ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বিকাশ বলল, ‘কাজ হল?’
এই কথা আমিও ভাবছিলাম। হৈমবতীর দেখা পেয়েছি বটে, তাঁকে প্রশ্নও করেছি; কিন্তু কাজ হল কি? মানেক মেহতা এখন কোথায় তার কিছুমাত্র ইঙ্গিত পাওয়া গেল কি? বললাম, ‘কতকটা হল।’
বিকাশ খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি যখন ব্যোমকেশবাবুকে চিঠি লিখবেন, তখন তাঁকে জানাবেন যে, শোবার ঘরে দুটো খাট আছে।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি জানলে কি করে?’
বিকাশ বলল, ‘আপনি যখন মহিলাটির সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি তখন বাড়ির সব জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছি।’
‘তাই নাকি! আর কি দেখলে?’
‘যা কিছু দেখলাম, শোবার ঘরেই দেখলাম। অন্য ঘরে কিছু নেই।’
‘কী দেখলে?’
‘একটা মাঝারি গোছের লোহার সিন্দুক আছে। আমি যখন কাচের ভেতর দিয়ে উঁকি মারলাম, তখন চাকরটা সিন্দুকের হাত ধরে ঘোরাবার চেষ্টা করছিল।’
‘চাকরিটা! ঠিক দেখেছ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সে যখন সদর দরজা খুলেছিল তখন আমি তাকে দেখেছিলাম। সে ছাড়া বাড়িতে অন্য পুরুষ নেই।’—
তারপর লেকের কাছাকাছি এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। বিকাশ নিজের রাস্তা ধরল, আমি বাসায় ফিরে এলাম। রাত্রে বসে চিঠি লিখছি, কাল সকালে ডাকে দেব।
তুমি কেমন আছ? সত্যবতী আর খোকা ভাল আছে। আমি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছি।
–তোমার অজিত
৩
আমি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কাহিনীর শেষাংশ লিখিতেছি। ব্যোমকেশের নামে সহ্যাদ্রি হোটেলের ঠিকানায় চিঠি লিখিয়া ডাকে দিয়াছিলাম ৯ তারিখের সকালে। ১২ তারিখের বিকালবেলা অনুমান তিনটার সময় ব্যোমকেশ আসিয়া উপস্থিত। সবিস্ময়ে বলিলাম, ‘একি! আমার চিঠি পেয়েছিলে?’
‘চিঠি পেয়েই এলাম। প্লেনে এসেছি। —তুমি চটপট তৈরি হয়ে নাও, এখুনি বেরুতে হবে।’–বলিয়া ব্যোমকেশ ভিতর দিকে চলিয়া গেল।
আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ি হইতে বাহির হইলাম। রাস্তায় বাড়ির সামনে পুলিসের ভ্যান দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে একজন ইন্সপেক্টর ও কয়েকজন কনস্টেবল। আমরাও ভ্যানে উঠিয়া বসিলাম।
কয়েকদিন আগে যে সময় হৈমবতীর নির্জন গৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিলাম, প্রায় সেই সময় আবার গিয়া পৌঁছিলাম। আজ কিন্তু ভৃত্য মহেশ দরজা খুলিয়া দিতে আসিল না। দরজা খোলাই ছিল। আমরা সদলবলে প্রবেশ করিলাম।
বাড়িতে কেহ নাই; হৈমবতী নাই, মহেশ নাই। কেবল আসবাবগুলি পড়িয়া আছে; বাহিরের ঘরে চেয়ার-টেবিল, শয়নকক্ষে দু’টি খাট ও লোহার সিন্দুক, রান্নাঘরে হাঁড়ি কলসী। লোহার সিন্দুকের কপাট খোলা, তাহার অভ্যন্তর শূন্য। ব্যোমকেশ করুণ হাসিয়া ইন্সপেক্টরের পানে চাহিল,–‘চিড়িয়া উড়েছে।’–
সে রাত্রে নৈশ ভোজন সম্পন্ন করিয়া ব্যোমকেশ ও আমি তক্তপোশের উপর গায়ে আলোয়ান জড়াইয়া বসিয়াছিলাম। সত্যবতী খোকাকে ঘুম পাড়াইয়া আসিয়া ব্যোমকেশের গা ঘেঁষিয়া বসিল। একটা শীতের হাওয়া উঠিয়াছে, হাওয়ার জোর ক্রমেই বাড়িতেছে। আমাদের ঘরের দরজা জানোলা সব বন্ধ, তবু কোন অদৃশ্য ছিদ্রপথে খুঁচের মত বাতাস প্রবেশ করিয়া গায়ে বিঁধিতেছে।
বলিলাম, ‘মহাবলেশ্বরের শীত তুমি খানিকটা সঙ্গে এনেছ দেখছি। আশা করি বিজয় বিশ্বাসের প্রেতটিকেও সঙ্গে আনোনি।’
সত্যবতী ব্যোমকেশের কাছে আর একটু ঘেঁষিয়া বসিল। ব্যোমকেশ আমার পানে একটি সকৌতুক দৃষ্টি হানিয়া বলিল, ‘প্ৰেত সম্বন্ধে তোমার ভুল ধারণা এখনও যায়নি।’
বলিলাম, ‘প্ৰেত সম্বন্ধে আমার ভুল ধারণা থাকা বিচিত্র নয়, কারণ প্রেতের সঙ্গে আমি কখনও রাত্রিবাস করিনি। আচ্ছা ব্যোমকেশ, সত্যিই তুমি ভুত বিশ্বাস করা?’
‘যা প্রত্যক্ষ করেছি তা বিশ্বাস করা-না-করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তুমি ব্যোমকেশ বক্সীর অস্তিত্বে বিশ্বাস কর?’
‘ব্যোমকেশ বক্সীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। কারণ তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ভূত তো চোখে দেখিনি, বিশ্বাস করি কি করে?’
‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু আমি যদি বিশ্বাস করি, তুমি আপত্তি করবে কেন?’
কিছুক্ষণ নীরবে ধূমপান করিলাম। ‘আচ্ছা, ওকথা যাক। বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহু দূর। কিন্তু তোমার ভূতের এত চেষ্টা সত্ত্বেও কার্যসিদ্ধি হল না।’
‘কে বলে কার্যসিদ্ধি হয়নি? ভূত চেয়েছিল মস্ত একটা ধোঁকার টাটি ভেঙে দিতে। তা সে দিয়েছে।’
‘তার মানে?’
‘মানে কি এখনও কিছুই বোঝোনি?’
‘কেন বুঝব না? প্রথমে অবশ্য আমি হৈমবতীর চরিত্র ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝেছি হৈমবতী আর মানেক মেহতা মিলে বিজয় বিশ্বাসকে খুন করেছিল। হৈমবতী একটি সাংঘাতিক মেয়েমানুষ।’
‘হৈমবতীর চরিত্র ঠিকই বুঝেছ। কিন্তু ভুতকে এখনও চেনোনি। ভূতের রহস্য আরও সাংঘাতিক।’
সত্যবতী ব্যোমকেশের আরও কাছে সরিয়া গেল, হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিয়া বলিল, ‘আমার শীত করছে।’
‘শীত করছে, না ভয় করছে।’ ব্যোমকেশ হাসিয়া নিজের আলোয়ানের অর্ধেকটা তাহার গায়ে জড়াইয়া দিল।
বলিলাম, ‘এস এস বঁধু এস, আধা আঁচরে বসো। বুড়ো বয়সে লজ্জা করে না!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তোমাকে আবার লজ্জা কি! তুমি তো অবোধ শিশু।’
সত্যবতী সায় দিয়া বলিল, ‘নয়তো কি! যার বিয়ে হয়নি সে তো দুধের ছেলে।’
বলিলাম, ‘আচ্ছা আচ্ছা, এখন ভূতের কথা হোক। আমি কিছুই বুঝিনি, তুমি সব খোলসা করে বল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আগে তোমাকে দু’ একটা প্রশ্ন করি। মানেক মেহতা বিজয় বিশ্বাসকে খুন করবার জন্যে খাদের ধারে নিয়ে গেল কেন? বিজয় বিশ্বাস বা গেল কেন?’
চিন্তা করিয়া বলিলাম, ‘জানি না।’