শৈলরহস্য

বললাম‌, ‘শ্ৰীমতী হৈমবতী বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘আপনার নাম?’

‘অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।’

‘কী দরকার? ‘সেটা শ্ৰীমতী বিশ্বাসকেই বলব। তুমি তাঁকে বলো মহাবলেশ্বর থেকে চিঠি পেয়ে এসেছি।’

‘আজ্ঞে। একটু দাঁড়ান।’ বলে চাকরিটা দরজা বন্ধ করে দিল।

দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি; সাড়াশব্দ নেই। তারপর দরজা খুলল। চাকরিটা বলল‌, ‘আসুন।’

বাড়িতে ঢুকেই ঘর। আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই‌, দু’টো চেয়ার‌, একটা টেবিল। চাকর বলল‌, ‘আজ্ঞে বসুন। গিন্নী ঠাকরুন চান করছেন‌, এখনি আসবেন।’

একটা চেয়ারে বসলাম। বসে আছি তো বসেই আছি। চাকরটা এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করছে‌, বোধহয় আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আজকাল কলকাতার যা ব্যাপার দাঁড়িয়েছে‌, অচেনা লোককে বাড়িতে ঢুকতে দিতে ভয় হয়। চোর-ডাকাত-গুণ্ডা যা-কিছু হতে পারে।

বসে বসে ভাবলাম‌, গিন্নী ঠাকরুনের স্নান যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ চাকরিটাকে নিয়েই একটু নাড়াচাড়া করি। বললাম‌, ‘তুমি কতদিন এখানে কাজ করছ?’

চাকরটা অন্দরের দোরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল‌, ‘আজ্ঞে‌, এই তো একমাসও এখনও হয়নি।’

দেখলাম লোকটির কথায় একটু পূর্ববঙ্গের টান আছে।

‘তোমার দেশ কোথায়?’

‘ফরিদপুর জেলায়–বলে সে চৌকাঠের ওপর উবু হয়ে বসল। আধবয়সী লোক‌, মাথায় কদমছাঁট চুল‌, গায়ে একটা ছেড়া ময়লা রঙের সোয়েটার।

‘কিতদিন কলকাতায় আছ?’

‘তা তিন বছর হতে চলল।’

‘এখানে-মানে এই বাড়িতে-ক’জন মানুষ থাকে?’

‘গিন্নী ঠাকরুন একলা থাকেন।’

‘স্ত্রীলোক-একলা থাকেন। পুরুষ কেউ নেই?

‘আজ্ঞে না। আমি বুড়োমানুষ‌, দেখাশুনা করি।’

‘এখানে কারুর যাওয়া-আসা আছে?’

‘আজ্ঞে না‌, আপনিই পেরথম এলেন।’

এই সময় হৈমবতীকে দোরের কাছে দেখা গেল। চাকরটা উঠে দাঁড়াল‌, আমিও দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে দিনের আলো কমে গিয়েছিল‌, তিনি চাকরকে বললেন‌, ‘মহেশ‌, আলো জ্বেলে নিয়ে এস।’

চাকর চলে গেল। অল্প আলোতেও মহিলাটিকে দেখার অসুবিধা ছিল না। দীঘল চেহারা‌, সুশ্ৰী মুখ‌, পাসীদের চোখে খুব ফরসা না লাগলেও আমার চোখে বেশ ফরসা। মুখে একটি চিত্তাকর্ষক সৌকুমাৰ্য আছে। যৌবনের চৌকাঠ পার হতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পরনে সাদা থান‌, গায়ে একটিও অলঙ্কার নেই। কবিত্র করছি না‌, কিন্তু তাঁর সদ্যস্নাত চেহারাটি দেখে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যার রজনীগন্ধার কথা মনে পড়ে যায়।

আমি হাতজোড় করে নমস্কার করলাম; তিনি প্রতিনমস্কার করে বললেন। ‘আপনি মহাবলেশ্বর থেকে আসছেন?’

আমি বললাম‌, ‘না‌, আমার বন্ধু ব্যোমকেশ বক্সী মহাবলেশ্বরে আছেন‌, তাঁর চিঠি পেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

‘তবে কি মানেক মেহতা ধরা পড়েছে?’ তাঁর কণ্ঠস্বরে আগ্রহ ফুটে উঠল।

বললাম‌, ‘না‌, এখনও ধরা পড়েনি।’

হৈমবতী আস্তে আস্তে চেয়ারে বসলেন‌, নিরাশ স্বরে বললেন‌, ‘বসুন। আমার কাছে এসেছেন কেন?’

আমি বসলাম‌, বললাম‌, ‘আমার বন্ধু ব্যোমকেশ বক্সী–’

তিনি বললেন‌, ‘ব্যোমকেশ বক্সী কে? পুলিসের লোক?’

‘না। ব্যোমকেশ বক্সীর নাম শোনেননি’—এই বলে তোমার পরিচয় দিলাম। তাঁর মুখ নিরুৎসুক হয়ে রইল। দেখা যাচ্ছে তুমি নিজেকে যতটা বিখ্যাত মনে কর‌, ততটা বিখ্যাত নও। সব শুনে হৈমবতী বললেন‌, ‘আমি জানতুম না। সারা জীবন বিদেশে কেটেছে-’

এই সময় মহেশ চাকর একটা লণ্ঠন এনে টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল। বলা বাহুল্য‌, বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই।

লণ্ঠনের আলোয় হৈমবতীর মুখ আরও স্পষ্টভাবে দেখলাম। ব্যথিত আশাহত মুখ ক্লান্তিভরে থমথম করছে‌, দু’একগাছি ভিজে চুল কপালে গালে জুড়ে রয়েছে। আমার মন লজ্জিত হয়ে উঠল; এই শোক-নিষিক্তা মহিলাকে বেশি কষ্ট দেওয়া উচিত নয়‌, তাড়াতাড়ি প্রশ্নগুলো শেষ করে চলে যাওয়াই কর্তব্য। বললাম‌, ‘আমাকে মাফ করবেন। মানেক মেহতাকে ধরবার উদ্দেশ্যেই ব্যোমকেশ আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করে পাঠিয়েছে।–মানেক মেহতার সঙ্গে আপনাদের প্রথম পরিচয় কবে হয়?’

হৈমবতী বললেন‌, ছয় বছর আগে। আমাদের তখন আমেদাবাদে ছোট্ট একটি হোটেল ছিল। কি কুক্ষণেই যে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’

‘মানেক মেহতার সঙ্গে আপনার বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল?’

‘আমার সঙ্গে তার সর্বসাকুল্যে পাঁচ-ছয় বারের বেশি দেখা হয়নি। বছরের মধ্যে একবার কি দুবার আসত; চুপিচুপি আসত‌, নিজের ভাগের টাকা নিয়ে চুপিচুপি যেত।’

‘তাঁর এই চুপিচুপি আসা-যাওয়া দেখে তার চরিত্র সম্বন্ধে আপনাদের কোন সন্দেহ হয়নি?’

‘না। আমরা ভাবতাম তার স্বভাবই ওই রকম‌, নিজেকে জাহির করতে চায় না।’

‘তার কোনও ফটোগ্রাফ আছে কি?’

‘একটা গ্রুপ-ফটো ছিল‌, সহ্যাদ্রি হোটেলের অফিসে টাঙানো থাকত। সে রাত্রে আমি মুর্ছা ভেঙে দেখলুম দেয়ালে ছবিটা নেই।’

‘সে রাত্রে হোটেলের লোহার সিন্দুকে কত টাকা ছিল?’

‘ঠিক জানি না। আন্দাজ দেড় লাখ!’

অতঃপর আর কি প্রশ্ন করব ভেবে পেলাম না। আমি উঠি-উঠি করছি‌, হৈমবতী আমাকে প্রশ্ন করলেন‌, ‘আমি এখানে আছি আপনার বন্ধু জানলেন কি করে? আমি তো কাউকে জানাইনি।’

উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেলাম। মহিলাটির বর্তমান মানসিক অবস্থায় ভূতপ্রেতের অবতারণা না করাই ভাল। বললাম‌, ‘তা জানি না‌, ব্যোমকেশ কিছু লেখেনি। আপনি উপস্থিত এখানেই আছেন তো?’

হৈমবতী বললেন‌, ‘বোধ হয় আছি। আমার স্বামীর এক বন্ধু তাঁর এই বাড়িতে দয়া করে থাকতে দিয়েছেন। —আসুন‌, নমস্কার।’

বাইরে এসে দেখলাম অন্ধকার হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে গাছের তলায় বিড়ির মুখে আগুন জ্বলছে‌, তাই দেখে বিকাশের কাছে গেলাম। তারপর দু’জনে ফিরে চললাম। ভাগ্যক্রমে খানিক দূর যাবার পর একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল।

0 Shares