শৈলরহস্য

তারপর হোটেলের পিছন দিক থেকে একটা চাপা চীৎকারের শব্দ শুনে তিনি একেবারে কাঠ হয়ে গেলেন। তাঁর স্বামীর গলার চীৎকার। ক্ষণকাল স্তম্ভিত অবস্থায় থেকে তিনি ছুটে গেলেন হোটেলের পিছন দিকে। পিছনের জমিতে যাবার একটা দরজা আছে‌, হৈমবতী দরজার কাছে পৌঁচেছেন‌, এমন সময় মানেক মেহতা। ওদিক থেকে ঝড়ের মত এসে ঢুকল। হৈমন্বতীকে সজোরে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে সদরের দিকে চলে গেল।

‘কি হল! কি হল!’ বলে হৈমবতী পিছনের জমিতে ছুটে গেলেন। সেখানে কেউ নেই। হৈমবতী তখন স্বামীর খোঁজে অফিস-ঘরের দিকে ছুটলেন। সেখানে দেখলেন লোহার সিন্দুকের কবাট খোলা রয়েছে‌, তার ভিতর থেকে নোটের বাণ্ডিল সব অন্তর্হিত হয়েছে। প্ৰায় দেড় লাখ টাকার নোট।

এতক্ষণে হৈমবতী প্রকৃত ব্যাপার বুঝতে পারলেন; মানেক মেহতা তাঁর স্বামীকে ঠেলে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আর সমস্ত টাকা নিয়ে পালিয়েছে! তিনি চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।–

ভাই অজিত‌, আজ এইখানেই থামতে হল। ঘরের মধ্যে অশরীরীর উৎপাত আরম্ভ হয়েছে। কাল বাকি চিঠি শেষ করব।

৪ঠা জানুয়ারি। কাল চিঠি শেষ করতে পারিনি‌, আজ রাত্রি দশটার পর মোমবাতি জ্বলিয়ে আবার আরম্ভ করেছি। হোমজি খেতে বসে গল্প বলছিলেন। গল্প শেষ হবার আগেই খাওয়া শেষ হল‌, আমরা বসবার ঘরে উঠে গেলাম। চাকর কফি দিয়ে গেল।

হোমজি আবার বলতে শুরু করলেন। আমি আজ আরও সংক্ষেপে তার পুনরাবৃত্তি করছি।–

হৈমাবতীর যখন জ্ঞান হল তখন দশটা বেজে গেছে‌, ইলেকট্রিক বাতি নিভে গিয়ে চারিদিক অন্ধকার‌্‌, হৈমবতী চাকরানীকে জাগালেন‌, কিন্তু সে রাত্রে বাইরে থেকে কোনও সাহায্যই পাওয়া গেল না। পুলিস এল পরদিন সকালে।

পুলিসের অনুসন্ধানে বোঝা গেল হৈমবতীর অনুমান ঠিক। হোটেলের পিছনে খাদের ধারে মানুষের ধস্তাধস্তির চিহ্ন রয়েছে। দুচার দিন অনুসন্ধান চালাবার পর আরও অনেক খবর বেরুল। মানেক মেহতা ডুব মেরেছে। সে পাকিস্তান থেকে তিন লক্ষ টাকার সোনা আমদানি করেছিল‌, কাস্টমসের কাছে ধরা পড়ে যায়। মানেক মেহতা ধরা না পড়লেও একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। তাই অংশীদারকে খুন করে সে প্রায় দেড় লাখ টাকা হাতিয়েছে।

এদিকে খাদের তলা থেকে বিজয় বিশ্বাসের লাশ উদ্ধার করা দরকার। কিন্তু এমন দুৰ্গম এই খাদ্য যে‌, সেখানে পৌঁছুনো অতি কষ্টকর ব্যাপার। উপরন্তু সম্প্রতি একজোড়া বাঘ এসে খাদের মধ্যে আডা গেড়েছে। গভীর রাত্রে তাদের হকার শোনা যায়। যাহোক‌, কয়েকজন পাহাড়ীকে নিয়ে তিনদিন পরে পুলিস খাদে নেমে দেখল বিজয় বিশ্বাসের দেহের বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই; কয়েকটা হাড়গোড় আর রক্তমাখা কাপড়জামা‌, গলাবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে তারা ফিরে এল। পুলিসের মনে আর কোনও সংশয় রইল না‌, মানেক মেহতার নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা এবং হুলিয়া জারি করল।

ক্রমে ১লা ডিসেম্বর এসে পড়ল। নিঃস্ব বিধবার অবস্থা বুঝতেই পারছে। হোমজি দয়ালু। লোক‌, হৈমবতীকে কিছু টাকা দিলেন। হৈমবতী চোখের জল মুছতে মুছতে মহাবলেশ্বর থেকে চিরবিদায় নিলেন।

তারপর মাসখানেক কেটে গেছে। পুলিস এখনও মানেক মেহতার সন্ধান পায়নি। বাঘ আর বাঘিনী। কিন্তু এখনও খাদের তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষের রক্তের স্বাদ তারা পেয়েছে‌, এ স্থান ছেড়ে যেতে পারছে না।

হোমজির গল্প শুনে মনটা একটু খারাপ হল। বাঙালীর সন্তান সুদূর বিদেশে এসে কিছু অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন‌, তা কপালে সইল না। হৈমবতীর অবস্থা আরও শোচনীয়। মানেক মেহতাকে পুলিস ধরতে পারবে কিনা কে জানে; ভারতবর্ষের বিশাল জনসমুদ্র থেকে একটি পুঁটিমাছকে ধরা সহজ নয়।

এই সব ভাবছি। এমন সময় ইলেকট্রিক বাতি নিভে গেল। বললাম‌, ‘এ কি?’

হোমজি বললেন‌, ‘দশটা বেজেছে। এখানে রাত্রি দশটার সময় ইলেকট্রিক বন্ধ হয়ে যায়‌, আবার শেষ রাত্রে কিছুক্ষণের জন্যে জ্বলে!-চলুন‌, আপনাকে আপনার শোবার ঘরে পৌঁছে দিই।‘

হোমিজির একটা লম্বা গদার মত ইলেকট্রিক টর্চ আছে‌, সেটা হাতে নিয়ে তিনি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। দোতলায় এক সারি ঘর‌, সামনে টানা বারান্দা। সব ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে‌, কেবল কোণের ঘরের দরজা খোলা। চাকর ঘরে মোমবাতি জ্বেলে রেখে গেছে। (ভাল কথা‌, এদেশে মোমবাতিকে মেমবাতি বলে; ভারি কবিত্রপূর্ণ নাম‌, নয়?)

বেশ বড় ঘর; সামনে বারান্দা‌, পাশে ব্যালকনি। ঘরের দু’পাশে দু’টো খোট রয়েছে; একটাতে বিছানা পাতা‌, অন্যটা উলঙ্গ পড়ে আছে। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল আর দু’টো চেয়ার‌, দেয়ালের গায়ে ঠেকানো ওয়ার্ডরোব। টেবিলের উপর একটি অ্যালার্ম টাইমপীস। এক বাণ্ডিল মোমবাতি‌, দেশলাই‌, একটা থার্মোফ্লাক্সে গরম কফি; রাত্রে যদি তেষ্টা পায়‌, খাব। হোমজি অতিথি সৎকারের ক্রটি রাখেননি।

হোমজি বললেন‌, ‘এই ঘরে বিজয় বিশ্বাস স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। হৈমবতী চলে যাবার পর ঘরটা যেমন ছিল তেমনি আছে। আপনার কোনও অসুবিধে হবে না তো?’

বললাম‌, অসুবিধে কিসের। খুব আরামে থাকব। আপনি যান‌, এবার শুয়ে পড়ুন গিয়ে। এখানে বোধ হয় সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়াই রেওয়াজ।’

হোমজি হেসে বললেন‌, ‘শীতকালে তাই বটে। কিন্তু সকাল আটটা ন’টার আগে কেউ বিছানা ছাড়ে না। আপনি যদি আগে উঠতে চান‌, ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখবেন। এই টৰ্চটা রাখুন‌, রাত্রে যদি দরকার হয়।’

‘ধন্যবাদ।’

হোমজি নেমে গেলেন। আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। মোমবাতির আলোয় ঘরটা অবছায়া দেখাচ্ছে। আমি টর্চটা জ্বলিয়ে ঘরময় একবার ঘুরে বেড়ালাম। আমার সুটকেস চাকর ওয়ার্ডরোবের পাশে রেখে গেছে। ওয়ার্ডরোব খুলে দেখলাম সেটা খালি। এসেন্স-কপুর-ন্যাপথলিন মেশা একটা গন্ধ নাকে এল। হৈমবতী এই ওয়ার্ডরোবেই নিজের কাপড়-চোপড় রাখতেন। ঘরের পিছন দিকে একটা সরু দরজা রয়েছে‌, খুলে দেখলাম গোসলখানা। আবার বন্ধ করে দিলাম। তারপর চেয়ারে এসে বসে সিগারেট ধরলাম।

0 Shares