সীমান্ত-হীরা

মৃদুমন্দ হাস্য করিয়া স্যর দিগিন্দ্র বলিলেন, “আমার তৈরি নটরাজ মূর্তির নাম শুনেছ তো? এটা তারই একটা ছোট প্ল্যাস্টার কাস্ট তৈরি করছি। আর একটা আমার টেবিলের উপর রাখা আছে, দেখে থাকবে। কাগজ চাপা হিসেবে জিনিসটা মন্দ নয় – কি বল?”

মনে পড়িল, স্যর দিগিন্দ্রের বসিবার ঘরে টেবিলের উপর একটি অতি সুন্দর ছোট নটরাজ মহাদেবের মূর্তি দেখিয়াছিলাম। ওটা তখনই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল, কিন্তু উহাই যে স্যর দিগিন্দ্রের নির্মিত বিখ্যাত মূর্তির মিনিয়েচার, তাহা তখন কল্পনা করি নাই।

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “ঐ মূর্তিটাই আপনি প্যারিসে একজিবিট করিয়েছিলেন!”

স্যর দিগিন্দ্র তাচ্ছিল্যভরে বলিলেন, “হঁযা। আসল মূর্তিটা পাথরের গড়া – সেটা এখনও ল্যুভরে আছে।”

ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। লোকটার সর্বতোমুখী অসামান্যতা আমাকে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছিল; তাই ব্যোমকেশ যখন সিন্দুক খুলিয়া তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে লাগিল, আমি চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। এত বড় একটা প্রতিভার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়ের আশা কোথায়?

অনুসন্ধান শেষ করিয়া ব্যোমকেশ নিশ্বাস ছড়িয়া বলিল, “নাঃ, কিছু নেই। চল, বাইরের ঘরে একটু বসা যাক।”

বসিবার ঘরে ফিরিয়া দেখিলাম স্যর দিগিন্দ্র ইতিমধ্যে আসিয়া বসিয়াছেন এবং মুখের অনুযায়ী একটি স্থূল চুরুট দাঁতে চাপিয়া ধূম উদ্গীরণ করিতেছেন। আমরা বসিলে তিনি ব্যোমকেশের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন, “পেলে না? আচ্ছা, কুছ পরোয়া নেই। একটু জিরিয়ে নাও, তারপর আবার খুঁজো।” ব্যোমকেশ নিঃশব্দে চাবির গোছা ফেরত দিল; সেটা পকেটে ফেলিয়া আমার পানে ফিরিয়া স্যর দিগিন্দ্র কহিলেন, “ওহে অজিতবাবু, তুমি তো গল্প টল্প লিখে থাকো; সুতরাং একজন বড় দরের আর্টিস্ট! বলো দেখি এ পুতুলটি কেমন?” বলিয়া সেই নটরজ মূর্তিটি আমার হাতে দিলেন।

ছয় ইঞ্চি লম্বা এবং ইঞ্চি তিনেক চওড়া মূর্তিটি। কিন্তু ঐটুকু পরিসরের মধ্যে কি অপূর্ব শিল্প প্রতিভাই না প্রকাশ পাইয়াছে! নটরাজের প্রলয়ঙ্কর নৃত্যোন্মাদনা যেন ঐ ক্ষুদ্র মূর্তির প্রতি অঙ্গ অঙ্গ হইতে মথিত হইয়া উঠিতেছে। কিছুক্ষণ মুগ্ধভাবে নিরীক্ষণ করিবার পর আপনিই মুখ দিয়া বাহির হইল, “চমৎকার! এর তুলনা নেই।”

ব্যোমকেশ নিস্পৃহভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “এটাও কি আপনি নিজে মোল্ড করেছেন?”

একরাশি দূম উদ্গীর্ণ করিয়া স্যর দিগিন্দ্র বলিলেন, “হঁযা। আমি ছাড়া আর কে করবে?”

ব্যোমকেশ মূর্তিটা আমার হাত হইতে লইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে দেখিতে বলিল, “এ জিনিস বাজারে পাওয়া যায় না বোধ হয়?”

স্যর দিগিন্দ্র বলিলেন, “না। কেন বল দেখি? পাওয়া গেলে কিনতে না কি?”

“বোধ হয় কিনতুম। আপনিই এই রকম প্ল্যাস্টার কাস্ট তৈরি করিয়ে বাজারে বিক্রি করেন না কেন? আমার বিশ্বাস এতে পয়সা আছে।”

“পয়সার যদি কখনও অভাব হয় তখন দেখা যাবে। আপাতত জিনিসটাকে বাজারে বিক্রি করে খেলো করতে চাই না।”

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, “এখন তাহলে উঠি। আবার ও বেলা আসব।” বলিয়া মূর্তিটা ঠক করিয়া টেবিলের উপর রাখিল।

স্যর দিগিন্দ্র চমকিয়া বলিয়া উঠিলেন, “তুমি তো আচ্ছা বেকুব হে। এখনই ওটি ভেঙেছিলে!”

তারপর বাঘের মতো ব্যোমকেশের দিকে তাকাইয়া রুদ্ধ গর্জনে বলিলেন, “তোমাদের একবার সাবধান করে দিয়েছি, আবার বলছি, আমার কোন ছবি বা মূর্তি যদি ভেঙেছ, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বার করে দেব, আর ঢুকতে দেব না। বুঝেছে?”

ব্যোমকেশ অনুতপ্তভাবে মার্জনা চাহিলে তিনি ঠাণ্ডা হইয়া বলিলেন, “এইসব সুকুমার কলার অযত্ন আমি দেখতে পারি না। যা হোক ও বেলা তাহলে আবার আসচ? বেশ কথা, উদ্যোগিনাং পুরুষসিংহ; এবার বাড়ির কোন দিকটা খুঁজবে মনস্থ করেছ? বাগান কুপিয়ে যদি দেখতে চাও, তারও বন্দোবস্ত করে রাখতে পারি।”

বিদ্রুপবাণ বেবাক হজম করিয়া আমরা বাহিরে আসিলাম। রাস্তায় পড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, “চল, এতক্ষণে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি খুলেছে, একবার ওদিকটা ঘুরে যাওয়া যাক। একটু দরকার আছে।”

ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে গিয়া ব্যোমকেশ বিলাতি বিশ্বকোষ হইতে প্ল্যাস্টার কাস্টিং অংশটা খুব মন দিয়া পড়িল। তারপর বই ফিরাইয়া দিয়া বাহির হইয়া আসিল। লক্ষ করিলাম, কোনও কারণে সে বেশ একটু উত্তেজিত হইয়াছে। বাড়ি পৌঁছিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হে, প্ল্যাস্টার কাস্টিং সম্বন্ধে এত কৌতূহল কেন?”

ব্যোমকেশ বলিল, “তুমি তো জানো, সকল বিষয়ে কৌতূহল আমার একটা দুর্বল্তা।”

“তা তো জানি। কিন্তু কি দেখলে?”

“দেখলুম প্ল্যাস্টার কাস্টিং খুব সহজ, যে কেউ করতে পারে। খানিকটা প্ল্যাস্টার অফ প্যারিস জলে গুলে যখন সেটা দইয়ের মতো ঘন হয়ে আসবে, তখন মাটির বা মোমের ছাঁচের মধ্যে আস্তে আস্তে ঢেলে দাও। মিনিট দশেকের মধ্যেই সেটা জমে শক্ত হয়ে যাবে, তখন ছাঁচ থেকে বার করে নিলেই হয়ে গেল। ওর মধ্যে শক্ত যা কিছু ঐ ছাঁচটা তৈরি করা।”

“এই! তা এর জন্য এত দুর্ভাবনা কেন?”

“দুর্ভাবনা নেই। ছাঁচে প্ল্যাস্টার অফ প্যারিস ঢালবার সময় যদি একটা সুপুরি কি ঐ জাতীয় কোনও শক্ত জিনিস সেই সঙ্গে ঢেলে দেওয়া যায়, তাহলে সেটা মূর্তির মধ্যে রয়ে যাবে।”

“অর্থাৎ?”

কৃপাপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া ব্যোমকেশ বলিল, “অর্থাৎ বুঝ লোক যে জান সন্ধান।”

বৈকালে আবার স্যর দিগিন্দ্রের বাড়িতে গেলাম। এবারও তন্ন তন্ন করিয়া বাড়িখানা খোঁজা হইল, কিন্তু কোনই ফল হইল না। স্যর দিগিন্দ্র মাঝে মাঝে আসিয়া আমাদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করিয়া যাইতে লাগিলেন। অবশেষে যখন ক্লান্ত হইয়া আমরা বসিবার ঘরে আসিয়া উপবিষ্ট হইলাম, তখন তিনি আমাদের ভারি পরিশ্রম হইয়াছে বলিয়া চা ও জলখাবার আনাইয়া দিয়া আমাদের প্রতি আতিথ্যের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া দিলেন। আমার ভারি লজ্জা করিতে লাগিল, কিন্তু ব্যোমকেশ একেবারে বেহায়া – সে অম্লানবদনে সমস্ত ভোজ্যপেয় উদরসাৎ করিতে করিতে অমায়িকভাবে স্যর দিগিন্দ্রের সহিত গল্প করিতে লাগিল।

স্যর দিগিন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর কত দিন চালাবে? এখনও আশ মিটল না?”

ব্যোমকেশ বলিল, “আজ বুধবার। এখনও দু’দিন সময় আছে।”

স্যর দিগিন্দ্র অট্টহাস্য করিতে লাগিলেন। ব্যোমকেশ ভ্রুক্ষেপ না করিয়া টেবিলের উপর হইতে নটরাজের পুতুলটা তুলিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এটা কত দিন হল তৈরী করেছেন?”

ভ্রুকুটি করিয়া স্যর দিগিন্দ্র চিন্তা করিলেন, পরে বলিলেন, “দিন পনের কুড়ি হবে। কেন?”

“না- অমনি। আচ্ছা, আজ উঠি। কাল আবার আসব। নমস্কার।” বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

বাড়ি ফিরিতেই চাকর পুঁটিরাম একখানা খাম ব্যোমকেশের হাতে দিযা বলিল, “একজন তকমা পরা চাপরাসি দিয়ে গেছে।”

খামের ভিতর শুধু একটি ভিজিটিং কার্ড, তাহার এক পিঠে ছাপার অক্ষরে লেখা আছে, কুমার ত্রিদিবেন্দ্রনারায়ণ রায়। অন্য পিঠে পেনসিল দিয়া লেখা, “এইমাত্র কলিকাতায় পৌঁছিয়াছি। কত দূর?”

ব্যোমকেশ কার্ডখানা টেবিলের এক পাশে রাখিয়া দিয়া আরাম কেদারায় বসিয়া পড়িল; কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া চুপ করিয়া রহিল। কুমার বাহাদুর হঠাৎ আসিয়া পড়ায় সে মনে মনে খুশি হয় নাই বুঝিলাম। প্রশ্ন করাতে সে বলিল, “এক পক্ষের উৎকণ্ঠা অনেক সময় অন্য পক্ষে সঞ্চারিত হয়। কুমার বাহাদুরের আসার ফলে বুড়ো যদি ভয় পেয়ে মতলব বদলায়, তা হলেই সব মাটি। আবার নতুন করে কাজ আরম্ভ করতে হবে।”

সমস্ত সন্ধ্যাটা সে একভাবে আরাম চেয়ারে পড়িয়া রহিল। রাত্রে আমরা দু’জনে একই ঘরে দুইটি পাশাপাশি খাটে শয়ন করিতাম, বিছানায় শুইয়া অনেকক্ষণ গল্প চলিত। আজ কিন্তু ব্যোমকেশ একটা কথাও কহিল না। আমি কিছুক্ষণ এক তরফা কথা কহিয়া শেষে ঘুমাইয়া পড়িলাম।

ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিতেছিলাম যে আমি, ব্যোমকেশ ও স্যর দিগিন্দ্র হীরার মার্বেল দিয়া গুলি খেলিতেছি, মার্বেলগুলি ব্যোমকেশ সমস্ত জিতিয়া লইয়াছি, স্যর দিগিন্দ্র মাঠিতে পা ছড়াইয়া বসিয়া চোখ রগড়াইয়া কাঁদিতেছেন, এমন সময় চমকিয়া ঘুম ভাঙিয়া গেল।

চোখ খুলিয়া দেখিলাম, ব্যোমকেশ অন্ধকারে আমার খাটের পাশে বসিয়া আছে। আমার নিশ্বাসের শব্দে বোধহয় বুঝিতে পারিল আমি জাগিয়াছি, বলিল, “দেখ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হিরেটা বসবার ঘরে টেবিলের উপর কোনখানে আছে।”

জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাত্রি ক’টা?”

ব্যোমকেশ বলিল, “আড়াইটে। তুমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ? বুড়ো বসবার ঘরে ঢুকেই প্রথমে টেবিলের দিকে তাকায়।”

0 Shares