সীমান্ত-হীরা

“তবে উপায়?

“উপায় হয়েছে। বুড়োর একজন সেক্রেটারি চাই – বিজ্ঞাপন দিযেছে। দেড় শ’টাকা মাইনে – বাড়িতেই থাকতে হবে। বিজ্ঞানশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি থাকা চাই এবং শর্টহ্যাণ্ড টাইপিং ইত্যাদি আরও অনেক রকম সদগুণের আবশ্যক। তাই দুটো দরখাস্ত করে দিয়ে এসেছি, কাল ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে।”

“দুটো দরখাস্ত কেন?”

“একটা তোমার একটা আমার। যদি একটা ফস্কায়, অন্যটা লেগে যাবে।”

পরদিন অর্থাৎ সোমবার সকালবেলা আটটার সময় আমরা স্যর দিগিন্দ্রনরায়ণের ভবনে সেক্রেটারি পদপ্রার্থী হইয়া উপস্থিত হইলাম। শহরের দক্ষিণে অভিজাত পল্লীতে তাঁহার বাড়ি; দারোয়ানের ভিড় ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতেই দেখিলাম, আমাদের মতো আরও কয়েকজন চাকরি অভিলাষী হাজির আছেন। একটা ঘরের মধ্যে সকলে গিয়া বসিলাম এবং বক্রকটাক্ষে পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশ ও আমি যে পরস্পরকে চিনি, তাহার আভাসমাত্র দিলাম না। পূর্ব হইতে সেইরূপ স্থির করিয়া গিয়াছিলাম।

বাড়ির কর্তা ভিতরের কোনও একটা ঘরে বসিয়া একে একে উমেদারদিগকে ডাকিতে ছিলেন। মনের মধে উৎকণ্ঠা জাগিতেছিল, হয়তো আমাদের ডাক পড়িবার পূর্বেই অন্য কেহ বহাল হইয়া যাইবে। কিন্তু দেখা গেল, একে একে সকলেই ফিরিয়া আসিলেন এবং বাঙনিষ্পত্তি না করিয়া শুষ্ক মুখে প্রস্থান করিলেন। শেষপর্যন্ত বাকি রহিয়া গেলাম আমি আর ব্যোমকেশ।

বলা বাহুল্য, ব্যোমকেশ নাম ভাঁড়াইয়া দরখাস্ত করিয়াছিল; আমার নতুন নামকরণ হইয়াছিল জিতেন্দ্রনাথ এবং ব্যোমকেশের নিখিলেশ। পাছে ভুলিয়া যাই, তাই নিজের নামটা মাঝে মাঝে আবৃত্তি করিয়া লইতেছিলাম, এমন সময় ভৃত্য আসিয়া জানাইল কর্তা আমাদের দুইজনকে একসঙ্গে তলব করিয়াছেন। কিছু বিস্মিত হইলাম। ব্যাপার কি? এতক্ষণ তো একে একে ডাক পড়িতেছিল, এখন আবার একসঙ্গে কেন? যাহা হোক, বিনা বাক্যব্যায়ে ভৃত্যের অনুসরণ করিয়া গৃহস্বামীর সম্মুখীন হইলাম।

প্রায় আসবাবশূন্য প্রকাণ্ড একখানা ঘরের মাঝখানে বৃহৎ সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং তাহারই সম্মুখে দরজার দিকে মুখ করিয়া হাতকাটা পিরান পরিহিত বিশালকায় স্যর দিগিন্দ্র বসিয়া আছেন। বুলডগের মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ গজাইলে যে রকম দেখিতে হয়, সেই রকম একখানা মুখ – হঠাৎ দেখিলে ‘বাপ রে’ বলিয়া চেঁচাইয়া উঠিতে ইচ্ছা হয়। হাঁড়ির মতো মাথা, তাহার মধ্যস্থলে টাক পড়িয়া খানিকটা স্থান চকচকে হইয়া গিয়াছে। প্রকাণ্ড শরীর এবং প্রকাণ্ড মস্তকের মাঝখানে গ্রীবা বলিয়া কোনও পদার্থ নাই। দীর্ঘ রোমশ বাহু দুটা বনমানুষের মতো দৃঢ় এবং ভয়ঙ্কর; কিন্তু তাহার প্রান্তে আঙুলগুলি ‘ভারতীয় চিত্রকলার’ মতো সরু ও সুদৃশ্য, একেবারে লতাইয়া না গেলেও পশ্চাদ্দিকে ঈষৎ বাঁকিয়া গিয়াছে। চক্ষু দুইটি ক্ষুদ্র এবং সর্বদাই যেন লড়াই করিবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজিতেছে। মোটের উপর আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মতো এই লোকটিকে দেখিবামাত্র একটা অহেতুক সম্ভ্রম ও ভীতির সঞ্চার হয়, মনে হয়, ইহার ঐ কুদর্শন দেহটার মধ্যে ভালো ও মন্দ করিবার অফুরন্ত শক্তি নিহিত রহিয়াছে।

আমরা বিনীতভাবে নমস্কার করিয়া টেবিলের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলাম। সেই ক্ষুদ্র চক্ষু দুইটি আমার মুখ হইতে ব্যোমকেশের মুখে দ্রুতবেগে কয়েকবার যাতায়াত করিয়া ব্যোমকেশের মুখের পর স্থির হইল। তারপর এই প্রকাণ্ড মুখে এক অদ্ভুত হাসি দেখা দিল। বুলডগ হাসিতে পারে কি না জানি না; কিন্তু পারিলে বোধ করি ঐ রকমই হাসিত। এই হাস্য ক্রমে মিলাইয়া গেলে জলদগম্ভীর শব্দ হইল, “উজরে দরজা বন্ধ করে দাও।”

নেপালি ভৃত্য উজরে সিং দ্বারের নিকটে দাঁড়াইয়াছিল, নিঃশব্দে বাহির হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। কর্তা তখন টেবিলের উপর হইতে আমাদের দরখাস্ত দুইটা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “কার নাম নিখিলেশ?”

ব্যোমকেশ বলিল, “আজ্ঞে আমার।”

কর্তা কহিলেন, “হুঁ। তুমি নিখিলেশ। আর তুমি জিতেন্দ্রনাথ? তোমরা দুজন সল্লা করে দরখাস্ত করেছ?”

ব্যোমকেশ বলিল, “আজ্ঞে, আমি ওঁকে চিনি না।”

কর্তা কহিলেন, “বটে! চেনো না? কিন্তু দরখাস্ত পড়ে আমার অন্য রকম মনে হয়েছিল। যা হোক, তুমি এম, এস, সি পাশ করেছ?”

ব্যোমকেশ বলিল, “আজ্ঞে হাঁ।”

“কোন য়ুনিভার্সিটি থেকে?”

“ক্যালকাটা য়ুনিভার্সিটি থেকে।”

“হুঁ। টেবিলের উপর হইতে একখানা মোটা বই তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা খুলিয়া কহিলেন, “কোন সালে পাশ করেছ?”

সভয়ে দেখিলাম, বইখানা য়ুনিভার্সিটি কর্তৃক মুদ্রিত পরীক্ষোত্তীর্ণ ছাত্রদের নামের তালিকা। আমার কপাল ঘামিয়া উঠিল। এই রে! এবার বুঝি সব ফাঁসিয়া যায়।

ব্যোমকেশ কিন্তু নিষ্কম্প স্বরে কহিল, “আজ্ঞে, এই বছর। মাসখানেক আগে রেজাল্ট বেরিয়েছে।”

হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। যাক, একটা ফাঁড়া তো কাটিল, এ বছরের নামের তালিকা এখনও বাহির হয় নাই।

কর্তা ব্যর্থ হইয়া বই রাখিয়া দিলেন। তারপর অরও কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের পর কঠোর জেরা চলিল, কিন্তু বৃদ্ধ তাহাকে টলাইতে পারিলেন না। শর্টহ্যাণ্ড পরীক্ষাতেও যখন সে সহজে উত্তীর্ণ হইয়া গেল, তখন কর্তা সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “বেশ। তোমাকে দিয়ে আমার কাজ চলতে পারে। তুমি বসো।”

ব্যোমকেশ বসিল। কর্তা কিয়ৎ কাল ভ্রুকুটি করিয়া টেবিলের দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তারপর হথাৎ আমার পানে মুখ তুলিয়া বলিলেন, “অজিতবাবু!”

“আজ্ঞে!”

বোমা ফাটার মতো হাসির শব্দে চমকিয়া উঠিলাম। দেখি, অদম্য হাসির তোড়ে কর্তার বিশাল দেহ ফাটিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে। অকস্মাৎ এত আনন্দের কি কারণ ঘটিল বুঝিতে না পারিয়া ব্যোমকেশের পানে তাকাইয়া দেখি, সে ভরৎসনা পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া আছে, তখন বুঝিতে পারিয়া লজ্জায় অনুশোচনায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে ইচ্চা হইল। হায় হায়, মুহূর্তের অসাবধানতায় সব নষ্ট করিযা ফেলিলাম।

কর্তার হাসি সহজে থামিল না, কড়ি বরগা কাঁপাইয়া প্রায় পাঁচ মিনিট ধরিয়া একাদিক্রমে চলিতে লাগিল। তারপর চক্ষু মুছিয়া আমার মৃয়মাণ মুখের দিকে দৃষ্টি করিয়া তিনি বলিলেন, “লজ্জিত হয়ো না। আমার কাছে ধরা পড়া তোমাদের পক্ষে কিছুমাত্র লজ্জার কথা নয়। কিন্তু বালক হয়ে তোমরা আমাকে ঠকাবে মনে করেছিলে, এতেই আমার ভারি আমোদ বোধ হচ্ছে।”

আমরা নির্বাক হইয়া রহিলাম। কর্তা ব্যোমকেশের মাথার দিকে কিছুক্ষণ চক্ষু রাখিয়া বলিলেন, “ব্যোমকেশবাবু, তোমার কাছ থেকে আমি এতটা নির্বুদ্ধিতা প্রত্যাশা করিনি। তুমি ছেলেমানুষ বটে, কিন্তু তোমার করোটির গঠন থেকে বুঝতে পারছি তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে।”

ব্যোমকেশের মুণ্ডের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া কতকটা নিজ মনেই বলিতে লাগিলেন, “খুলির মধ্যে অন্তত পঞ্চান্ন আউন্স ব্রেন ম্যাটার আছে। তবে ব্রেন ম্যাটার থাকলেই শুধু হয় না, কনভল্যুশনের উপর সব নির্ভর করে। … হনু আর চোয়াল উঁচু মৃদঙ্গ মুখ, বাঁকা নাক, হুঁ। ত্বরিতকর্মা, কূতবুদ্ধি, একগুঁয়ে। ইনট্যুশন খুব বেশি; রিজনিং পাওয়ার মন্দ ডেভেলপড নয় কিন্তু এখনও ম্যাচিয়োর করে নি। তবে মোটের উপর বুদ্ধির বেশ শৃঙ্খলা আছে – বুদ্ধিমান বলা চলে।”

আমার মনে হইল, জীবন্ত ব্যোমকেশের শব ব্যবচ্ছেদ হইতেছে, তাহার মস্তিষ্ককে কাটিয়া চিরিয়া ওজন করিয়া তাহার মূল্য নির্ণয় করা হইতেছে এবং আমি দাঁড়াইয়া তাহাই দেখিতেছি।

স্বগত চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া কর্তা বলিলেন, “আমার মাথায় কতখানি মস্তিষ্ক আছে জানো? ষাট আউন্স – তোমার চেয়ে পাঁচ আউন্স বেশি। অর্থাৎ বনমানুষে আর সাধারণ মানুষে বুদ্ধির যতখানি তফাত তোমার সঙ্গে আমার বুদ্ধির তফাত তার চেয়েও বেশি।”

ব্যোমকেশ নিশ্চল হইয়া বসিয়া হরিল, তাহার মুখে কোনও বিকার দেখা গেল না। কর্তা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন; তারপর হথাৎ গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “খোকা তোমাকে পাঠিয়েছে একটা জিনিস চুরি করবার জন্য। কিন্তু তুমি পারবে বলে মনে হয়?”

এবারও ব্যোমকেশ কোনও উত্তর করিল না। তাহার নির্বিকার নীরবতা লক্ষ করিয়া কর্তা শ্লেষ করিয়া কহিলেন, “কি হে ব্যোমকেশবাবু, একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে যে। বলি, এত বড় একটা কাজ হাতে নিয়েছ, পুরুত সেজে ঠাকুর চুরি করতে ঢুকেছ – তা কি রকম মনে হচ্ছে? পারবে চুরি করতে?”

ব্যোমকেশ শান্তস্বরে কহিল, “সাত দিনের মধ্যে কুমার বাহাদুরের জিনিস তাঁকে ফিরিয়ে দেব কথা দিয়ে এসেছি।”

0 Shares