সীমান্ত-হীরা

কুমার বলিলেন, “খবর দিয়ে কোনও লাভ হত না, কারণ কে চুরি করেছে, চুরি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা জানতে পেরেছিলাম।”

“ওঃ” – ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল কুমারের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, “তারপর বলে যান।”

কুমার বলিতে লাগিলেন, “এ কথা কাউকে বলবার নয়। পাছে জানাজানি হয়ে পারিবারিক কলঙ্ক বার হয়ে পড়ে, খবরের কাগজে এই নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়ে যায়, এই ভয়ে বাড়ির লোককে পর্যন্ত একথা জানাতে পারি নি। জানি শুধু আমি আর আমার বৃদ্ধ দেওয়ান মহাশয়।”

“কথাটা আরও খোলসা করে বলা দরকার। পূর্বে বলেছি, আমার এক কাকা আছেন। তিনি কলকাতায় থাকেন, স্টেট থেকে মাসিক তিন হাজার টাকা খরচা পান। তাঁর নাম আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন, তিনিই বিখ্যাত শিল্পী এবং বৈজ্ঞানিক স্যর দিগিন্দ্রনারায়ণ রায়। তাঁর মতো আশ্চর্য মানুষ খুব কম দেখা যায়। বিলেতে জন্মালে তিনি বোধ হয় অদ্বিতীয় মনীষী বলে পরিচিত হতে পারতেন। যেমন তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, তেমনই অগাধ পাণ্ডিত্য। গত মহাযুদ্ধের সময় তিনি প্ল্যাস্টার অফ প্যারিস সম্বন্ধে কি একটা তথ্য আবিষ্কার করে ইংরাজ গভর্নমেণ্টকে উপহার দিয়েছিলেন – তার ফলে ‘স্যর’ উপাধি পান। শিল্পের দিকেও তাঁর কি অসামান্য প্রতিভা, তার পরিচয় সম্ভবত আপনাদের অল্পবিস্তর জানা আছে। প্যারিসের শিল্প প্রদর্শনীতে মহাদেবের প্রস্তরমূর্তি একজিবিট করে তিনি যে সম্মান ও প্রশংসা লাভ করেন, তা কারুর অবিদিত নেই। মোটের পর এমন বহুমুখী প্রতিভা সচরাচর চোখে পড়েনা।” বলিয়া কুমার বাহাদুর একটু হাসিলেন।

আমরা নড়িয়া চড়িয়া বসিলাম। কুমার বলিতে লাগিলেন, “কাকা আমাকে কম স্নেহ করেন না, কিন্তু একটি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার মতভেদ হয়েছিল। ঐ হীরাটা তিনি আমার কাছে চেয়েছিলেন। হীরাটার উপর তাঁর একটা অহেতুক আসক্তি ছিল। তার দামের জন্য নয়, শুধু হীরাটাকেই নিজের কাছে রাখবার জন্যে তিনি প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলেন।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “হীরাটার দাম কত হবে?”

কুমার ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “খুব সম্ভব তিন পয়জার। টাকা দিয়ে সে জিনিস কেনবার মত লোক ভারতবর্ষে খুব কমই আছে। তা ছাড়া আমরা কখনও তার দাম যাচাই করে দেখিনি। গৃহদেবতার মতোই সে হীরাটা অমূল্য ছিল। সে যাক। আমার বাবার কাছেও কাকা ঐ হীরাটা চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবা দেননি। তারপর বাবা মারা যাবার পর কাকা আমার কাছে সেটা চাইলেন। বললেন, ‘আমার মাসহারা চাই না, তুমি শুধু আমায় হীরাটা দাও।’ বাবা মৃত্যুকালে আমাকে এ বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন, তাই জোড়হাত করে কাকাকে বললাম, ‘কাকা, আপনার আর যা ইচ্ছা নিন, কিন্তু ও হীরাটা দিতে পারব না। বাবার শেষ আদেশ।’ কাকা আর কিছু বললেন না, কিন্তু বুঝলাম, তিনি আমার উপর মর্মান্তিক অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারপর থেকে কাকার সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি।

তবে পত্র ব্যবহার হয়েছে। যেদিন হীরা নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরে এলাম, তার পরদিন কাকার কাছ থেকে এক চিঠি এল। চোট্ট চিঠি, কিন্তু পড়ে মাথা ঘুরে গেল। এই দেখুন সে চিঠি।”

চাবি দিয়া সেক্রেটারিয়ট টেবিলের দেরাজ খুলিয়া কুমার বাহাদুর একখানা চিঠি বাহির করিয়া দিলেন। ছোট ছোট সুছাঁদ অক্ষরে লেখা বাঙলা চিঠি, তাহাতে লেখা আছে,

কল্যাণীয় খোকা,

দুঃখিত হয়ো না। তোমরা দিতে হাওনি, তাই আমি নিজের হাতেই নিলাম। বংশলোপ হবে বলে যে কুসংস্কার আছে, তাতে বিশ্বাস করো না। ওটা আমাদের পূর্বপুরুষদের একটা ফন্দি মাত্র, যাতে জিনিসটা হস্তান্তরিত করতে কেউ সাহস না করে। আশীর্বাদ নিও।

ইতি
তোমার কাকা
শ্রীদিগিন্দ্রনারায়ণ রায়

ব্যোমকেশ নিঃশব্দে চিঠি ফেরত দিল। কুমার বলিতে লাগিলেন, “চিঠি পড়েই ছুটলাম তোষাখানায়। লোহার সিন্দুক খুলে হিরের বাক্স বার করে দেখলাম, হীরা ঠিক আছে। দেওয়ান মশায়কে ডাকলাম, তিনি জহরতের একজন ভালো জহুরি, দেখেই বললেন, জাল হীরা। কিন্তু চেহারায় কোথাও এতটুকু তফাত নেই, একেবারে অবিকল আসল হীরার জোড়া।”

কুমার দেরাজ খুলিয়া একটি ভেলভেটের বাক্স বাহির করিলেন। ডালা খুলিতেই সুপারির মতো গোলাকার একটা পাথর আলোকসম্পাতে ঝকমক করিয়া উঠিল। কুমার বাহাদুর দুই আঙুলে সেটা তুলিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিয়া বলিলেন, “জহুরি ছাড়া কারুর সাধ্য নেই যে বোঝে এটা ঝুটো। আসলে দুশ টাকার বেশি এর দাম নয়।”

অনেকক্ষণ ধরিয়া আমরা সেই মূল্যহীন কাচখণ্ডটাকে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিলাম; তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়িয়া ব্যোমকেশ সেটা ফিরাইয়া দিল, বলিল, “তাহলে আমার কাজ হচ্ছে সেই আসল হীরাটা উদ্ধার করা?”

স্থিরদৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া কুমার বলিলেন, “হঁযা। কেমন করে হীরা চুরি গেল, সে নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনও দরকার নেই। আমি শুধু আমার হীরাটা ফেরত চাই। যেমন করে হোক, যে উপায়ে হোক, আমার ‘সীমন্ত হীরা’ আমাকে ফিরিয়ে এনে দিতে হবে। খরচের জন্যে ভাবনা করবেন না, যত টাকা লাগ, যদি বিশ হাজার টাকা দরকার হয়, তাও দিতে আমি পশ্চাৎপদ হব না জানবেন। শুদু একটি শর্ত, কোনও রকমে এ কথা যেন খবরের কাগজে না ওঠে।”

ব্যোমকেশ তাচ্ছিল্যভরে জিজ্ঞাসা করিল, “কবে নাগাদ হীরাটা পেলে আপনি খুশি হবেন?”

উত্তেজনায় কুমার বাহাদুরের মুখ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, “কবে নাগাদ? তবে কি, তবে কি আপনি হীরাটা উদ্ধার করতে পারবেন বলে মনে হয়?”

ব্যোমকেশ হাসিল, বলিল, “এ অতি তুচ্ছ ব্যাপার। আমি এর চেয়ে ঢের বেশি জটিল রহস্য প্রত্যাশা করেছিলুম। যা হোক, আজ শনিবার; আগামী শনিবারের মধ্যে আপনার হীরা ফেরত পাবেন।” বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল।

কলিকাতায় ফিরিয়া প্রথম দিনটা গোলমালে কাটিয়া গেল।

রাত্রে দুইজনে কথা হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “প্ল্যান অফ ক্যাম্পেন কিছু ঠিক করলে?”

ব্যোমকেশ বলিল, “না। বাড়িটা দেখে কিছু সংবাদ সংগ্রহ করা যাক, তার পর প্ল্যান স্থির করা যাবে।”

“হিরেটা কি বাড়িতেই আছে মনে হয়?”

“নিশ্চয়। যে জিনিসের মোহে খুড়ো মহাশয় শেষ বয়সে ভাইপো’র সম্পত্তি চুরি করেছেন, সে জিনিস তিনি এক দণ্ডের জন্যও কাছ ছাড়া করবেন না। আমাদের শুধু জানা দরকার, কোথায় তিনি সেটা রেখেছেন। আমার বিশ্বাস -”

“তোমার বিশ্বাস?”

“যাক, সেটা অনুমানমাত্র। দিগিন্দ্রনারায়ণ খুড়া মহাশয়ের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা না হওয়া পর্যন্ত কিছুই ঠিক করে বলা যায় না।”

আমি ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলাম, “আচ্ছা ব্যোমকেশ, এ কাজের নৈতিক দিকটা ভেবে দেখেছ?”

“কোন কাজের?”

“যে উপায় অবলম্বন করে তুমি হিরেটা উদ্ধার করতে যাচ্ছ।”

“ভেবে দেখেছি। ডাহা নিছক চুরি, ধরা পড়লে জেলে যেতে হবে। কিন্তু চুরি মাত্রেই নৈতিক অপরাধ নয়। চোরের পর বাটপাড়ি করা মহা পুণ্যকার্য।”

“তা যেন বুঝলুম, কিন্তু দেশের আইন তো সে কথা শুনবে না।”

“সে ভাবনা আমার নয়। আইনের যাঁরা রক্ষক, তাঁরা পারেন, আমাকে শাস্তি দিন।”

পরদিন দুপুর বেলা ব্যোমকেশ একাকী বাহির হইয়া গেল; যখন ফিরিল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। হাত মুখ ধুইয়া জলযোগ করিতে বসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কাজ কত দূর হল?”

ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে কcুরিতে কামড় দিয়া বলিল, “বিশেষ সুবিধা হল না। বুড়ো একটি হর্তেল ঘুঘু। আর তার একটি নেপালি চাকর আছে, সে বেটার চোখ দুটো ঠিক শিকারি বেড়ালের মতো। যা হোক, একটা সুরাহা হয়েছে, বুড়ো একজন সেক্রেটারি খুঁজছে, দুটো দরখাস্ত করে দিয়ে এসেছি।”

“সব কথা খুলে বল।”

চায়ে চুমুক দিয়া বাটি নামাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, “কুমার বাহাদুর যা বলেছিলেন, তা নেহাত মিথ্যে নয়, খুড়ো মহাশয় অতি পাকা লোক। বাড়িটা নানা রকম বহুমূল্য জিনিসের একটা মিউজিয়াম বললেই হয়; কর্তা একলা থাকেন বটে, কিন্তু অনুগত এবং বিশ্বাসী লোকলস্করের অভাব নেই। প্রথমত বাড়ির কম্পাউণ্ডে ঢোকাই মুস্কিল, ফটকে চারটে দারোয়ান অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে বসে আছে, কেউ ঢুকতে গেলেই হাজার রকম প্রশ্ন। পাঁচিল ডিঙিয়ে যে ঢুকবে, তারও উপায় নেই, আট হাত উুঁচু পাঁচিল, তার উপর ছুঁচলো লোহার শিক বসানো। যা হোক, কোনও রকমে দারোয়ান বাবুদের খুশি করে ফটকের ভিতর যদি ঢুকলে, বাড়ির সদর দরজায় নেপালি ভৃত্য উজরে সিং থাপা বাঘের মতো থাবা গেড়ে বসে আছেন, ভালোরকম কৈফিয়ত যদি না দিতে পার, বাড়িতে ঢোকবার আশা ঐখানেই ইতি। রাত্রির ব্যবস্থা আরও চমৎকার। দারোয়ান, চৌকিদার তো আছেই, তার উপর চারটে বিলিতি ম্যাস্টিফ কুকুর কম্পাউণ্ডের মধ্যে ছাড়া থাকে। সুতরাং নিশীথ সময়ে নিরিবিলি গিয়ে যে কার্যোদ্ধার করবে সে পথও বন্ধ।”

0 Shares