শজারুর কাঁটা

নৃপতি বলল–’কেন‌, যাওয়া হল না কেন?’

খড়্গ বাহাদুর বলল—’কাঠমাণ্ডুতে বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়েছিল‌, হঠাৎ তার পেলাম কীসব গণ্ডগোল হয়েছে‌, বিয়ে পেছিয়ে গেছে।’

নৃপতি বলল–’তার মানে এক বছরের ধাক্কা। ফুটবল সীজন এসে পড়ল‌, এরপর তুমি তো আর নেপালে গিয়ে বসে থাকতে পারবে না।’

খড়্গ বাহাদুর চোখে কৌতুক এবং মুখে বিষণ্ণতা নিয়ে মাথা নাড়ল।

চাকর বড় একটি ট্রের ওপর কয়েক পেয়ালা কফি নিয়ে এল‌, সকলেই এক এক পেয়ালা তুলে নিল। এই সময় সদর দরজার কাছ থেকে আওয়াজ এল–’ওহে‌, আমিও আছি‌, আমার জন্যে এক পেয়ালা রেখো।‘

একটি যুবক প্রবেশ করল। রজতগৌর বর্ণ‌, মুখের ছাঁচ কেষ্টনগরের পুতুলকেও হার মানায়; চোখ দু’টি উজ্জ্বল‌, ক্ষৌরিত মুখে একটা হাসি লেগে আছে। বয়স সাতাশ-আটাশ।

নৃপতি বলল—‘এস সুজন।’

সুজন মিত্র একজন উদীয়মান চিত্রনক্ষত্র; দু’ তিনখানা ছবি করেই বেশ নাম করেছে। যেমন গভীর ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে‌, তেমনি হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষমতাও আছে। সবচেয়ে বড় কথা‌, হঠাৎ খ্যাতি ও অর্থ লাভ করেও তার মেজাজ বিগড়ে যায়নি। নিজের কথা সাত কাহিন করে বলতে সে ভালবাসে না। বস্তুত তার সম্বন্ধে কেউ বড় কিছু জানে না। স্ত্রীজাতির প্রতি তার আসক্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এমন কি সে বিবাহিত কি অবিবাহিত তাই কেউ জানে না। দক্ষিণ কলকাতার একান্তে একটি ছোট বাড়িতে একলা থাকে‌, বেশির ভাগ সময়ই হোটেলে খায়। অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং অপ্রকট তার জীবন।

সুজন ট্রে থেকে টপ করে একটা পেয়ালা তুলে নিয়ে বলল–’ঠিক সময়ে এসেছি‌, আর একটু হলে ফাঁকি পড়তাম।’

কফিতে একটি চুমুক দিয়ে সে তার উজ্জ্বল অভিনেতার চোখ দু’টি ঘরের চারিদিকে ফেরাল‌, তারপর দেবাশিসকে দেখে হ্রস্ব কণ্ঠে বলল–’নৃপতিদা‌, নতুন অতিথির সমাগম হয়েছে দেখছি!’

নৃপতি বলল—’হ্যাঁ‌, এস তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। খড়গ‌, তুমিও এস।’

পরিচয় বিনিময়ের পর সুজন মিটমিটি হেসে বলল—’দেবাশিসবাবু্‌, এখন বলুন দেখি আপনি ফুটবল খেলা দেখতে ভালবাসেন‌, না সিনেমা দেখতে ভালবাসেন?’

দেবাশিস বলল–’দুই-ই ভালবাসি। খেলার মাঠে এবং রূপালী পদায় আপনাদের দু’জনকে অনেকবার দেখেছি।’

তারপর সকলে মিলে খানিকক্ষণ হাসিগল্প চালাল। প্রবাল কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগ দিল না‌, নিজের মনে টুং-টাং করে পিয়ানো বাজিয়ে চলল।

রাত আন্দাজ ন’টার সময় সভা ভঙ্গ হল। দেবাশিস বেশ প্রফুল্ল মনে বাড়ি ফিরে এল।

এইভাবে কয়েকদিন কাটাবার পর এক রবিবার সকালবেলা বিজয়‌, তার বাবা নীলমাধব এবং নৃপতি দেবাশিসের বাড়িতে দেখা করতে এল। দেবাশিস তাদের খাতির করে নীচের তলায় বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো এবং নকুলকে চায়ের হুকুম দিল।

নীলমাধব মুখুজে অতিশয় গভীর প্রকৃতির লোক। তিনি আগে বিজয়ের মুখে দেবাশিস সম্বন্ধে সব কথা শুনেছিলেন এবং তত্ত্ব-তল্লাশও নিয়েছিলেন। পাত্রটিকে সৎপাত্র মনে হওয়ায় তিনি এখন স্বচক্ষে দেখতে এসেছেন। তিনি দেবাশিসকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করলেন এবং নৃপতির দিকে ঘাড় নেড়ে সন্তোষ জ্ঞাপন করলেন।

ইতিমধ্যে চা এসে পড়েছে। নৃপতি চা খেতে খেতে নিপুণভাবে বিয়ের প্রস্তাব তুলল। নৃপতির ঘটকালির দিকে বিশেষ দক্ষতা আছে।

আধা ঘন্টার মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল। দেবাশিসের ঠিকুজি কোষ্ঠী ছিল না। তাই জ্যোতিষের যোটক বাদ দিতে হল। নৃপতি বলল—’দেবাশিস‌, দীপকে তোমার অপছন্দ হবে না জানি‌, তবু একবার দেখা দরকার। আজ বিকেলে আমি এসে তোমাকে এঁদের বাড়িতে নিয়ে যাব। কেমন?

দেবাশিস সম্মত হল। বলা বাহুল্য‌, এই কদিনে নৃপতি ও দেবাশিসের ঘনিষ্ঠত ‘তুমি ও ‘নৃপতিদার পর্যয়ে নেমেছে।

সেদিন অপরাহ্নে নৃপতি এসে দেবাশিসকে দীপাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। বৈঠকখানা ঘরে আসর হয়েছিল; আড়ম্বর কিছু নয়‌, টেবিলের মাঝখানে ফুলদানিতে এক গুচ্ছ ফুল‌, তক্তপোশের ওপর মখমলের আস্তরণ এবং মোটা তাকিয়া। বিজয় তাদের নিয়ে গিয়ে ঘরে বসালো‌, তারপর নীলমাধব এসে দেবাশিসকে তেতলার ঘরে নিয়ে গেলেন। উদীয়মাধব তার সঙ্গে দুচারটে কথা বললেন; তাঁর মুখ দেখে বোঝা গেল ভাবী নাতজামাই দেখে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন।

তারপর নীলমাধব দেবাশিসকে নিয়ে আবার নীচে নেমে এলেন। পাঁচ মিনিট পরে বিজয় গিয়ে দীপকে নিয়ে এল‌, দীপা এসে টেবিলের কাছে দাঁড়াল। পরনে আটপৌরে শাড়ি ব্লাউজ‌, কানে ছোট ছোট দু’টি সোনার আংটি‌, গলায় সরু হার‌, হাতে তিনগাছি করে চুড়ি। কনে দেখানো উপলক্ষে তাকে সাজগোজ করানো হয়নি‌, কিংবা সে নিজেই সাজগোজ করেনি। তার সারা দেহে প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহ। একবার সে পলকের জন্য চোখ তুলে দেবাশিসের দিকে চেয়ে আবার চোখ নীচু করল। ক্রূর ঋজু রেখার নীচে চোখের দৃষ্টি খর।

দেবাশিসের কিন্তু দীপাকে খুব ভালো লেগে গেল। স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা শূন্য সুকুম গুরু দীপকে দেখে তার মান মার্থের সঙ্গর হল মন হল একে ঐরূপে পেলে সে সুখী হবে।

দুমিনিট পরে বিজয় বলল–’দীপা‌, তুমি এবারে যাও। দেখা হয়েছে।’

দীপা চলে গেল। তারপর মিষ্টিমুখ করে দেবাশিস সলজ্জ সম্মতি জানাল।

দুহাপ্তার মধ্যে সব ঠিকঠাক‌, বিয়ে হয়ে গেল। এই দুহস্তার মধ্যে দীপা যে তার প্রেমিকের সঙ্গে চুপিচুপি টেলিফোন মারফত বাক্যালাপ করেছে সতর্ক পাহারা সত্ত্বেও কেউ তা জানতে পারল না।’

বিয়ের রাত্রে কনের বাড়িতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে নৃপতির বাড়ির আড়াধারীরাও এল‌, কারণ তারা বিজয়ের বন্ধু। আবার বউভাতের রাত্রে যারা দেবাশিসের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে এল তাদের মধ্যে প্রজাপতি ফ্যাক্টরির সাহাকারীদের সঙ্গে নৃপতির দলও এল‌, কারণ তারা দেবাশিসের বন্ধু। যাকে বলে‌, বরের ঘরের মাসি কনের ঘরের পিসি।

50 Shares