দীপা ওপর এসে আবার আরাম-কেন্দারায় এলিয়ে পড়ল। তার মনের মধ্যে দশদিক তোলপাড় করে ঝড় বইছে, সারা গায়ে অসহ্য ছট্ফটানি। অভ্যাসবিশেই সে হাত বাড়িয়ে রেডিওগ্রাম চালিয়ে দিল; কোনো একটি মহিলা ইনিয়ে-বিনিয়ে আধুনিক গান গাইছেন। কিছুক্ষণ শোনার পর সে রেডিও বন্ধ করে দিয়ে চোখ বুজে। চুপ করে রইল। কিন্তু বুকের মধ্যে ঝড়ের আফসানি কমল না। তখন সে উঠে অশান্তভাবে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল, অস্ফুট স্বরে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল–’এভাবে আর কত দিন চলবে?’
দীপা যদি হালকা চরিত্রের মেয়ে হত, তাহলে তার জীবনে বোধ হয় কোনো ঝড়-ঝাপটাই আসত না।
দীপা বনেদী বংশের মেয়ে। একসময় খুব বোলবোলাও ছিল, তালুক-মুলুক ছিল, এখন অনেক কমে গেছে; তবু মরা হাতি লাখ টাকা। বোলবোলাও কমলেও বংশের মর্যাদাবোধ আর গোঁড়ামি তিলমাত্র কমেনি। দীপার ঠাকুরদা উদয়মাধব মুখুজে এখনো বেঁচে আছেন, তিনিই সংসারের কতা। এক সময় একটি বিখ্যাত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, হঠাৎ পঙ্গু হয়ে পড়ার ফলে অবসর নিতে হয়েছে। বাড়িতেই থাকেন এবং নিজের শয়নকক্ষ থেকে প্রচণ্ড দাপটে বাড়ি শাসন করেন।
ঠাকুরদা ছাড়া বাড়িতে আছেন দীপার বাবা-মা এবং দাদা। বাবা নীলমাধব বয়স্ক লোক, কলেজে অধ্যাপনা করেন। মা গোবেচারি ভালমানুষ, কারুর কথায় থাকেন না, নীরবে সংসারের কাজ করে যান। দাদা বিজয়মাধব দীপার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড়, সে সংস্কৃত ভাষায় এম-এ পাস করে কলেজে অধ্যাপনার কাজে ঢোকবার চেষ্টা করছে। দীপার বাবা এবং দাদা দু’জনেই তেজস্বী পুরুষ। কিন্তু তাঁরা বাড়িতে উদয়মাধবের হুকুম বেদবাক্য মনে করেন এবং বাইরে বংশ-গৌরবের ধ্বজ তুলে বেড়ান। বংশটা একাধারে সম্রােন্ত, উচ্চশিক্ষিত এবং প্রাচীনপন্থী।
এই বংশের একমাত্র মেয়ে দীপা। তাকে মেয়ে-স্কুল থেকে সীনিয়র কেমব্রিজ পাস করানো হয়েছিল। তারপর তার পড়াশুনো বন্ধ হল; তার জন্যে পালটি ঘরের ভাল পাত্র খোঁজা আরম্ভ হল। কাল ধর্মে তাকে পদার মধ্যে আবদ্ধ রাখা গেল না বটে, কিন্তু একলা বাইরে যাবার হুকুম নেই। বাইরে যেতে হলে বাপ কিংবা ভাই সঙ্গে থাকবে।
দীপা বাড়িতেই থাকে, গৃহকর্মে রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করে; অবসর সময়ে গল্প উপন্যাস পড়ে, রেডিওতে গান শোনে। কিন্তু মন তার বিদ্রোহে ভরা। তার মনের একটা স্বাধীন সত্তা আছে, নিজস্ব মতামত আছে; সে মুখ বুজে বাড়ির শাসন সহ্য করে বটে, কিন্তু তার মনে সুখ নেই। মেয়ে হয়ে বাংলা দেশে জন্মেছে বলে কি তার কোনো স্বাধীনতা নেই! অন্য দেশের মেয়েদের তো আছে।
ঠাকুরদা উদীয়মাধব, পঙ্গুতার জন্যেই বোধ হয়, বাড়িতে বন্ধুসমাগম পছন্দ করতেন, লোকজনকে খাওয়াতে ভালবাসতেন। একটা কোনো উপলক্ষ পেলেই নিজের প্রবীণ বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করতেন; নীলমাধব এবং বিজয়মাধবের বন্ধুরাও নিমন্ত্রিত হতেন। বৃদ্ধের তিনতলায় সমবেত হতেন, প্রৌঢ় অধ্যাপকেরা বসতেন দোতলায় এবং একতলায় বৈঠকখানায় বসে ছেলে-ছোকরার দল গানবাজনা হইহুল্লোড় করত। মাসে দু’মাসে এইরকম অনুষ্ঠান লেগেই থাকত।
দীপা অতিথিদের সকলের সামনে বেরুত, কোনো বারণ ছিল না। ঠাকুরদার বন্ধুরা নাতনী সম্পর্কে তার সঙ্গে সেকেলে রসিকতা করতেন, বাপের বন্ধুরা তাকে স্নেহ করতেন, আর দাদার বন্ধুরা তাকে নিজেদের সমান মর্যাদা দিত, মেয়ে বলে অবহেলা করত না। সে প্রয়োজন হলে তাদের সঙ্গে দু’টি-চারটি কথাও বলত। তাদের মধ্যে যখন গানবাজনা হত তখন সে দোরের কাছে দাঁড়িয়ে শুনত। এইসব ক্রিয়াকর্মে তার মন ভারি উৎফুল্ল হয়ে উঠত, যদিও বাইরে তার বিকাশ খুব অল্পই চোখে পড়ত। দীপা ভারি চাপা প্রকৃতির মেয়ে।
এইভাবে চলছিল, তারপর একদিন দীপার মানসলোকে একটি ব্যাপার ঘটল, নবযৌবনের স্বভাবধর্মে সে প্রেমে পড়ল। যার সঙ্গে প্রেমে পড়ল সেও তার অনুরাগী। কিন্তু মাঝখানে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা, প্রেমিকের জাত আলাদা।
দুপুরবেলা যখন বাড়ি নিষুতি হয়ে যায়। তখন দীপা নীচের বসবার ঘরে দোর ভেজিয়ে দিয়ে টেলিফোনের সামনে বসে, চোখে প্রতীক্ষ্ণ নিয়ে বসে থাকে। টেলিফোন বাজিলেই সে যন্ত্র তুলে নেয়। সাবধানে দু’টি-চারটি কথা হয়, তারপর সে টেলিফোন রেখে দেয়। কেউ জানতে পারে না।
সন্ধ্যেবেলা দীপা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে; সামনের ফুটপাথ দিয়ে তার প্রেমিক চলে যায়, তার পানে চাইতে চাইতে যায়। এইভাবে তাদের দেখা হয়। কিন্তু কাছে এসে দেখা করার সুযোগ নেই, সকলে জানতে পারবে।
এদিকে দীপার জন্যে পাত্রের সন্ধান শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু পালটি ঘর যদি পাওয়া যায় তো পাত্র পছন্দ হয় না, পাত্র যদি পছন্দ হয় তো ঠিকুজি কোষ্ঠীর মিল হয় না। বিয়ের কথা মোটেই এগুচ্ছে না।
পৌষ মাসের শেষের দিকে একদিন দুপুরবেলা দীপা টেলিফোনে তার প্রেমিকের সঙ্গে চুপি চুপি পরামর্শ করল, তারপর কোমরে। আচল জড়িয়ে তেতলায় ঠাকুরদার সঙ্গে দেখা করতে গেল।
দীপা সাহসিনী মেয়ে, কিন্তু তার সাহসের সঙ্গে খানিকটা একওঁয়েমি মেশানো আছে। ঠাকুরদার সঙ্গে তার সম্বন্ধ বড় বিচিত্র; সে ঠাকুরদাকে যত ভালবাসে, বাড়িতে আর কাউকে এত ভালবাসে না। কিন্তু সেই সঙ্গে সে ঠাকুরদাকে ভয়ও করে। তিনি তার কোনো কাজে অসন্তুষ্ট হবেন। এ কথা ভাবতেই সে ভয়ে কাটা হয়ে যায়। তাই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে তার উরু আর হটু অল্প কাঁপতে লাগল।
উদয়মাধব মুখুজে একদিন বুড়ো বয়সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান, তাঁর মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লাগে। এই আঘাতের ফলে তাঁর নিম্নাঙ্গ পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যায়, চলে ফিরে বেড়াবার ক্ষমতা আর থাকে না। এ ছাড়া তাঁর স্বাস্থ্য বেশ ভালই। দোহারা গড়নের শরীর, মুখের চওড়া চোয়ালে প্রবল ব্যক্তিত্বের ছাপ। সত্তর বছর বয়সেও মানসিক শক্তি বিন্দুমাত্র কমেনি। যে দাপট নিয়ে তিনি কলেজের অধ্যক্ষতা করতেন। সেই দাপট পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান আছে। তাঁর চিরদিনের অভ্যাস হুঙ্কার দিয়ে কথা বলা। এখনো তিনি হুঙ্কার দিয়েই কথা বলেন।