নৃপতি প্রশ্ন করল–’আপনার বাড়িতে আর কে আছে?’
দেবাশিস বলল–’আর কেউ নেই, আমি একা। কিংবা আমি আর নকুল বলতে পারেন। নকুল এ বাড়িতে আমি জন্মাবার আগে থেকে আছে।’
‘বিয়ে করেননি?’
লেখাপড়া শেষ করে ফিরে আসার পরই বাবা মারা গেলেন, তারপর আর হয়ে ওঠেনি।’
‘হুঁ। ভাল কথা, আপনার উপাধি যখন ভট্ট তখন নিশ্চয় ব্ৰাহ্মণ। গোত্র জানা আছে কি?’
‘যখন পাইতে হয় শুনেছিলাম শাণ্ডিল্য গোত্র। বাড়ুজে।’
‘বাঃ, বেশ। আচ্ছা, আমি যদি ঘটকালি করি, আপনার আপত্তি হবে কি?’
দেবাশিস মুখে টিপে একটু হাসল, উত্তর দিল না। নকুল এতক্ষণ ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিল, এখন এগিয়ে এসে বলল-’হ্যাঁ বাবু্, আপনি করুন। ঘরে একটি বউ দরকার। আমি বুড়ো মানুষ আর কত দিন সংসার চালাব।’
‘তাই হবে।’ নৃপতি চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। —’আজ চলি। আমার বাড়িতে রোজ সন্ধ্যেবেলা আড্ডা বসে, পাড়ার ছেলেরা আসে। আপনিও আসেন না কেন?’
‘আচ্ছা, যাব।’
‘আজই চলুন না!’ দেবাশিস একটু ইতস্তত করে বলল—’আজই? বেশ, চলুন।’
দু’জনে বেরুল। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। নৃপতির বাড়ির সামনে এসে তারা শুনতে পেল বৈঠকখানায় কেউ লঘু আঙুলের স্পর্শে পিয়ানো বাজাচ্ছে।
বৈঠকখানা ঘরে তিনটে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কেবল একটি মানুষ ঘরে আছে, দেয়াল-ঘেঁষা পিয়ানোর সামনে বসে আপন মনে বাজিয়ে চলেছে।
নৃপতি দেবাশিসকে নিয়ে ঘরে ঢুকল, বলল–’ওহে প্রবাল, দ্যাখো, আমাদের আডায় একটি নতুন সভ্য পাওয়া গেছে। এঁর নাম দেবাশিস ভট্ট।’
প্রবাল নামধারী যুবক পিয়ানো থেকে উঠে এল। নিরুৎসুক স্বরে বলল—’পরিচয় দেবার দরকার নেই।’
নৃপতি বলল–’আগে থাকতেই পরিচয় আছে নাকি?’
প্রবাল বলল–’সামান্য। গরীবের সঙ্গে বড়মানুষের যতটুকু পরিচয় থাকা সম্ভব ততটুকুই।’
প্রবাল আবার পিয়ানোর সামনে গিয়ে বসল। টুং-টাং করে একটা সুর বাজাতে লাগল। তার ভাবভঙ্গী দেখে বেশ বোঝা যায় দেবাশিসকে দেখে খুশি হয়নি। সে বয়সে দেবাশিসের চেয়ে দু’এক বছরের বড়, মাঝারি দৈর্ঘ্যের বলিষ্ঠ চেহারা, মুখের গড়নে বৈশিষ্ট্য না থাকলেও জৈব আকর্ষণ আছে; চোখের দৃষ্টি অপ্রসন্ন। কিন্তু তার চেহারা যেমনই হোক সে ইতিমধ্যে গায়ক হিসেবে বেশ নাম করেছে। তার কয়েকটা গ্রামোফোন রেকর্ড খুব জনপ্রিয় হয়েছে; রেডিও থেকেও মাঝে মাঝে ডাক পায়।
প্রবালের সঙ্গে দেবাশিসের অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। এক সময় তারা একসঙ্গে স্কুলে পড়ত, ভাবসাব ছিল; তারপর দেবাশিস স্কুল থেকে পাস করে দিল্লীতে পড়তে চলে গেল। কয়েক বছর পরে এই প্রথম দেখা। এই কয় বছরের মধ্যে দেবাশিসের বাবা ‘প্রজাপতি প্রসাধন নামে শৌখিন টয়লেট দ্রব্যের কারখানা খুলে বড়মানুষ হয়েছেন। আর প্রবালের বাবা হঠাৎ হার্ট ফেল করে মারা যাওয়ার ফলে তাদের সম্পন্ন অবস্থার খুবই অধোগতি হয়েছে। প্রবাল গান গেয়ে কোনো মতে টিকে আছে।
প্রবালের কথা বলার ভঙ্গীতে দেবাশিস বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল, নৃপতি তাকে ঘরের এক কোণে নিয়ে গিয়ে সোফায় পাশাপাশি বসে গল্প করতে লাগিল। বলল–’আমার আড়ডায় পাঁচ-ছয়জন আসে। কিন্তু সবাই রোজ আসে না। আজ আরো দু-তিনজন আসবে।’
নৃপতি দেবাশিসের সামনে সিগারেটের টিন খুলে ধরল, দেবাশিস মাথা নেড়ে বলল–’ধন্যবাদ। আমি খাই না।’
নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে নৃপতি খাটো গলায় বলল–’প্রবাল গুপ্ত গাইয়ে-বাজিয়ে লোক, একটু বেশি সেনসিটিভ, আপনি কিছু মনে করবেন না। ক্রমে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এই সময় বাইরে থেকে একটি যুবক সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। সিঙ্কের লম্বা প্যান্ট ও বুশ-কোট পরা সুগঠিত সুদৰ্শন চেহারা, ধারালো মুখে আভিজাত্যের ছাপ, বেশ দৃঢ় চরিত্রের ছেলে বলে মনে হয়, বয়স চব্বিশ-পাঁচিশ। তাকে দেখে নৃপতি বলল—‘এই যে কপিল। এস পরিচয় করিয়ে দিই। কপিল বোস-দেবাশিস ভট্ট।’
নমস্কার প্রতিনমস্কারের পর কপিল বলল—’নৃপতিদা, তোমার টেলিফোন একবার ব্যবহার করব। রাস্তায় আসতে আসতে একটা জরুরী কথা মনে পড়ে গেল।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়।’
কপিল পাশের ঘরে চলে গেলে নৃপতি বলল—‘কপিল ছেলেটা ভাল, বাপ অগাধ বড়মানুষ, কিন্তু ওর কোনো বদখেয়াল নেই। লেখাপড়া শিখেছে, টেনিস বিলিয়ার্ড খেলে দিন কটায়, রাত্তিরে দূরবীন লাগিয়ে আকাশের তারা গোনে। কেবল একটি দোষ, বিয়ে করতে চায় না।’
প্রবাল হঠাৎ পিয়ানো ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নৃপতির দিকে তাকিয়ে বলল–’আজ চললাম নৃপতিদা।’ দেবাশিসকে সে লক্ষ্যই করল না।
নৃপতি বলল—’চললে? এত সকাল সকাল? রেডিওতে গাইতে হবে বুঝি? কাগজে যেন দেখেছিলাম আজ রাত্রে তোমার প্রোগ্রাম আছে।’
প্রবাল বলল–’প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু গান আগেই রেকর্ড হয়ে গেছে, আমাকে স্টুডিও যেতে হবে না। আমি বাসায় যাচ্ছি।’
নৃপতি বলল–’বাসায় যাচ্ছ। তোমার বউ-এর খবর ভাল তো?’
প্রবাল উদাস স্বরে বলল—’তোমাদের বলিনি নৃপতিদা, বউ মাসখানেক আগে মারা গেছে। হার্টের রোগ নিয়ে জন্মেছিল; ডাক্তারেরা বলে বারো-চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে অপারেশন না করালে এ রোগে কেউ একুশ-বাইশ বছরের বেশি বাঁচে না। আমার শ্বশুর রোগ লুকিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল।–আচ্ছা, চললাম।’
নৃপতি ও দেবাশিস স্তব্ধ হয়ে রইল। স্ত্রী মারা গেছে। অথচ আড্ডার কাউকে কিছু বলেনি; আপন মনে পিয়ানো বাজায় আর চলে যায়। নৃপতি জানত প্রবালের স্ত্রীর মরণােস্তক রোগ, কিন্তু খবর শুনে হঠাৎ তার মুখে কথা যোগালো না।