উত্তর এলো না, কেবল টেবিলটা নড়ে উঠল। আমি টেবিলের ওপর হাত রেখে বসেছিলাম।
বললাম, ‘তুমি কি চীও আমি তোমার মৃত্যুর তদন্তু করি?’
এবার টেবিল তো নড়লই, আমি যে চেয়ারে বসেছিলাম তার পিছনে পায়াদুটো উঁচু হয়ে উঠল; আমি প্রায় টেবিলের ওপর হুমাড়ি খেয়ে পড়লাম।
বললাম, ‘বুঝেছি। কিন্তু পুলিস তো তদন্ত করছেই! আমি করলে কী সুবিধে হবে? আমি কোথায় তদন্ত করব?’
ঘড়িটি চড়াং করে একবার বেজেই থেমে গেল! ঠিকানা লেখা বাদামী কাগজের চিলতেটা টেবিলের একপাশে রাখা ছিল, সেটা যেন হাওয়া লেগে আমার সামনে সরে এল।
আমার মাথায় একটু আইডিয়া এল; মানেক মেহতা কি বাংলাদেশে গিয়ে লুকিয়ে আছে ? আশ্চর্য নয়। একলা লুকিয়ে আছে? কিংবা–
বললাম, ‘হুঁ, আচ্ছা, চেষ্টা করব।‘
এই সময় ইলেক্ট্রিক বাতি নিভে গেল; দেখলাম জানালায় শার্সি দিয়ে দিনের আলো দেখা যাচ্ছে।
হোমাজিকে কিছু বললাম না। ন’টার সময় দুজনে আপ্টেকে দেখতে গেলাম। মোটরে যেতে যেতে হোমাজিকে জিগ্যেস করলাম, ‘হৈমাবতীর চেহারা কেমন?’
হোমজি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে একটু হাসলেন, বললেন, ‘ভাল চেহারা। রঙ খুব ফরাসা নয়, কিন্তু ভারি চটকদার চেহারা।‘
‘বয়স?’
‘হয়তে ত্রিশের কিছু বেশি; কিন্তু দীৰ্ঘযৌবনা, শরীরের বাঁধুনি ছিলে হয়নি।’—
আপ্টের পা কালকের চেয়ে ভাল, কিন্তু এখনও হাঁটতে পারেন না। গৃহস্বামী অনন্তরাও দেশপাণ্ডের সঙ্গেও দেখা হল । তাঁকে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম।–
‘অপনি বিজয় বিশ্বাসকে চিনতেন ?’
‘চিনতাম বৈকি! সহ্যাদ্রি হোটেলের সব টাকাই আমার ব্যাঙ্কে ছিল!’
‘কত টাকা?’
‘সীজনের শেষে প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার দাঁড়িয়েছিল।’
‘বিজয় বিশ্বাসের নিজের আলাদা কোনও অ্যাকাউন্ট ছিল?’
‘ছিল। আন্দাজ দু’হাজার টাকা। কিন্তু মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি প্রায় সব টাকা বার করে নিয়েছিলেন। শখানেক টাকা পড়ে আছে।’
‘তাঁর স্ত্রী যাবার আগে সে টাকা বার করে নেননি?’
‘স্ত্রী যতক্ষণ কোর্ট থেকে ওয়ারিশ সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততক্ষণ তো তাঁকে টাকা দিতে পারি না।’
‘হৈমন্ধতী এখন কোথায়? তাঁর ঠিকানা জানেন?’
‘না।’
‘আর কেউ জানে?’
হোমজি বললেন, ‘বোধ হয় না। যাবার সময় তিনি নিজেই জানতেন না কোথায় যাবেন।’
আমি আপ্টেকে জিগ্যেস করলাম, ‘আপনি নিশ্চয় এ মামলার খবর রাখেন। মানেক মেহতার কোনও সন্ধান পাওয়া গেছে?’
তিনি বললেন, ‘না। সন্ধান পাওয়া গেলে আমি জানতে পারতাম।’
‘মানেক মেহতার ফটোগ্ৰাফ আছে?’
‘একটা গ্রুপ-ফটোগ্রাফ ছিল। সহ্যাদ্রি হোটেল যখন আরম্ভ হয় তখন মানেক মেহতা, বিজয় বিশ্বাস আর হৈমবতী একসঙ্গে ছবি তুলিয়েছিল। কিন্তু সেটা পাওয়া যায়নি।’
হোটেলে ফিরে এসে দুপুরবেলা খুব ঘুমোলাম । রাত্রে তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছিলাম, কিন্তু বার বার বাধা পেয়ে শেষ করতে পারিনি। বিদেহাত্মা আমার এই চিঠি লেখাতে সস্তুষ্ট নয়, অথচ সে কী চায় বোঝাতে পারছে না। যাহোক, আজ চিঠি শেষ করব।
এতখানি ভণিতার কারণ বোধ হয় বুঝতে পেরেছ। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। কলকাতার দক্ষিণ প্রাস্তের যে ঠিকানা দিলাম তুমি সেখানে যাবে। যদি সেখানে হৈমবতী বিশ্বাসের দেখা না পাও তাহলে কিছু করবার নেই। কিন্তু যদি দেখা পাও, তাহলে তাঁকে কয়েকটা প্রশ্ন করবে; মানেক মেহতার সঙ্গে তাঁদের যে গ্রুপ-ফটো তোলা হয়েছিল সেটা কোথায়? মানেক মেহতার সঙ্গে হৈমবতীর বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিনা জানিবার চেষ্টা করবে। কবে কোথায় বিশ্বাসদের সঙ্গে মেহতার পরিচয় হয়েছিল? হৈমবতীর আর্থিক অবস্থা এখন কেমন? বাড়িতে কে কে আছে—সব খবর নেবে। যে প্রশ্নই তোমার মনে আসুক জিগ্যেস করবে। তারপর সব কথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাকে লিখে জানাবে; কোনও কথা তুচ্ছ বলে বাদ দেবে না। যদি সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে টেলিগ্রাম করে আমাকে জানাবে।
তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকব। এখানে এই দারুণ শীতে বেশিদিন থাকার ইচ্ছে নেই, কিন্তু এ ব্যাপারের নিম্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যেতেও পারছি না।
আশা করি খোকা ও সত্যবতী ভাল আছে এবং তুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা ঝেড়ে ফেলে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছ।
ভালবাসা নিও।
–তোমার ব্যোমকেশ
২
কলিকাতা
৮ই জানুআরি
ভাই ব্যোমকেশ
তোমার চিঠি আজ সকালে পেয়েছি, এবং রাত্রে বসে জবাব লিখছি। হায় নাস্তিক, তুমি শেষে ভূতের খপ্পরে পড়ে গেলে। সত্যবতী জানতে চাইছে, ভূত বটে তো? পেত্নী নয়? ওদিকের পেত্নীরা নাকি ভারি জাঁহাবাজ হয়।
যাক, বাজে কথা লিখে পুঁথি বাড়ব না। তোমার নির্দেশ অনুযায়ী আজ বেলা তিনটে নাগাদ বাসা থেকে বেরুচ্ছি, বিকাশ দত্ত এল। আমি কোথায় যাচ্ছি শুনে সে বলল, ‘আরো সর্বনাশ, সে যে ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুর। পথ চিনে যেতে পারবেন?
কলাম, তুমি চল না।’ বিকাশ রাজী হল। তাকে সব বললাম না, মোটামুটি একটা আন্দাজ দিলাম।
দু’জনে চললাম। সত্যি ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুর। ট্রামে বাসে কলকাতার দক্ষিণ সীমানা ছাড়িয়ে যেখানে গিয়ে পৌঁছুলাম সেখানে কেবল একটি লম্বা রাস্তা চলে গিয়েছে। রাস্তায় দু’তিন শো গজ অস্তর একটা বাড়ি। শেষ পর্যন্ত বেলা আন্দাজ সাড়ে চারটের সময় নির্দিষ্ট ঠিকানায় উপস্থিত হলাম। রাস্তা থেকে খানিক পিছিয়ে ছোট একতলা বাড়ি; চারিদিকে খোলা মাঠ। বিকাশকে বললাম, ‘তুমি রাস্তার ধারে গাছতলায় বসে বিড়ি খাও। আমি এখনি ফিরতে পারি, আবার ঘণ্টাখানেক দেরি হতে পারে।’
বাড়ির সদর দরজা বন্ধ, আমি গিয়ে কড়া নাড়লাম। একটা চাকর এসে দরজা খুলে দাঁড়াল। বলল, ‘কাকে চান?’