এই সময় কপিল পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে তাদের কাছে দাঁড়াল। সে প্রবালের কথাগুলো শুনতে পায়নি, তার দিকে তাকিয়ে বলল–’বেশ তো পিয়ানো বাজাচ্ছিলে, চললে নাকি? একটা গান শোনাও না।’
প্রবাল তীব্র বিদ্বেষভরা চোখে তার পানে চেয়ে রুদ্ধস্বরে বলল—’আমার গান বিনা পয়সায় শোনা যায় না। পয়সা খরচ করতে হয়।’
কপিল এরকম কড়া জবাবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, সে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে হেসে উঠল। বলল–’পিয়সা খরচ করেই যদি গান শুনতে হয় তাহলে তোমার গান শুনব কেন? তোমার চেয়ে অনেক ভাল গাইয়ে আছে।’
প্রবাল আর দাঁড়াল না, হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কপিল একটা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল, নৃপতি অপ্রতিভা মুখে বলল–’আজ প্রবালের মেজাজটা ভাল নেই।’
কপিল বলল—’প্রবালের মেজাজ সর্বদাই সপ্তমে চড়ে থাকে। ধাতুগত বিকার।’
‘ওর স্ত্রী মারা গেছে।’
কপিল চিকিত হয়ে বলল–’তাই নাকি! আমি জানতাম না। ছিঃ ছি, অসভ্যতা করে ফেলেছি।’
নৃপতি বলল—’যাক গে। তুমি কেমন আছ বলে। কয়েকদিন তোমাকে দেখিনি।’
কপিল বলল–’গ্ল্যান করেছিলাম বাঙ্গালোরে বেড়াতে যাব, কিন্তু প্ল্যান ভেস্তে গেল।‘
‘ভেস্তে গেলি কেন?’
‘আমার সঙ্গে যার যাবার কথা ছিল সে যেতে পারল না। একলা বেড়িয়ে সুখ নেই।’
‘তা বটে। কিন্তু তুমি বিয়ে করছ না কেন? বিয়ে করলে তো একটি চিরস্থায়ী সহযাত্রী পাবে।’
কপিল হেসে উঠল, থিয়েটারী কায়দায় বাহু প্রসারিত করে বলল-কিবি বলেছেন, হব না। তাপস নিশ্চয় যদি না মেলে তপস্বিনী। আমিও কবির দলে।’
নৃপতি বলল–’কিন্তু শুনেছি তোমার বাবা তপস্বিনী জোটাবার ক্রুটি করেননি, গোটা পঞ্চাশেক সুন্দরী তপস্বিনী দেখেছেন। একটিও তোমার পছন্দ হল না?
কপিল একটু গভীর হয়ে বলল—’সুন্দরী মেয়ে অনেক আছে নৃপতিদা, কিন্তু শুধু সুন্দরী হলেই তো চলে না। আমি এমন বউ চাই যার মন হবে আমার মনের সমান্তরাল, অর্থাৎ সমানধম।–কথাটা বুঝেছেন?’
‘বুঝেছি। তুমি হুঁশিয়ার লোক। তা নিজে পছন্দ করে বিয়ে কর না কেন? তোমার বাবা নিশ্চয় অমত করবেন না।’
কপিল হেসে বলল–’সেই চেষ্টাতেই আছি।’
তারপর সাধারণভাবে কথা হতে লাগিল। দেবাশিস এতক্ষণ কেবল নিশ্চেষ্ট শ্রোতা ছিল, এখন সেও কথাবার্তায় যোগ দিল। দেবাশিসের পূর্ণতর পরিচয় শুনে কপিল বলল—’আরে তাই নাকি! আপনিই প্রজাপতি প্রসাধন প্রডাক্টস? আমরা যে বাড়িসুদ্ধ আপনার তেল সাবান মো ক্রিম ব্যবহার করি। তা অ্যাদ্দিন আপনি ছিলেন কোথায়?’
দেবাশিস বলল–’এখানেই ছিলাম, কিন্তু নৃপতিবাবুর সঙ্গে আলাপ ছিল না।’
আরো খানিকক্ষণ গল্পসল্প হল। চাকর এসে ছোট ছোট পেয়ালায় কফি দিয়ে গেল। ক্রমে আটটা বাজল। নৃপতি বলল—’আজ বোধ হয়। আর কেউ আসবে না।’
দেবাশিস বলল–’আজ উঠি।’
কপিল বলল–’এরি মধ্যে! আমাদের আড্ডা। নটা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চলে।’
দেবাশিস হেসে বলল–’আবার আসব।’
নৃপতি জিজ্ঞেস করল—’কাল আসতে পারবেন?’
দেবাশিস বলল–’আচ্ছা, কাল আসব।’—
৩
পরদিন দেবাশিস একটু দেরি করে এল। ইচ্ছে ছিল সাড়ে আটটা নটা পর্যন্ত থেকে গল্পগুজব করবে। বাড়িতে রোজ সন্ধ্যেবেলা একলা বিজ্ঞানের বই আর সাময়িক পত্র পড়ে কাটে, এখানে নতুন লোকের সঙ্গ পাওয়া যাবে। প্রবালের অসামাজিক ব্যবহার সত্ত্বেও নৃপতির আড্ডাটি তার ভাল লেগে গিয়েছিল।
সাড়ে ছাঁটার সময় নৃপতির বৈঠকখানায় গিয়ে দেবাশিস দেখল প্রবাল পিয়ানোর সামনে বসে চাবির ওপর আঙুল বুলোচ্ছে, কপিল এবং আর একটি ছেলে তক্তপোশের পাশে বসে পাঞ্জা লড়ছে; নৃপতি এবং অন্য একটি যুবক পাশাপাশি বসে গল্প করছে। নৃপতি তাকে হাত তুলে ডাকল।
দেবাশিস কাছে গেলে নৃপতি বলল-‘বসুন। এখানে। পরিচয় করিয়ে দিই। দেবাশিস ভট্ট-বিজয়ামাধব মুখুজে। বিজয় হচ্ছে অধ্যাপক বংশের ছেলে, সম্প্রতি সংস্কৃতে এম.এ. পাস করে অধ্যাপনার কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে।’ দেবাশিসের পূর্ণ পরিচয় নৃপতি আগেই বিজয়কে দিয়েছিল, আর পুনরাবৃত্তি করল না।
বিজয় উৎসুক চোখে দেবাশিসকে দেখতে লাগল। নৃপতি তাদের মাঝখান থেকে উঠে পড়ল, বলল–’তোমরা গল্প কর, আমি আসছি।’
বিজয় দেবাশিসের দিকে একটু ঘেঁষে বসল। বলল—’এক পাড়াতে থাকি, অ্যাদ্দিন আলাপ-পরিচয় হয়নি, কি আশ্চর্য বলুন দেখি।’ চেহারা দেখেই দেবাশিসকে তার পছন্দ হয়েছিল; দীপার উপযুক্ত বর।
যদিও কলকাতা শহরে পাশাপাশি বাস করেও আলাপ-পরিচয় না হওয়াতে আশ্চর্য কিছু নেই, তবু দেবাশিস হাসিমুখে বলল—’আশ্চর্য বইকি।’
ওদিকে কপিল আর অন্য ছেলেটির পাঞ্জা লড়া শেষ হয়েছিল, নৃপতি তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল–’কি হে খড়্গ বাহাদুর, তোমার দেশে যাবার কথা ছিল না?
খড়্গ বাহাদুর প্রফুল্ল স্বরে বলল—’কথা তো ছিল নৃপতিদা, কিন্তু যাওয়া হল না।’
খড়্গ বাহাদুর নেপালী যুবক। তার মা বাঙালী। তাই তার মাতৃভাষাও বাংলা। চমৎকার চেহারা, যেমন পীতাভ সোনালী রঙ তেমনি লম্বা ছিপছিপে গড়ন। তার মুখে চোখে মঙ্গোলীয় রক্তের ছাপ। এত অল্প যে ধরা যায় না। বর্তমানে সে বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলোয়াড়; পায়ের কাছে বল পেলে সে যাদুকর বনে যায়। কলকাতার সবচেয়ে নামজাদা ফুটবল ক্লাবের সে খেলোয়াড়। তার খেলা দেখবার জন্যে লক্ষ লক্ষ দর্শক মাঠে জমা হয়। তার চরিত্রে বিন্দুমাত্র চালিয়াত নেই। উচ্চবংশের ছিল, কিন্তু ভারি কিয়ী। বয়স তেইশ কি চব্বিশ।