শৈলরহস্য

ঘরের দরজা-জানোলা সবই বন্ধ‌, তবু যেন একটা বরফজমানো ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশিক্ষণ বসে থাকা চলবে না; তাড়াতাড়ি সিগারেট শেষ করে ঘড়িতে অ্যালাম দিলাম‌, সাড়ে সাতটার সময় ঘুম ভাঙলেই যথেষ্ট। আপ্টে আসবেন নাটার সময়।

টািৰ্চটা বালিশের পাশে নিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে বিছানায় ঢুকলাম। বিছানায় দুটো মোটা মোটা গদি‌, গোটা চারেক বিলিতি কম্বল; একেবারে রাজশয্যা। ক্রমশ কম্বলের মধ্যে শরীর গরম হতে লাগল। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।

আশ্চর্য এই যে‌, প্রথম রাত্রে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত অতিপ্ৰাকৃত কোনও ইশারা-ইঙ্গিত পাইনি।

ঘুম ভাঙল ঝনঝনি অ্যালামের শব্দে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম।। ঘর অন্ধকার; কোথায় আছি মনে করতে কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। তারপর মনে পড়ল। কিন্তু–এত শীগগির সাড়ে সাতটা বেজে গেল! কৈ জানালার শার্সি দিয়ে দিনের আলো দেখা যাচ্ছে না। তো!

টর্চ জ্বেলে ঘড়ির উপর আলো ফেললাম। চোখে ঘুমের জড়তা রয়েছে‌, মনে হল ঘড়িতে দুটো বেজেছে। কিন্তু অ্যালার্ম ঝনঝন শব্দে বেজে চলেছে।

কি রকম হল! আমি কম্বল ছেড়ে উঠলাম‌, টেবিলের কাছে গিয়ে ঘড়ির উপর আলো ফেলে দেখলাম-সত্যি দুটো। তবে অ্যালার্ম বাজল কি করে? অ্যালার্মের কাঁটা ঘোরাতে কি ভুল করেছি?

ঘড়িটা হাতে তুলে নিতেই বাজনা থেমে গেল। দেখলাম অ্যালার্মের কাঁটা ঠিকই সাড়ে সাতটার উপর আছে।

হয়তো ঘড়িটাতে গলদ আছে‌, অসময়ে অ্যালার্ম বাজে। আমি ঘড়ি রেখে আবার বিছানায় ঢুকলাম। অনেকক্ষণ ঘুম এল না। তারপর আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

এই হল প্রথম রাত্রির ঘটনা।

পরদিন সকালে ব্রেকফার্স্ট খেতে বসে হোমজিকে জিগ্যেস করলাম‌, ‘আপনার টাইমপীসে কি অসময়ে অ্যালাম বাজে?’

তিনি ভুরু তুলে বলেন‌, ‘কৈ না! কেন বলুন তো?’

বললাম। তিনি শুনে উদ্বিগ্ন মুখে একটু চুপ করে রইলেন; তারপর বললেন‌, ‘হয়তো সম্প্রতি খারাপ হয়েছে। আমার অন্য একটা অ্যালাম ঘড়ি আছে‌, সেটা আজ রাত্রে আপনাকে দেব।’

আমি আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম‌, এমন সময় চাকর একটি চিঠি এনে আমার হাতে দিল।

আপ্টের চিঠি। তিনি লিখেছেন‌, কাল রাত্রে হঠাৎ পা পিছলে গিয়ে তাঁর পায়ের গোছ মাচুকে গেছে‌, নড়ার ক্ষমতা নেই; আমরা যদি দয়া করে আসি।

চিঠি হোমজিকে দেখলাম। তিনি মুখে চুকচুক শব্দ করে বলেন‌, ‘চলুন‌, দেখে আসি।’

জিগ্যেস করলাম‌, ‘কতদূর?’

‘মাইল দুই হবে। বাজারের মধ্যে। এখানে মহারাষ্ট্র ব্যাঙ্কের একটা ব্ৰাঞ্চ আছে‌, আপ্টের আত্মীয় তার ম্যানেজার। ব্যাঙ্কের উপরতলায় থাকেন।’

ব্রেকফার্স্ট সেরে বেরুলাম। হোমজির একটি ছোটখাটো স্ট্যান্ডার্ড মোটর আছে‌, তাইতে চড়ে গেলাম; ব্যাঙ্কের বাড়িটা দোতলা‌, বাড়ির পাশ থেকে খোলা সিঁড়ি ওপরে উঠেছে। আমরা ওপরে উঠে গেলাম।

আপ্টে বালিশের ওপর ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা পা তুলে দিয়ে খাটে শুয়ে আছেন‌, আমাদের দেখে দুহাত বাড়িয়ে বললেন‌, ‘কী কাণ্ড দেখুন দেখি! কোথায় আপনাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ােব‌, তা নয় একেবারে শয্যাশায়ী।’

আমার খাটের পাশে চেয়ার বসলাম, ‘কি হয়েছিল?’

আপ্টে বললেন‌, ‘রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনলাম‌, দরজায় কে খুটুখুটু করে টোকা মারছে। বিছানা ছেড়ে উঠলাম‌, কিন্তু দোর খুলে দেখি কেউ নেই। আবার দোর বন্ধ করে ফিরছি‌, পা মুচড়ে পড়ে গেলাম। বাঁ পা-টা স্তেপ্রন হয়ে গেল।’

‘আর কোথাও লাগেনি তো?’

‘না‌, আর কোথাও লাগেনি। কিন্তু–’ আপ্টে একটু চুপ করে থেকে বললেন‌, ‘আশ্চর্য! আমি ইিঞ্জাইন‌, পায়ে কাপড়ও জড়িয়ে যায়নি। ঠিক মনে হল কেউ আমাকে পিছন থেকে ঠেলে দিলে।’

আমার কি মনে হল‌, জিগ্যেস করলাম‌, ‘রাত্রি তখন কটা?’

‘ঠিক দুটো।’

এ বিষয়ে আর কথা হল না‌, গৃহস্বামী এসে পড়লেন। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হলেও অনস্তারাও দেশপাণ্ডে বেশ ফুর্তিবাজ লোক। আজকাল ব্যাঙ্কের কাজকর্ম নেই বললেই হয়। তিনি আমাদের সঙ্গে আড্ডা জমালেন। আপ্টের পা ভাঙা নিয়ে খানিকটা ঠাট্টা-তামাশা হল‌, গরম গরম চিড়েভাজা আর পেট্যাটো-চিপস দিয়ে আর এক প্রস্থ কফি হল। তারপর আমরা উঠলাম। আন্টে কাতরভাবে বললেন‌, ‘ভেবেছিলাম মিস্টার বক্সীকে মহাবলেশ্বর ঘুরিয়ে দেখোব‌, তা আর হল না। দুতিন দিন মাটিতে পা রাখতেই পারব না।’

হোমজি বললেন‌, ‘তাতে কি হয়েছে‌, আমি ওঁকে মহাবলেশ্বর দেখিয়ে দেব। আমার তো এখন ছুটি।’

কাল আবার আসব বলে আমরা চলে এলাম। দুপুরবেলা লাঞ্চ খেয়ে হোমজির সঙ্গে বেরুলাম। কাছাকাছি। কয়েকটা দর্শনীয় স্থান আছে। একটি হ্রদ আছে‌, তাতে মোটর-লিঞ্চ চড়ে বেড়ালাম। মহাবলেশ্বরের মধু বিখ্যাত‌, কয়েকটি মধুর কারখানা দেখলাম; মৌমাছি মধু তৈরি করছে আর মানুষ তাই বিক্রি করে পয়সা রোজগার করছে। মৌমাছিদের খেতে দিতে হয় না‌, মজুরি দিতে হয় না‌, একটি ফুলের বাগান থাকলেই হল।

কিন্তু যাক‌, বাজে কথা লিখে চিঠি বড় করব না। এখনও আসল কথা সবই বাকি। হোমজির কাছ থেকে একটা চিঠির প্যাড় যোগাড় করেছি‌, তা প্রায় ফুরিয়ে এল।

সে রাত্রে দশটা বাজবার পাঁচ মিনিট আগে শুতে গেলাম। চাকর সব ঠিকঠাক করে রেখে গিয়েছে। দেখলাম পুরনো ঘড়ির বদলে একটা নতুন অ্যালার্ম ঘড়ি রেখে গেছে। আমি এতে আর দম দিলাম না‌, অ্যালার্মের চাবিটা এঁটে বন্ধ করে দিলাম। অ্যালামের দরকার নেই‌, যখন ঘুম ভাঙবে তখন উঠব।

আলো নেভার আগেই শুয়ে পড়লাম।

এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি‌, শুয়ে শুয়ে দেখছি। একটা চামচিকে ঘরে ঢুকেছে। দরজা-জানালা সব বন্ধ‌, তাই পালাতে পারেছ না‌, নিঃশব্দ পাখায় ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণে যাচ্ছে‌, আবার ফিরে আসছে। দরজা খুলে তাকে তাড়ানো যায়। কিনা ভাবছি‌, এমন সময় ইলেকট্রিক বাতি নিভে গেল। আর উপায় নেই। জন্তুটা সারারাত্রি পালাবার রাস্তা খুঁজে উড়ে বেড়াবে‌, হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকবে।–

0 Shares