শজারুর কাঁটা

বাড়ির মধ্যে সকলের চেয়ে বিজয়ের দুশ্চিন্তা বেশি। তার স্বভাব একটু তীব্র গোছের। তার বোন কোনো অজানা লোকের সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল এ লিজা যেন তারই সবচেয়ে মমন্তিক। সে উঠে পড়ে লেগে গেল পাত্র খুঁজতে।

পাড়ার নৃপতি লাহার বাড়িতে কয়েকটি যুবকের আড়া বসত‌, আগে বলা হয়েছে। বিজয় এই আড্ডায় আসত‌, এখানে অন্য যারা আসত তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল‌, নৃপতি লাহার সঙ্গে বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল।

নৃপতি লাহারা সাত পুরুষে বড়মানুষ‌, কিন্তু বর্তমানে সে ছাড়া বংশে আর কেউ নেই। তার বয়স এখন আন্দাজ পঁয়ত্ৰিশ বছর‌, নিঃসন্তান অবস্থায় বিপত্নীক হবার পর আর বিয়ে করেনি। সে উচ্চশিক্ষিত‌, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী‌, সারা দিন লেখাপড়া নিয়ে থাকে‌, সন্ধ্যের পর আড্ডা জমায়।

বিজয়ামাধব একদিন বিকেলবেলা নৃপতির কাছে এল। তখনো আডা জমার সময় হয়নি‌, নৃপতি বাড়ির নীচের তলার বৈঠকখানায় বসে একখানা বই পড়ছিল। এই ঘরটিতেই রোজ আড্ডা বসে।

ঘরটি প্রকাণ্ড‌, সভাঘরের মত। সাবেক কালে এই ঘরে বাবুদের নাচগানের মুজরো বসন্ত‌, একালে ঘরটি সোফা চেয়ার প্রভৃতি দিয়ে সাজিয়ে ড্রয়িংরুমে পরিণত করা হয়েছে বটে‌, কিন্তু সেকালের গদিন-মোড়া তক্তপোশ এখনো আসর জাঁকিয়ে বসে আছে। তা ছাড়া টেবিল-হারমোনিয়াম আছে‌, পিয়ানো আছে‌, রেডিওগ্ৰাম আছে। আর আছে তাস পাশা ক্যারাম প্রভৃতি খেলার সরঞ্জাম।

বিজয় ঘরে ঢুকে দেখল নৃপতি একলা আছে‌, বলল–’নৃপতিদা‌, তোমার সঙ্গে আড়ালে একটা পরামর্শ আছে‌, তাই আগেভাগে এলাম।’

নৃপতি বই মুড়ে বিজয়কে একটু ভাল করে দেখল‌, তারপর সোফায় নিজের পাশে হাত চাপড়ে বলল—‘এস‌, বসো।’

বিজয় তার পাশে বসে কথা বলতে ইতস্তত করছে দেখে নৃপতি বলল—’কিসের পরামর্শ?’

বিজয় তখন বলল–’নৃপতিদা‌, দীপার জন্যে পাত্র খোঁজ হচ্ছে কিন্তু মনের মত পাত্র কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি তো অনেক খবর রাখো। একটা ভাল পাত্রের সন্ধান দাও না।’

নৃপতি হাত বাড়িয়ে নিকটস্থ টেবিল থেকে সিগারেটের টিন নিল‌, একটি সিগারেট ঠোঁটে ধরে বলল-ই। দীপার এখন বয়স কত?

‘সতেরো। আমাদের বংশে—‘

নৃপতি দেশলাই জ্বালাবার উপক্রম করে বলল–’তোমাদের বংশের কথা জানি। গৌরীদান করতে পারলেই ভাল হয়। তা কি রকম পাত্র চাও? বিদ্বান হবে‌, পয়সাকড়ি থাকবে‌, চেহারা ভালো হবে‌, এই তো?’

বিজয় বলল—’হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আসল কথাটাই বললে না। পালটি ঘর হওয়া চাই।’

সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নৃপতির ঠোঁটের কোণে একটু ব্যঙ্গহাসি খেলে গেল। সে বলল–’তাও তো বটে। বংশের ধারা বজায় রাখতে হবে বইকি। তা তোমরা হলে গিয়ে মুখুজ্জে‌, সুতরাং চাটুজ্জে বাড়ুজ্জে গাঙ্গুলি কিংবা ঘোষাল চাই। বারেন্দ্র চলবে না?

‘না‌, নৃপতিদা‌, জানোই তো আমরা আজ পর্যন্ত সাবেক চাল বজায় রেখে চলেছি।’

‘জানি বইকি! তোমরা হচ্ছে আরশোলা গোষ্ঠীর জীব।’

‘আরশোলা গোষ্ঠীর জীব মানে?’

‘আরশোলা অতি প্ৰাচীন জীব‌, কোটি কোটি বছর আগে জন্মেছিল; তারপর জীবজগতে অনেক ব্বির্তন ঘটেছে‌, কিন্তু আরশোলা আরশোলাই রয়ে গেছে। তাই আজকাল আর তাদের বেশি কদর নেই।’

‘সে যাই বল‌, বণাশ্রম ধর্ম আমি মেনে চলি। গীতায় শ্ৰীভগবান বলেছেন‌, চাতুর্বর্ণ্যং—’ নৃ

পতি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল; সিগারেট টানতে টানতে সে বোধ করি মনে মনে উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করছিল। সিগারেট শেষ করে সে বলল—’একটি ছেলে আছে‌, কিন্তু তোমাদের পালটি ঘর কিনা খোঁজ নিতে হবে। তুমি আজ বাড়ি যাও‌, কাল খবর পাবে।’

‘আচ্ছা‌, বলে বিজয় চলে গেল। নৃপতি কব্জির ঘড়িতে দেখল পাঁচটা বেজেছে। সিগারেটের টিন পকেটে নিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তার গন্তব্যস্থল বেশি দূর নয়‌, পাঁচ মিনিটের রাস্তা।

দেবাশিসের সদর দরজার ঘণ্টি টিপতেই নকুল এসে দোর খুলল। নৃপতি বলল–’দেবাশিসবাবু আছেন?’

নকুল বলল–’আজ্ঞে‌, তিনি এইমাত্র ফেক্টরি থেকে বাড়ি ফিরেছেন–’

এই সময় দেখা গেল দেবাশিস সিড়ি দিয়ে নেমে আসছে। সে সদর দোরের কাছে এলে নৃপতি একটু হেসে বলল—’আমাকে আপনি চিনবেন না‌, আপনার বাবা শুভাশিসবাবুর সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় ছিল। আমার নাম নৃপতি লাহা।’

দেবাশিসের মুখেও হাসি ফুটল—’আপনাকে চিনি না বটে‌, কিন্তু নাম জানি। আপনার বাড়িও দেখেছি। আসুন।’ সে নৃপতিকে বসবার ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে থমকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল–’বসবার ঘরে না গিয়ে চলুন খাবার ঘরে যাই। চায়ের সময় হয়েছে।’

নৃপতি বলল—’বেশ তো।’

দু’জনে খাবার ঘরে গিয়ে টেবিলে বসল। দেবাশিস বলল—‘নকুল‌, আমাদের চা জলখাবার দাও।’

নৃপতি বলল–’আমার চা হলেই চলবে।’

খেতে খেতে দু’জনের কথা হতে লাগল। বছর ছয়-সাত আগে দেবাশিসের বাবার সঙ্গে নৃপতির পরিচয় হয়েছিল; দেবাশিস তখন কলকাতায় থাকত না‌, দিল্লীতে পড়াশুনো করতে গিয়েছিল। শুভাশিসবাবু একদিন নৃপতির বাড়ির সামনে ফুটপাথের ওপর পা পিছলে পড়ে যান‌, নৃপতি তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফার্স্ট এড় দিয়েছিল। তারপর শুভাশিসবাবু তাঁর ফ্যাক্টরিতে তৈরি প্রচুর কেশতৈল সাবান কোন্ড ক্রিম প্রভৃতি তাকে উপহার দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তার বাড়িতে এসে তত্ত্ব-তল্লাশ নিতেন। বছর দুই পরে তিনি যখন মারা গেলেন তখন নৃপতি খবর পেল না‌, একেবারে খবর পেল মাস তিনেক পরে। এমনি কলকাতা শহর। শুভাশিসবাবুর মৃত্যু-সংবাদ নৃপতিকে জানাবে এমন লোক কেউ ছিল না।

দেবাশিস দিল্লীতে তার বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে কলেজে পড়াশুনো করছিল। বাল্যকালেই তার মা মারা গিয়েছিলেন। বাবার বন্ধুটি ছিলেন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা বিজ্ঞান-অধ্যাপক। দেবাশিস এম. এস-সি. পাস করে দিল্লী থেকে চলে এল। তার মাসখানেক পরেই তার বাবা মারা গেলেন।

50 Shares