শৈলরহস্য

বিজয় বিশ্বাসের সঙ্গে মানেক মেহতার জেটপাট কি করে হল বলা যায় না। বিজয় বিশ্বাস লোকটি ও রকম ছিলেন না। যতদূর জানা যায়‌, বিজয় বিশ্বাস আগে থেকেই হোটেল চালানোর কাজ জানতেন; হয়তো পুণায় কিম্বা বোম্বাই-এ কিংবা আমেদাবাদে ছোটখাটো হোটেল চালাতেন। তারপর তিনি মানেক মেহতার নজরে পড়ে যান। মানেক মেহতা যে ধরনের ব্যবসা করে তাতে কখনও হাতে অঢেল পয়সা‌, কখনও ভাঁড়ে মা ভবানী। সে বোধ হয় মতলব করেছিল হোটেল কিনে কিছু টাকা আলাদা করে রাখবে‌, যাতে সঙ্কটকালে হাতে একটা রেস্ত থাকে। বিজয় বিশ্বাস তার প্রকৃত চরিত্র জানতেন না‌, সরল মনেই তার অংশীদার হয়েছিলেন।

বিজয় বিশ্বাস আর তাঁর স্ত্রীর ম্যানেজমেণ্টে সহ্যাদ্রি হোটেল অল্পকালের মধ্যেই বেশ জাঁকিয়ে উঠল। মহাবলেশ্বরে হোটেলের মরশুম হচ্ছে আড়াই মাস‌, টেনেন্টুনে তিন মাস। কিন্তু এই কয় মাসের মধ্যেই হোটেলের আয় হয় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা; খরচ-খরচা বাদ দিয়ে বিশ পাঁচিশ হাজার টাকা লাভ থাকে; মানেক মেহতা মরশুমের শেষে এসে কখনও নিজের ভাগের টাকা নিয়ে যেত‌, কখনও বা টাকা ব্যাঙ্কেই জমা থাকত।

সোরাব হোমজি প্রতি বছরই গরমের সময় মহাবলেশ্বরে আসতেন এবং সহ্যাদ্রি হোটেলে উঠতেন। হোটেলটি তাঁর খুব পছন্দ। মনে মনে ইচ্ছে ছিল এই রকম একটি হোটেল পেলে নিজে চালাকেন। তিনি পয়সাওয়ালা লোক‌, জীবিকার জন্য কাজ করবার দরকার নেই। কিন্তু ব্যবসা করার প্রবৃত্তি পাসীদের মজ্জাগত।

গত বছর মে মাসে হোমজি যথারীতি এসেছেন। পুরনো খদের হিসেবে হোটেলে তাঁর খুব খাতির‌, স্বয়ং হৈমবতী তাঁর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের তত্ত্বাবধান করতেন। হোমজিও হৈমবতীর নিপুণ গৃহস্থালীর জন্যে তাঁকে খুব সম্মান করতেন। একদিন হৈমবতী বিমৰ্ষভাবে হোমজিকে বললেন‌, ‘শেঠজি‌, আসছে। বছর আপনি যখন আসবেন তখন আমাদের আর দেখতে পাবেন না।’

হোমজি আশ্চর্য হয়ে বললেন‌, ‘সে কি‌, দেখতে পাব না কেন?’

হৈমবতী বললেন‌, ‘হোটেল বিক্রি করার কথা হচ্ছে। যিনি আমাদের পার্টনার তিনি হোটেল রাখবেন না। আমরাও চলে যাব। আমার স্বামীর এত ঠাণ্ডা সহ্য হচ্ছে না‌, আমরা দেশে ফিরে যাব।’

‘আপনারা নাকি হোটেল বিক্রি করছেন?’

বিজয় বিশ্বাসের বয়স আন্দাজ পায়তাল্লিশ‌, স্ত্রীর চেয়ে অনেক বড়। একটু কাহিল গোছের চেহারা; আপাদমস্তক গরম জামাকাপড় পরে‌, গলায় গলাবন্ধ জড়িয়ে বসে সিগারেট টোনছিলেন‌, হোমজিকে খাতির করে বসলেন। বললেন‌, ‘হ্যাঁ শেঠজি! আপনি কিনবেন?’

হোমজি বললেন‌, ‘ভাল দীর পেলে কিনতে পারি। আপনার পাটনার কোথায়?’ বিশ্বাস বললেন‌, ‘আমার পার্টনার এখন বিদেশে আছেন‌, তাই আমাকে আমমোক্তারনামা দিয়েছেন। এই দেখুন।’ তিনি দেরাজ থেকে পাওয়ার অফ অ্যাটনিবার করে দেখালেন।

তারপর দর-কষাকষি আরম্ভ হল; বিজয় বিশ্বাস হাঁকলেন দেড় লাখ‌, হোমজি বললেন‌, পঞ্চাশ হাজার। শেষ পর্যন্ত চুরাশি হাজারে রফা হল। কিন্তু স্থাবর সম্পত্তি কেনা তো দু’চার দিনের কাজ নয়; দলিল দস্তাবেজ তদারক করা‌, উকিল‌, অ্যাটনির সঙ্গে পরামর্শ করা‌, রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ খবর নেওয়া; এইসব করতে কয়েক মাস কেটে গেল। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি হোমজি আর বিজয় বিশ্বাস পুণায় গেলেন; রেজিস্ট্রারের সামনে হোমজি নগদ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রি করালেন। কথা হল‌, পয়লা ডিসেম্বর তিনি হোটেলের দখল নেবেন। তারপর হোমজি বোম্বাই গেলেন‌, বিজয় বিশ্বাস মহাবলেশ্বরে ফিরে এলেন।

হোটেলে তখন অতিথি নেই‌, একটা চাকরানী ছাড়া চাকরিবোকরও বিদেয় হয়েছে। তাই এরপর যেসব ঘটনা ঘটেছিল‌, তা কেবল হৈমবতীর জবানবন্দী থেকেই জানা যায়। মানেক মেহতা নিশ্চয় নিজে আড়ালে থাকবার মতলব করেই বিজয় বিশ্বাসকে মোক্তারনামা দিয়েছিল। যেদিন কবালা রেজিস্ট্রি হল‌, তার পরদিন রাত্ৰি ন’টার সময় সে সহ্যাত্ৰি হোটেলে এসে হাজির। পরে পুলিশের তদন্তে জানা গিয়েছিল মানেক মেহতা মহাবলেশ্বরের বাইরে দু’মাইল দূরে মোটর রেখে পায়ে হেঁটে মহাবলেশ্বরে ঢুকেছিল।

সে যখন পৌঁছল তখন বিজয় বিশ্বাস আর হৈমবতী রাত্রির খাওয়া-দাওয়া সেরে অফিস-ঘরে বসে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনা করছিলেন। চাকরানীটা শুতে গিয়েছিল। তখন বেশ শীত পড়ে গেছে। মানেক মেহতার গায়ে মোটা ওভারকোট‌, মাথায় পশমের মঙ্কি-ক্যাপ। তার ব্যবহার বরাবরই খুব মিষ্টি। সে এসে বলল‌, ‘হৈমাবেন‌, আমি আজ রাত্রে এখানেই থাকিব‌, আর খাব। সামান্য কিছু হলেই চলবে।’

হৈমবতী খাবারের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে চলে গেলেন‌, চাকরানীকে আর জাগালেন না। মানেক মেহতা আর বিজয় বিশ্বাস কাজকর্মের কথা শুরু করলেন। অফিস-ঘরে একটা মজবুত লোহার সিন্দুক ছিল‌, হোটেল বিক্রির টাকা এবং ব্যাঙ্কের জমা টাকা‌, সব এই সিন্দুকেই রাখা হয়েছিল। বিজয় বিশ্বাস জানতেন দু’এক দিনের মধ্যেই মেহতা টাকা নিতে আসবে।

হৈমবতী রান্নাঘরে গিয়ে স্টেভ জ্বেলে ভাজাভুজি তৈরি করতে লাগলেন‌, কিন্তু তাঁর কান পড়ে রইল অফিস-ঘরের দিকে। রান্নাঘর অফিস-ঘর থেকে বেশি দূর নয়‌, তার ওপর নিস্তব্ধ রাত্ৰি। কিছুক্ষণ পরে তিনি শুনতে পেলেন‌, ওঁরা দু’জন অফিস-ঘর থেকে বেরিয়ে কথা বলতে বলতে হোটেলের পিছন দিকের জমিতে চলে গেলেন। হৈমবতীর একটু আশ্চর্য লাগল; কারণ তাঁর স্বামী শীত-কাতুরে মানুষ‌, এত শীতে খোলা হাওয়ায় যাওয়া তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু হৈমবতীর মনে কোনও আশঙ্কাই ছিল না‌, তিনি রান্নাঘর থেকে বেরুলেন না‌, যেমন রান্না করছিলেন করতে লাগলেন।

0 Shares