাজার হোক মেয়েমানুষের বুদ্ধি; বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘কখনো অর্ধেক বৈ পুরা দেখিলাম না।’
এই হল গল্প। আর কিছু জানবার আছে?’
অজিত প্রশ্ন করল–’তোমাকে মারতে গিয়েছিল কেন?’
ব্যোমকেশ বলল–’আমি সেদিন ওদের আড়ায় গিয়ে বলে এসেছিলাম যে শজারুর কাঁটা দিয়ে যদি আর খুন না হয়, তাহলে বুঝতে হবে দেবাশিসই আততায়ীর প্রধান লক্ষ্য। তাই প্রবাল ঠিক করল আমাকে খুন করেই প্রমাণ করবে যে, দেবাশিস আততায়ীর প্রধান লক্ষ্য নয়; সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। আমি যে তাকে ধরবার জন্যেই ফাঁদ পেতেছিলাম তা সে বুঝতে পারেনি।’
সত্যবতী গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল–’বাব্বা! কী রাক্কুসে মানুষ! দীপার কিন্তু কোনো দোষ নেই। একটা সহজ স্বাভাবিক মেয়েকে খাঁচার পাখির মত বন্ধ করে রাখলে সে উড়ে পালাবার চেষ্টা করবে না?’
খুটি খুঁট করে সদর দরজায় টোকা পড়ল। ব্যোমকেশ উঠে গিয়ে দোর খুলল–’আরে দেবাশিসবাবু যে! আসুন আসুন।’
দেবাশিস সঙ্কুচিতভাবে ঘরে প্রবেশ করল। সত্যবতী উঠে দাঁড়িয়েছিল, দেবাশিসের নাম শুনে পরম আগ্রহে তার পানে চাইল। দেবাশিসের চেহারা আবার আগের মত হয়েছে, দেখলে মনে হয় না সে সম্প্রতি যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। সে হাত জোড় করে বলল–’আজ রাত্রে আমার বাড়িতে সামান্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছি, আপনাদের সকলকে যেতে হবে।’
ব্যোমকেশ বলল—’বেশ, বেশ। বসুন। তা উপলক্ষটা কী?
দেবাশিস রুদ্ধ কণ্ঠে বলল–’ব্যোমকেশদা, আজ আমাদের সত্যিকার ফুলশয্যা। দীপাকে আমার সঙ্গে আনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে লজ্জায় আধমরা হয়ে আছে, এল না। বউদি, আপনি নিশ্চয় আসবেন, নইলে দীপার লজ্জা ভাঙবে না।’
(সমাপ্ত)