সীমান্ত-হীরা

পরদিন ভোর হইতে না হইতে গন্তব্যস্থানে পৌঁছিলাম। স্টেশনটি ছোট, সেখান হইতে প্রায় ছয় সাত মাইল মোটরে যাইতে হইবে। একখানি দামি মোটর লইয়া জমিদারের একজন কর্মচারি উপস্থিত ছিলেন, তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। আমরা মোটরে বসিলাম। অতঃপর নির্জন পথ দিয়া মোটর নিঃশব্দে ছুটিয়া চলিল।

কর্মচারিটি প্রবীণ এবং বিচক্ষণ; ব্যোমকেশ কৌশলে তাঁহাকে দু’একটি প্রশ্ন করিতেই তিনি বলিলেন, “আমি কিছুই জানি না, মশাই! শুধু আপনাদের স্টেশন থেকে নিয়ে যাওয়ার হুকুম পেয়েছিলাম, তাই নিয়ে যচ্ছি।”

আমরা মুখ তাকাতাকি করিলাম, আর কোনও কথা হইল না। পরে জমিদারভবনে পৌঁছিয়া দেখিলাম, সে এক এলাহি কাণ্ড! মাঠের মাঝখানে যেন ইন্দ্রপুরী বসিয়াছে। প্রকাণ্ড সাবেক পাঁচমহল ইমারত – তাহাকে ঘিরিয়া প্রায় ত্রিশ চল্লিশ বিঘা জমির উপর বাগান, হট হাউস, পুষ্করিণী, টেনিস কোর্ট, কাছারি বাড়ি, অতিথিশালা, পোস্ট অফিস, আরও কত কি! চারিদিকে লস্কর পেয়াদা গোমস্তা সরকার খাতক প্রজার ভিড় লাগিয়া গিয়াছে। আমাদের মোটর বাড়ির সম্মুখে থামিতেই জমিদারের প্রাইভেট সেক্রেটারি স্বয়ং আসিয়া আমাদের সমাদর করিয়া ভিতরে লইয়া গেলেন। একটা আস্ত মহল আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছিল। সেক্রেটারি বলিলেন, “আপনারা মুখ হাত ধুয়ে জলযোগ করে নিন। ততক্ষণ কুমার বাহাদুরও আপনাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য তৈরি হয়ে যাবেন।”

স্নানাদি সারিয়া বাহির হইতেই প্রচুর প্রাতঃরাশ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার যথারীতি ধ্বংস সাধন করিয়া তৃপ্তমনে ধূমপান করিতেছি, এমন সময় সেক্রেটারি আসিয়া বলিলেন, “কুমার বাহাদুর লাইব্রেরি ঘরে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। যদি আপনাদের অবসর হয়ে থাকে – আমার সঙ্গে আসুন।”

আমরা উঠিয়া তাঁহার অনুসরণ করিলাম। রাজসকাশে যাইতেছি, এমনি একটা ভাব লইয়া লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করিলাম। ‘কুমার ত্রিদিবেন্দ্রনারায়ণ’ নাম হইতে আরম্ভ করিয়া সর্ববিষয়ে বিরাট আড়ম্বর দেখিয়া মনের মধ্যে কুমার বাহাদুর সম্বন্ধে একটা গুরুগম্ভীর ধারণা জন্মিয়াছিল, কিন্তু তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সে ভ্রম ঘুচিয়া গেল। দেখিলাম, আমাদেরই মতো সাধারণ পাঞ্জাবি পরা একটি সহস্যমুখ যুবাপুরুষ, গৌরবর্ণ সুশ্রী চেহারা – ব্যবহারে তিলমাত্র আড়ম্বর নাই। আমরা যাইতেই চেয়ার হইতে উঠিয়া আগেই হাত তুলিয়া নমস্কার করিলেন। পলকের জন্য একটু দ্বিধা করিয়া ব্যোমকেশকে বলিলেন, “আপনিই ব্যোমকেশবাবু? আসুন।”

ব্যোমকেশ আমাকে পরিচিত করিয়া দিয়া বলিল, “ইনি আমার বন্ধু, সহকারী এবং ভবিষ্যৎ জীবনী লেখক।”

কুমার ত্রিদিব হাসিয়া কহিলেন, “আশা করি, আপনার জীবনী লেখার প্রয়োজন এখনও অনেক দূরে। অজিতবাবু এসেছেন, আমি ভারি খুশি হয়েছি। কারণ, প্রধানত ওঁর লেখার ভিতর দিয়েই আপনার নামের সঙ্গে আমাদের পরিচয়।”

উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। অন্যের মুখে নিজের লেখার অযাচিত উল্লেখ যে কত মধুর, তাহা যিনি ছাপার অক্ষরের কারবার করেন, তিনিই জানেন। বুঝিলাম, ধনী জমিদার হইলেও লোকটি অতিশয় সুশিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। লাইব্রেরি ঘরের চারিদিকে চক্ষু ফিরাইয়া দেখিলাম দেয়াল সংলগ্ন আলমারিগুলি দেশি বিলাতি নানা প্রকার পুস্তকে ঠাসা। টেবিলের উপরেও অনেকগুলি বই ইতস্তত ছড়ানো রহিয়াছে। লাইব্রেরি ঘরটি যে কেবল মাত্র জমিদার গৃহের শোভাবর্ধনের জন্য নহে, রীতিমতো ব্যবহারের জন্য – তাহাতে সন্দেহ রহিল না।

আরও কিছুক্ষণ শিষ্টতা বিনিময়ের পর কুমার বাহাদুর বলিলেন, “এবার কাজের কথা আরম্ভ করা যাক।”

সেক্রেটারিকে হুকুম দিলেন, “তুমি এখন যেতে পার। লক্ষ রেখো, এ ঘরে কেউ না ঢোকে।”

সেক্রেটারি সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করিয়া প্রস্থান করিলে কুমার ত্রিদিব চেয়ারে ঝুঁকিয়া বসিয়া বলিলেন, “আপনাদের যে কাজের জন্য এত কষ্ট দিয়ে ডেকে আনিয়েছি, সে কাজ যেমন গুরুতর, তেমনি গোপনীয়। তাই সকল কথা প্রকাশ করে বলবার আগে আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, এ কথা ঘুণাক্ষরেও তৃতীয় ব্যক্তির কর্ণগোচর হবে না। এত সাবধানতার কারণ, এই ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের বংশের মর্যাদা জড়ানো রয়েছে।”

ব্যোমকেশ বলিল, “প্রতিশ্রুতি দেবার কোনও দরকার আছে মনে করিনে, একজন মক্কেলের গুপ্তকথা অন্য লোককে বলা আমাদের ব্যবসার রীতি নয়। কিন্তু আপনি যখন প্রতিশ্রুতি চান, তখন দিতে কোনও বাধাও নেই। কি ভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বলুন।”

কুমার হাসিয়া বলিলেন, “তামা তুলসীর দরকার নেই। আপনাদের মুখের কথাই যথেষ্ট।”

আমি একটু দ্বিধায় পড়িলাম, বলিলাম, “গল্পচ্ছলেও কি কোনও কথা প্রকাশ করা চলবে না?”

কুমার দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, “না। এ সম্বন্ধে কোনও আলোচনাই চলবে না।”

হয়তো একটা ভালো গল্পের মশলা হাত ছাড়া হইয়া গেল, এই ভাবিয়া মনে মনে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, “আপনি নির্ভয়ে বলুন। আমরা কোনও কথা প্রকাশ করব না।”

কুমার ত্রিদিব কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, যেন কি ভাবে কথাটা আরম্ভ করিবেন তাহাই ভাবিয়া লইলেন। তারপর বলিলেন, “আমাদের বংশে যে সব সাবেক কালের হীরা জহরত আছে সে সম্বন্ধে বোধ হয়া আপনি কিছু জানেন না – ”

ব্যোমকেশ বলিল, “কিছু কিছু জানি। আপনাদের বংশে একটি হীরা আছে, যার তুল্য হীরা বাংলা দেশে আর দ্বিতীয় নেই – তার নাম সীমন্ত হীরা।”

ত্রিদিব সাগ্রহে বলিলেন, “আপনি জানেন? তাহলে এ কথাও জানেন বোধ হয় যে গতমাসে কলকাতায় যে রত্ন প্রদর্শনী হয়েছিল, তাহাতে ঐ হীরা দেখানো হয়েছিল?”

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “জানি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে হীরা চোখে দেখার সুযোগ হয়নি।”

কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া কুমার কহিলেন, “সে সুযোগ আর কখনও হবে কি না জানি না। হীরাটা চুরি গেছে।”

ব্যোমকেশ প্রতিধ্বনি করিয়া কহিল, “চুরি গেছে!”

শান্তকণ্ঠে কুমার বলিলেন, “হঁযা, সেই সম্পর্কেই আপনাকে আনিয়েছি। ঘটনাটা শুরু থেকে বলি শুনুন। আপনি নিশ্চয় জানেন, আমাদের এই জমিদার বংশ অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। বারো ভুঁইয়ারও আগে পাঠান বাদশাদের আমলে আমাদের আদি পূর্বপুরুষ এই জমিদারি অর্জন করেন। সাদা কথায় তিনি একজন দুর্দান্ত ডাকাতের সর্দার ছিলেন, নিজের বাহুবলে সম্পত্তি লাভ করে পরে বাদশার কাছ থেকে সনন্দ আদায় করেন। সে বাদশাহি সনন্দ এখনও আমাদের কাছে বর্তমান আছে। এখন আমাদের অনেক অধঃপতন হয়েছে; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে আমাদের ‘রাজা’ উপাধি ছিল।”

“ঐ ‘সীমন্ত হীরা’ আমাদের পূর্বপুরুষের সময় থেকে পুরুষানুক্রমে এই বংশে চলে আসছে। একটা প্রবাদ আছে যে, এই হীরা যতদিন আমাদের কাছে থাকবে, ততদিন বংশের কোনও অনিষ্ট হবে না; কিন্তু হীরা কোনও রকমে হস্তান্তরিত হলেই এক পুরুষের মধ্যে বংশ লোপ হয়ে যাবে।”

একটু থামিয়া কুমার আবার বলিতে লাগিলেন, “জমিদারের জ্যেষ্ঠ পুত্র জমিদারির উত্তরাধিকারী হয়, এই হচ্ছে আমাদের বংশের চিরাচরিত লোকাচার। কনিষ্ঠরা কেবল বাবুয়ান বা ভরণপোষণ পান। এই সূত্রে দু’বছর আগে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমি জমিদারি পেয়েছি। আমি বাপের একমাত্র সন্তান, উপস্থিত আমার এক কাকা আছেন, তিনি বাবুয়ানস্বরূপ তিন হাজার টাকা মাসিক খোরপোষ জমিদারি থেকে পেয়ে থাকেন।

এ তো গেল গল্পের ভূমিকা। এবার হীরা চুরির ঘটনাটা বলি। রত্ন প্রদর্শনীতে আমার হীরা একজিবিট করবার নিমন্ত্রণ যখন এল, তখন আমি নিজে স্পেশাল ট্রেনে করে সেই হীরা নিয়ে কলকাতা গেলাম; কলকাতায় পৌঁছে হীরাখানা প্রদর্শনীর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা করে দেবার পর তবে নিশ্চিন্ত হলাম। আপনারা জানেন প্রদর্শনীতে বরোদা, হায়দ্রাবাদ, পাতিয়ালা প্রভৃতি রাজবংশের খানদানি জহরত প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রদর্শনের কর্তা ছিলেন স্বয়ং গভর্নমেন্ট, সুতরাং সেখান থেকে হীর চুরি যাবার কোনও ভয় ছিল না। তা ছাড়া যে গ্লাসকেসে আমার হীরা রাখা হয়েছিল, তার চাবি কেবল আমারই কাছে ছিল।

সাতদিন একজিবিশন চলল। আট দিনের দিন আমার হীরা নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরে এসে জানতে পারলাম যে আমার হীরা চুরি গেছে, তার বদলে যা ফিরিয়ে এনেছি, তা দু’শ টাকা দামের মেকি পেস্ট।”

কুমার চুপ করিলেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, “চুরিটা ধরা পড়বার পর প্রদর্শনীর কর্তৃপক্ষকে কিংবা পুলিশকে খবর দেননি কেন?”

0 Shares