শৈলরহস্য

আশ্চর্য হলাম। বললাম‌, ‘বলেন কি! বাঙালী এতদূরে এসে হোটেল খুলে বসেছিল।’

হোমজি বললেন‌, ‘হ্যাঁ। তবে একলা নয়। তাঁর একজন গুজরাতী অংশীদার ছিল।’

এই সময় একটা চাকর এসে অবোধ্য ভাষায় তাঁকে কি বলল‌, তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন‌, ‘আপনি কি-স্নান করবেন? যদি করেন‌, গরম জল তৈরি আছে।’

বললাম‌, রক্ষে করুন‌, এই শীতে স্নান! একেবারে বোম্বাই গিয়ে মান করব।’ চাকর চুলে গেল। তখন আমি হোমজিকে প্রশ্ন করলাম‌, ‘আচ্ছা‌, আপনি তো বম্বের লোক? তাহলে এই শীতে এখানে রয়েছেন কেন? এখানে তো কাজকর্ম এখন কিছু নেই।’

হোমজি বললেন‌, ‘কাজকর্ম আছে বৈকি। মার্চ মাস থেকে হোটেল খুলবে‌, অতিথিরা আসতে শুরু করবে। তার আগেই বাড়িটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে ফিট্‌ফাট করে তুলতে হবে। তাছাড়া বাড়ির পিছন দিকে গোলাপের বাগান করেছি। চলুন না দেখবেন। এখনও দিনের আলো আছে।’

বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে বাগান দেখলাম। বাগান এখনও তৈরি হয়নি‌, তবে মাসখানেকের মধ্যে ফুল ফুটতে আরম্ভ করবে। হোমজির ভারি বাগানের শখ।

এইখানে সহ্যাদ্রি হোটেলের একটা বৰ্ণনা দিয়ে রাখি। চুনকাম করা পাথরের দোতলা বাড়ি‌, সবসুদ্ধ বারো-চৌদ্দটা বড় বড় ঘর আছে। সামনে দিয়ে গেরুমটি ঢাকা রাস্তা গিয়েছে; পিছন দিকে গোলাপ বাগানের জমি‌, লম্বায় চওড়ায় কাঠা চারেক হবে। তারপরই গভীর খাদ; শুধু গভীর নয়‌, খাড়া নেমে গিয়েছে। পাথরের মোটা আলসের উপর ঝুঁকে উঁকি মারলে দেখা যায়‌, অনেক নিচে ঘন ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে একটা সরু ঝরনার ধারা বয়ে গেছে।

আমরা বাগান দেখে ফিরছি এমন সময় খাদের নিচে থেকে একটা গভীর আওয়াজ উঠে এল। অনেকটা মোষের ডাকের মত। নিচে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার‌, ওপরে একটু আলো আছে; আমি জিগ্যেস করলাম‌, ‘ও কিসের আওয়াজ?’

হোমজি বললেন‌, ‘বাঘের ডাক। আসুন‌, ভেতরে যাওয়া যাক।’ ঘরে বিদ্যুৎবাতি জ্বলছে; চাকর একটা গানগনে কয়লার আংটা মেঝের উপর রেখে গেছে। আমরা আংটার কাছে চেয়ার টেনে বসলাম। ঠাণ্ড আঙুলগুলোকে আগুনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বললাম‌, ‘এদিকে বড় বাঘ আছে?’

হোমজি বললেন‌, ‘আছে। তাছাড়া চিতা আছে‌, হায়েনা আছে‌, নেকড়ে আছে। যে বাঘটার ডাক আজ শুনলেন সেটা মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে কিনা‌, তাই এ তল্লাট ছেড়ে যেতে পারছে না।’

‘মানুষখেকো বাঘ! কত মানুষ খেয়েছে?’

‘আমি একটার কথাই জানি। ভারি লোমহর্ষণ কাণ্ড! শুনবেন?’

এই সময় আপ্টে ফিরে এলেন‌, লোমহর্ষণ কাণ্ড চাপা পড়ে গেল। আপ্টে বললেন‌, তাঁর আত্মীয় ছাড়ছেন না‌, আজ রাত্রে তাঁকে সেখানেই ভোজন এবং শয়ন করতে হবে। কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে তিনি উঠলেন‌, আমাকে বললেন‌, ‘কাল সকাল ন’টার মধ্যে আমি আসব! আপনি ব্রেকফার্স্ট খেয়ে তৈরি হয়ে থাকবেন‌, দু’জনে বেরুবা। এখানে অনেক দেখবার জায়গা আছে; বম্বে পয়েন্ট‌, আর্থার্স সীট‌, প্রতাপগড় দুর্গ–’

তিনি চলে গেলেন। আমরা আরও খানিকক্ষণ বসে এটা-সেটা গল্প করলাম। এখানে এখন শাকসব্জি-দুধ-ডিমা-মুগী খুব সস্তা‌, আবার গরমের সময় দাম চড়বে।

কথায় কথায় হোমজি বললেন‌, ‘আপনার ভূতের ভয় নেই তো?’

আমি হেসে উঠলাম। তিনি বললেন‌, ‘কারুর কারুর থাকে। একলা ঘরে ঘুমোতে পারে না। তাহলে আপনার শোবার ব্যবস্থা যদি দোতলায় করি আপনার অসুবিধা হবে না?’

বললাম‌, ‘বিন্দুমাত্র না। আপনি কোথায় শোন?’

তিনি বললেন‌, ‘আমি নিচেয় শুই। আমার বসবার ঘরের পাশে শোবার ঘর। আপনাকে ওপরে দিচ্ছি। তার কারণ‌, এখন সব ঘরের বিছানাপত্র তুলে গুদামে রাখা হয়েছে। অতিথি তো নেই। কেবল দোতলার একটা ঘর সাজানো আছে। তাতে হোটেলের ভূতপূর্ব মালিক সস্ত্রীক থাকতেন। ঘরটা যেমন ছিল তেমনি আছে।’

বললাম‌, ‘বেশ তো‌, সেই ঘরেই শোব।’

হোমজি চাকরকে ডেকে হুকুম দিলেন‌, চাকর চলে গেল‌, তারপর আটটা বাজলে আমরা খেতে বসলাম। এরি মধ্যে মনে হল যেন কত রাত হয়ে গেছে‌, চারদিক নিযুতি। বাড়িতে যদি ডাকাত পড়ে‌, মা বলতেও নেই‌, বাপ বলতেও নেই। গল্প শোনার এই উপযুক্ত সময়। বললাম‌, ‘আপনার লোমহর্ষণ কাণ্ড কৈ বললেন না?’

হোমজি বললেন‌, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ‌, ভারি রোমাঞ্চকর ব্যাপার। এই বাড়িতেই ঘটেছিল আগেকার দুই মালিকের মধ্যে। বলি শুনুন।’

হোমজি বলতে আরম্ভ করলেন। খাওয়া এবং গল্প একসঙ্গে চলতে লাগিল। হোমজি বেশ রাসিয়ে রসিয়ে গল্প বলতে পারেন‌, তাড়াহুড়ো নেই। তাঁর মাতৃভাষা অবশ্য গুজরাতী‌, কিন্তু ইংরেজিতেই বরাবর কথাবার্তা চলছিল। গল্পটাও ইংরেজিতেই বললেন। আমি তোমার জন্যে বাংলায় সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করে দিলাম।–

বছর ছয়েক আগে মানেক ভাই মেহতা নামে একজন গুজরাতী আর বিজয় বিশ্বাস নামে একজন বাঙালী মহাবলেশ্বরে এই সহ্যাদ্রি হোটেল খুলেছিল। দু’জনে সমান অংশীদার; মেহতার টাকা আর বিজয় বিশ্বাসের মেহনত। এই নিয়ে হোটেল আরম্ভ হয়।

মানেক মেহতার অনেক কাজ-করবার‌, সে মহাবলেশ্বরে থাকত না; তবে মাঝে মাঝে আসত। বিজয় বিশ্বাসই হোটেলের সর্বেসবা ছিলেন। কিন্তু আসলে হোটেলের দেখাশোনা করতেন বিজয় বিশ্বাসের স্ত্রী হৈমবতী। বিজয় বিশ্বাস কেবল ঘরে বসে সিগারেট টানতেন। আর হিসেবা-নিকেশ করতেন।

মানেক মেহতা লোকটা ছিল প্রচণ্ড পাজি। অবশ্য তখন তার সম্বন্ধে কেউ কিছু জানত না‌, তাকে ভাল করে কেউ চোখে দেখেনি। পরে সব জানা গেল। তার তিনটে বৌ ছিল‌, একটা গোয়ায়‌, একটা বম্বেতে‌, আর একটা আমেদাবাদে। এই তিন জায়গায় বেশির ভাগ সময় সে থাকত। যত রকম বে-আইনী দুষ্কার্য করাই ছিল তার পেশা। বোম্বাই প্রদেশে মদ্যপান নিষিদ্ধ‌, লোকটি বুটুলেগিং করত। বিদেশ থেকে লুকিয়ে সোনা আমদানি করত। অনেকবার তার মাল বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কিন্তু লোকটাকে কেউ ধরতে পারেনি।

0 Shares