শৈলরহস্য

অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে ভাবছি‌, ঘুম আসছে না। কাল রাত্রি দুটোর সময় আমার ঘরে অকারণে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজল‌, আর ঠিক সেই সময় দু’মাইল দূরে আপ্টের পা মচুকালো‌, দুটো ঘটনার মধ্যে নৈসৰ্গিক সম্পর্ক কিছুই নেই। সমাপতন ছাড়া আর কি হতে পারে? অথচ‌, আপ্টের পা যদি না মাচকাতো‌, তিনি আজ এই ঘরে অন্য খাটে শুতেন। —চামচিকেটা কি এখনও উড়ে বেড়াচ্ছে? আমার গায়ে এসে পড়বে না তো! পড়ে পড়ুক। ইতর প্রাণীকে আমার ভয় নেই। সত্যবতী।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম‌, ক্যানের কাছে কড় কড় শব্দে কাড়ানাকাড়া বেজে উঠল। কম্বলের মধ্যে লাফিয়ে উঠলাম। নতুন ঘড়ির অ্যালাম বাজছে। এর আওয়াজ আরও উগ্র। কিন্তু অ্যালার্ম বাজার তো কথা নয়‌, আমি দম দিইনি‌, চাবি বন্ধ করে দিয়েছি। তবে?

টর্চ জ্বেলে বিছানা থেকে উঠলাম। ঘড়িতে দুটো বেজেছে। (অ্যালার্মের চাবি যেমন বন্ধ ছিল তেমনি বন্ধ‌, তবু বাজনা বেজে চলেছে। )

ঘড়ি হাতে তুলে নিতেই বাজনা থেমে গেল। যেমন ঘড়ি তেমনি ঘড়ি‌, অত্যন্ত সহজ এবং স্বভাবিক।

অজিত‌, তুমি জানো‌, আমি রহস্য ভালবাসি না; রহস্য দেখলেই আমার মন তাকে ভেঙে চুরে তার অন্তনিহিত সত্যটি আবিষ্কার করতে লেগে যায়। কিন্তু এ কী রকম রহস্য? অলৌকিক ঘটনার প্রতি আমার বুদ্ধি স্বভাবতাই বিমুখ‌, যা প্রমাণ কথা যায় না তা বিশ্বাস করতে আমার বিবেকে বাধে। কিন্তু এ কী? চক্ষু কৰ্ণ দিয়ে যাকে প্রত্যক্ষ করছি তার সঙ্গে ঐহিক কিছুরই কোনও সংস্রব নেই। অমূলক কারণহীন ঘটনা চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে।

এর মূল পর্যন্ত অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। মোমবাতি জ্বাললাম। তোমাকে আগে লিখেছি ঘরে দুটো চেয়ার আছে। তার মধ্যে একটা সাধারণ খাড়া চেয়ার‌, অন্যটা দোলনা চেয়ার। আমি গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে নিয়ে দোলনা চেয়ারে বসলাম, সিগারেট ধরিয়ে মৃদু মৃদু দোল খেতে লাগলাম।

দোরের দিকে মুখ করে বসেছি। ডান পাশে টেবিল‌, বাঁ পাশে দেয়ালে লাগানো ওয়ার্ডরোবি‌, পিছনে আমার খাট। আমি সিগারেট টানতে টানতে দুলছি আর ভাবছি। চামচিকেটা কোথায় ছিল জানি না‌, বাতি জ্বলতে দেখে আবার উড়তে আরম্ভ করেছে; আমার মাথা ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। পাখার শব্দ নেই‌, কেবল এক টুকরো জমাট অন্ধকার শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সিগারেট শেষ করে চোখ বুজে আছি‌, ভাবছি কী হতে পারে? দু’টো ঘড়িতেই বেতালা অ্যালাম বাজে? তবে কি হোমজি আমার সঙ্গে practical joke করছেন। আমি কাল ভূতের কথায় হেসেছিলাম‌, তাই তিনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। তা যদি হয় তাহলে ঘড়িটার যন্ত্রপাতি খুলে পরীক্ষা করলেই ধরা যাবে। কিন্তু হোমজি বয়স্থ ব্যক্তি‌, এমন বাঁদুরে রসিকতা করবেন?

কতক্ষণ চোখ বুজে বসে দোল খাচ্ছিলাম বলতে পারি না‌, মিনিট পনরোর বেশি নয়; চোখ খুলে চমকে গেলাম। দোলনা চেয়ারটা দুলতে দুলতে ঘুরে গেছে; আমি দরজার দিকে মুখ করে বসেছিলাম‌, এখন ওয়ার্ডরোবের দিকে মুখ করে বসে আছি। শুধু তাই নয়‌, ওয়ার্ডরোবের খুব থাছে এসে পড়েছি।

চেয়ার ঘুরে যাওয়ার একটা স্বাভাবিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু রাত দু’টোরু সময় একলা ঘরে এরকম ব্যাপার ঘটলে স্নায়ুমণ্ডলে ধাক্কা লাগে। আমারও লেগেছিল। তার ওপর ঘড়িটা আবার পিছন দিক থেকে ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল। আমি লাফিয়ে উঠে ঘড়িটা বন্ধ করতে গেলাম‌, মোমবাতি নিভে গেল।

বোঝে ব্যাপার। আমার স্নায়ু যদি দুর্বল হত‌, তাহলে কি করতাম বলা যায় না। কিন্তু আমি দেহটাকে শক্ত করে স্বায়ুর উৎকণ্ঠা‌, দমন করলাম। আমার গায়ের কম্বলের বাতাস লেগে হয়তো মোমবাতি নিভেছে। আমি আবার মোমবাতি জ্বাললাম। ঘড়িটা হাতে নিতেই তার বাজনা থেমে গেল।

কিন্তু ঘড়িকে আর বিশ্বাস নেই। আমি সেটাকে হাতে নিয়ে ওয়ার্ডরোবের কাছে গেলাম। ওয়ার্ডরোবে আমার কাপড়-চোপড় রেখেছি‌, তার মধ্যে ঘড়ি চাপা দিয়ে রাখব। তারপর ঘড়ি যত বাজে বাজুক।

ওয়ার্ডরোবের কপাট খুলতেই সেন্ট-কপুর-ন্যাপথলিন মেশা গন্ধটা নাকে এল। আমি ঘড়িটাকে আমার জামা-কাপড়ের তলায় গুজে দিয়ে কপাট বন্ধ করে দিলাম।

আড়াইটে বেজেছে‌, এখনও অর্ধেক রাত বাকি। আমি আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

মস্তিষ্ক গরম হয়েছে; তন্দ্ৰা আসছে‌, আবার ছুটে যাচ্ছে। ঘড়িটা ওআর্ডরোবের মধ্যে বাজছে কিনা শুনতে পাচ্ছি না। তারপর ক্রমে বোধ হয় ঘুম এসে গিয়েছিল। —

বিকট চীৎকার করে জেগে উঠলাম। কম্বলের মধ্যে আমার পেটের কাছে একটা কিছু কিলবিল করছে। টিকটিকি কিংবা ব্যাঙ কিংবা চামচিকে। একটানে কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে নোমলাম; টর্চ জ্বাললাম‌, মোমবাতি জ্বাললাম। বিছানায় কোনও জন্তু-জানোয়ার নেই। চামচিকেটাও কোথায় অদৃশ্য হয়েছে। হাতঘড়িতে দেখলাম রাত্রি সাড়ে তিনটে।

বাকি রাত্রিটা টেবিলের সামনের খাড়া চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলাম। আর ঘমোবার চেষ্টা বৃথা।

চিঠি ভীষণ লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ভৌতিক অভিজ্ঞতার ব্বিরণ দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। এবার চটপট শেষ করব।

পাঁচটার সময় ইলেকট্রিক আলো জ্বলে উঠলো।

আমি ওয়ার্ডরোব খুলে ঘড়ি বার করলাম। ঘড়ির সঙ্গে একটা বাদামী কাগজের চিলতে বেরিয়ে এল। তাতে বাংলা হরফে একটা ঠিকানা লেখা আছে। কলকাতার দক্ষিণ সীমানার একটা ঠিকানা। ঠিকানাটা নকল করে পাঠালাম‌, তোমার দরকার হবে।

আমার স্কাউট-ছুরি দিয়ে ঘড়িটা খুললাম‌্‌, যন্ত্রপাতির কোনও গণ্ডগোল নেই। সহজ ঘড়ি।

আমি সত্যান্বেষী। সত্যকে স্বীকার করতে আমি বাধ্য‌, তা সে লৌকিক সত্যই হোক‌, আর অলৌকিক সত্যই হোক। কায়াহীনকে সম্বোধন করে বললাম‌, ‘তুমি কী চাও?’

0 Shares