শৈলরহস্য

‘দ্বিতীয় প্রশ্ন। বিজয় বিশ্বাসের নামে ব্যাঙ্কে হাজার দুই টাকা ছিল। হোটেল বিক্রি হবার আগেই সে টাকা বার করে নিয়েছিল কেন?’

‘জানি না।’

‘তৃতীয় প্রশ্ন। তুমি যখন হৈমবতীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে‌, তখন শীতের সন্ধ্যে হয়-হয়। চাকর যখন বলল হৈমবতী স্নান করছেন‌, তখন তোমার খাটকা লাগল না?’

না। মানে-খেয়াল করিনি।’

‘চতুর্থ প্রশ্ন। চাকরটাকে সন্দেহ হয়নি?’

‘না। চাকরটাকে সন্দেহ করার কোনও কারণ হয়নি। সে পূর্ববঙ্গের লোক‌, মাত্র কয়েকদিন হৈমবতীর চাকরিতে ঢুকেছিল। অবশ্য একথা যদি সত্যিই হয় যে সে লোহার সিন্দুক খোলবার চেষ্টা করছিল—‘

‘অজিত‌, তোমার সরলতা সত্যিই মর্মস্পশী। চাকরটা সিন্দুক খোলবার উদ্যোগ করেছিল বটে‌, কিন্তু চুরি করবার জন্যে নয়। —মহাবলেশ্বরে দু’জন লোক খুন করবার ষড়যন্ত্র করেছিল‌, তার মধ্যে একজন হচ্ছে হৈমবতী। অন্য লোকটি কে?’

‘মানেক মেহতা ছাড়া আর কে হতে পারে?’

ব্যোমকেশ কুটিল হাসিয়া বলিল‌, ‘ঐখানেই ধাপ্পা-প্রচণ্ড ধাপ্পা! হৈমবতী ষড়যন্ত্র করেছিল তার স্বামীর সঙ্গে‌, মানেক মেহতার সঙ্গে নয়। হৈমবতীর আর যে দোষই থাক‌, সে পতিব্রতা নারী‌, তাতে সন্দেহ নেই।’

হতবুদ্ধি হইয়া বলিলাম‌, ‘কী বলছ তুমি’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যা বলছি মন দিয়ে শোনো।–হোমজি যখন আমাকে গল্পটা বললেন তখন আমার মনে বিশেষ দাগ কাটেনি। তবু একটা খটকা লেগেছিল; মানেক মেহতা বিজয় বিশ্বাসকে খুন করবার জন্যে খাদের ধারে নিয়ে গেল কেন? বিজয় শীত-কাতুরে লোক ছিল‌, সে-ই বা গেল কেন?

‘তারপর ভূতের উৎপাত শুরু হল। দায়ে পড়ে অনুসন্ধান শুরু করলাম। খটকা ক্রমে সন্দেহে পরিণত হতে লাগল। তারপর ওয়ার্ডরোবের মধ্যে পেলাম একটুকরো বাদামী কাগজে একটা ঠিকানা; বাংলা অক্ষরে লেখা কলকাতার উপকণ্ঠের একটা ঠিকানা। আমার মনের অন্ধকার একটু একটু করে দূর হতে লাগল।

‘তোমাকে লম্বা চিঠি লিখলাম। তারপর তোমার উত্তর যখন পেলাম তখন আর কোনও সংশয় রইল না। আপ্টে সাহেবকে সব কথা বললাম। তিনি তখনও ঠ্যাং নিয়ে পড়ে আছেন‌, কিন্তু তখনই কলকাতার পুলিসকে টেলিগ্রাম করলেন এবং আমার প্লেনে আসার ব্যবস্থা করে

‘হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাসকে ধরা গেল না বটে‌, কিন্তু প্রেতের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে‌, আসল অপরাধী কারা তা জানা গেছে। বলা বাহুল্য‌, যে প্ৰেতটা নাছোড়বান্দা হয়ে আমাকে ধরেছিল। সে মানেক মেহতা।’

সত্যবতী বলিল‌, ‘সত্যি কি হয়েছিল বল না গো!’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সত্যি কি হয়েছিল তা জানে কেবল হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাস। আমি মোটামুটি যা আন্দাজ করেছি‌, তাই তোমাদের বলছি।’

সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল।–’মানেক মেহতা ছিল নামকটা বদমাশ‌, আর বিজয় বিশ্বাস ছিল ভিজে বেড়াল। একদা কি করিয়া মিলন হল দোঁহে। দু’জনে মিলে হোটেল খুলল। মেহতার টাকা‌, বিশ্বাসদের মেহনত।

‘স্ত্রী-পুরুষে হোটেল চালাচ্ছে‌, হোটেল বেশ জাঁকিয়ে উঠল। প্রতি বছর ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা লাভ হয়। মেহতা মাঝে মাঝে এসে নিজের ভাগের টাকা নিয়ে যায়। বিজয় বিশ্বাস নিজের ভাগের টাকা মহাবলেশ্বরের ব্যাঙ্কে বেশি রাখে না‌, বোধ হয় স্ত্রীর নামে অন্য কোথাও রাখে। হয়তো কলকাতারই কোনও ব্যাঙ্কে হৈমবতীর নামে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা জমা আছে‌, ওরা দু’জনে ছাড়া আর কেউ তার সন্ধান জানে না।

‘এইভাবে বেশ চলছিল‌, গত বছর মানেক মেহতা বিপদে পড়ে গেল। তার বে-আইনী সোনার চালান ধরা পড়ে গেল। তাকে পুলিস জড়াতে পারল না বটে‌, কিন্তু অত সোনা মারা যাওয়ায় সে একেবারে সর্বস্বাস্ত হয়েছিল। তখন তার একমাত্র মূলধন-হোটেল; মানেক মেহতা ঠিক করল সে হোটেল বিক্রি করবে। তার নগদ টাকা চাই।

‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে‌, হোটেল বিক্রির টাকা কে পাবে। একলা মেহতা পাবে‌, না‌, বিজয় বিশ্বাসেরও বখরা আছে? ওদের পার্টনারশিপের দলিল আমি দেখিনি। অনুমান করা যেতে পারে যে মানেক মেহতা যখন হোটেল কেনার টাকা দিয়েছিল‌, তখন হোটেল বিক্রির টাকাটাও পুরোপুরি তারই প্ৰাপ্য। আমার বিশ্বাস‌, মেহতা সব টাকাই দাবি করেছিল।

‘হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাস ঠিক করল। সব টাকা ওরাই নেবে। ওদের পূর্ব ইতিহাস কিছু জানা যায় না‌, কিন্তু ওদের প্রকৃতি যে স্বভাবতাই অপরাধপ্রবণ তাতে আর সন্দেহ নেই। দু’জনে মিলে পরামর্শ করল। মানেক মেহতা পুলিসের নজরলাগা দাগী লোক‌, তার ঘাড়ে অপরাধের ভার চাপিয়ে দেওয়া সহজ। স্বামী-স্ত্রী মিলে নিপুণভাবে প্ল্যান গড়ে তুলল।

‘কলকাতার উপকণ্ঠে তখন কি ভাবে ওরা বাসা ঠিক করেছিল‌, আমি জানি না। হয়তো কলকাতার কোনও পরিচিত লোকের মারফত বাসা ঠিক করেছিল। হৈমবতী বাসার ঠিকানা কাগজে লিখে ওয়ার্ডরোবের মধ্যে ওঁজে রেখেছিল‌, পাছে ঠিকানা ভুলে যায়। পরে অবশ্য ঠিকানা তাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল‌, তাই হৈমবতী যাবার সময় বাদামী কাগজের টুকরোটা ওয়ার্ডরোবেই ফেলে যায়। কাঠের ওয়ার্ডরোবে বাদামী কাগজের টুকরোটা বোধহয় চোখে পড়েনি। ঐ একটি মারাত্মক ভুল হৈমবতী করেছিল।

‘যাহোক‌, নির্দিষ্ট রাত্রে মানেক মেহতা চুপিচুপি এসে হাজির। হোটেলে একটিও অতিথি নেই। চাকরানীটাকে হৈমবতী নিশ্চয় ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল। হোটেলে ছিল কেবল হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাস।

‘মানেক মেহতাকে ওরা হোটেলের অফিস-ঘরেই খুন করেছিল। এমনভাবে খুন করেছিল যাতে রক্তপাত না হয়। তারপর ছদ্মবেশ ধারণের পালা। বিজয় বিশ্বাস মানেক মেহতার গা থেকে জামা কাপড় খুলে নিজে পরিল‌, নিজের জামা কাপড় গলাবন্ধ মানেক মেহতাকে পরিয়ে দিল। তারপর দু’জনে লাশ নিয়ে গিয়ে খাদের মধ্যে ফেলে দিল। কিছুদিন থেকে এক ব্যাঘ্র-দম্পতি এসে খাদে বাসা নিয়েছিল‌, সুতরাং লাশের যে কিছুই থাকবে না তা বিশ্বাস-দম্পতি জানত। ব্যাঘ্র-দম্পতির কথা বিবেচনা করেই তারা প্ল্যান করেছিল।

0 Shares