সীমান্ত-হীরা

ব্যোমকেশ বিনীতভাবে বলিল, “আপনার উপর অনেক জুলুম করেছি, কিন্তু আর করব না, এই কথাটি আজ জানাতে এলুম। জয় পরাজয় এক পক্ষের আছেই, সে জন্য দুঃখ করা মূঢ়তা। কাল থেকে আর আমাদের দেখতে পাবেন না। আপনি অবশ্য জানেন যে, আপনার ভাইপো এখানে গ্র্যাণ্ড হোটেলে এসে আছেন – তাঁকে কাল একরকম জানিয়েই দিয়েছি যে তাঁর এখানে থেকে আর কোনও লাভ নেই। আজ তাঁকে শেষ জবাব দিয়ে যাব।”

স্যর দিগিন্দ্র কিছুক্ষণ কুঞ্চিত চক্ষে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিলেন; ক্রমে তাঁহার মুখে সেই বুলডগ হাসি ফুটিয়া উঠিল, বলিলেন, “তোমার সুবুদ্ধি হয়েছে দেখে খুশি হলাম। খোকাকে বোলো বৃথা চেষ্টা করে যেন সময় নষ্ট না করে।”

“আচ্ছা বলব।” টেবিলের উপর আর একটি নটরাজ মূর্তি রাখা হইয়াছে দেখিয়া সেটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ বলিল, “এই যে আর একটা তৈরি করেছেন দেখছি। আপনার উপহারটি আমি যত্ন করে রেখেছি; শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, আপনার স্মৃতি চিহ্ন হিসাবেও আমার কাছে তার দাম অনেক। কিন্তু যদি কখনও দৈবাৎ ভেঙে যায়, আর একটা পাব কি?”

স্যর দিগিন্দ্র প্রসন্নভাবে বলিলেন, “বেশ, যদি ভেঙে যায়, আর একটি পাবে। আমার বাড়িতে ঢুকে তোমার শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ জন্মেছে এটাও কম লাভ নয়।”

গভীর বিনয় সহকারে ব্যোমকেশ বলোক, “আজ্ঞে হঁযা। এত দিন আমার মনের ওদিকটা একেবারে পর্দা ঢাকা ছিল। কিন্তু এই ক’দিন আপনার সংসর্গে এসে ললিত কলার রস পেতে আরম্ভ করেছি, বুঝেছি, ওর মধ্যে কি অমূল্য রত্ন লুকোনো আছে – ঐ ছবিখানাও আমার বড় ভালো লাগে। ওটা কি আপনারই আঁকা?”

স্যর দিগিন্দ্রের পশ্চাতে দেয়ালের গায়ে একটা সুন্দর নিসর্গ দৃশ্যের ছবি টাঙানো ছিল, ব্যোমকেশ অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল।

মুহূর্তের জন্য স্যর দিগিন্দ্র ঘাড় ফিরাইলেন। সেই ক্ষণিক অবকাশে ব্যোমকেশ এক অদ্ভুত হাতের কসরত দেখাইল। টিকটিকি যেমন করিয়া শিকার ধরে, তেমনি ভাবে তাহার একটা হাতে টেবিলের উপর হইতে নটরাজ মূর্তিটি তুলিয়া লইয়া পকেটে পুরিল এবং অন্য হাতটা সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নটরাজ মূর্তি তাহার স্থানে বসাইয়া দিল। স্যর দিগিন্দ্র যখন আবার সম্মুখে ফিরিলেন, তখন ব্যোমকেশ পূর্ববৎ মুগ্ধভাবে দেয়ালের ছবিটার দিকে চাহিয়া আছে।

আমার বুকের ভিতরটা এমন অসম্ভব রকম ধড়ফড় করিতে লাগিল যে, স্যর দিগিন্দ্র যখন সহজ কণ্ঠে বলিলেন, “হঁযা, ওটা আমারই আঁকা,” তখন কথাগুলো আমার কানে অত্যন্ত অস্পষ্ট ও দূরাগত বলিয়া মনে হইল। ভাগ্যে সে সময় তিনি আমার মুখের প্র্তি দৃষ্টিপাত করেন নাই, নতুবা ব্যোমকেশের হাতের কসরত হয় তো আমার মুখের উদ্বেগ হইতেই ধরা পড়িয়া যাইত।

ব্যোমকেশ ধীরে সুস্থে উঠিয়া বলিল, “এখন তাহলে আসি। আপনার সংসর্গে এসে আমার লাভই হয়েছে, এ কথা আমি কখনও ভুলব না। আশা করি, আপনিও আমাদের ভুলতে পারবেন না। যদি কখনও দরকার হয়, মনে রাখবেন, আমি একজন সত্যাণ্বেষী, সত্যের অনুসন্ধান করাই আমার পেশা। চল অজিত। আচ্ছা, চললুম তবে, নমস্কার।”

দরজার নিকট হইতে একবার ফিরিয়া দেখিলাম স্যর দিগিন্দ্র ভ্রুকুটি করিয়া সন্দেহ প্রখর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চাহিয়া আছেন, যেন ব্যোমকেশের কথার কোন একটা অতি গূঢ় ইঙ্গিত বুঝি বুঝি করিয়াও বুঝিতে পারিতেছেন না।

বাড়ির বাহিরে আসিতেই একটা খালি ট্যাক্সি পাওয়া গেল; তাহাতে চাড়িয়া বসিয়া ব্যোমকেশ হুকুম দিল, “গ্র্যাণ্ড হোটেল।”

আমি তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলাম, “ব্যোমকেশ, এসব কি কাণ্ড?”

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, “এখনও বুঝতে পারছ না, এই আশ্চর্য। আমি যে অনুমান করেছিলুম হিরেটা নটরাজের মধ্যে আছে, তা ঠিকই আন্দাজ করেছিলুম। বুড়ো বুঝতে পেরে আমাকে ধোঁকা দেবার জন্যে পুতুলটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তারপর আর একটা ঠিক ঐ রকম মূর্তি তৈরি করে কাল সন্ধ্যাবেলা গিয়ে আসলটার সঙ্গে বদল করে এনেছিল। যদি এই অস্পষ্ট ‘ব’ অক্ষরটি লেখা না থাকত, তাহলে আমি জানতেও পারতুম না।” বলিয়া পুতুলটা উল্টাইয়া দেখাইল। দেখিলাম, পেন্সিলে লেখা অক্ষরটি বিদ্যমান রহিয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল, “কাল যখন এই ‘ব’ অক্ষরটি যথাস্থানে দেখতে পেলুম না, তখন এক নিমেষে সমস্ত ব্যাপার আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। আজ প্রথমে গিয়েই বুড়োর টেবিল থেকে নটরাজটি উলটে দেখলুম, আমার সেই ‘ব’ মার্কা নটরাজ। অন্য মূর্তিটা পকেটেই ছিল। ব্যস! তারপর হাত সাফাই তো দেখতেই পেলে।”

আমি রুদ্ধশ্বাসে বলিলাম, “তুমি ঠিক জানো, হিরেটা ওর মধ্যেই আছে?”

“হঁযা। ঠিক জানি, কোন সন্দেহ নেই।”

“কিন্তু যদি না থাকে?”

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, শেষে বলিল, “তাহলে বুঝব, পৃথিবীতে সত্য বলে কোনও জিনিস নেই। শাস্ত্রের অনুমান খণ্ডটা একেবারে মিথ্যা।”

গ্র্যাণ্ড হোটেলে কুমার ত্রিদিবেন্দ্র একটা আস্ত স্যুট ভাড়া করিয়া ছিলেন, আমরা তাঁহার বসিবার ঘরে পদার্পণ করিতেই তিনি দুই হাত বাড়াইয়া ছুটিয়া আসিলেন, “কি? কি হল, ব্যোমকেশবাবু?”

ব্যোমকেশ নিঃশব্দে নটরাজ মূর্তিটি টেবিলের উপর রাখিয়া তাহার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল।

হতবুদ্ধিভাবে কুমার বাহাদুর বলিলেন, “এটা তো দেখছি কাকার নটরাজ, কিন্তু আমার সীমন্ত হীরা – ”

“ওর মধ্যেই আছে।”

“ওর মধ্যে?”

“হঁযা, ওরই মধ্যে। কিন্তু আপনার যাবার বন্দোবস্ত সব ঠিক আছে তো? সাড়ে দশটার সময় আপনার স্পেশাল ছাড়বে।”

কুমার বাহাদুর অস্থির হইয়া বলিলেন, “কিন্তু আমি যে কিছু বুঝতে পারছি না। ওর মধ্যে আমার সীমন্ত হীরা আছে, কি বলছেন?”

“বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ, পরীক্ষা করে দেখুন।”

একটা পাথরের কাগজ চাপা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ মূর্তিটার উপর সজোরে আঘাত করিতেই সেটা বহু খণ্ডে চূর্ণ হইয়া গেল।

“এই নিন আপনার সীমন্ত হীরা।” ব্যোমকেশ হীরাটা তুলিয়া ধরিল, তাহার গায়ে তখনও প্ল্যাস্টার জুড়িয়া আছে, কিন্তু বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, ওটা সত্যই হীরা বটে।

কুমার বাহাদুর ব্যোমকেশের হাত হইতে হীরাটা প্রায় কাড়িয়া লইলেন; কিছুক্ষণ একাগ্র নির্নিমেষ দৃষ্টিতে হাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া মহোল্লাসে বলিয়া উঠিলেন, “হঁযা, এই আমার সীমন্ত হীরা। এই যে এর ভিতর থেকে নীল আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। ব্যোমকেশবাবু, আপনাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব -”

“কিছু বলতে হবে না, আপাতত যত শীঘ্র পারেন বেরিয়ে পড়ুন। খুড়োমশাই যদি ইতিমধ্যে জানতে পারেন, তাহলে আবার হীরা হারাতে কতক্ষণ?”

“না না, আমি এখনই বেরুচ্ছি। কিন্তু আপনার -”

কুমার বাহাদুরকে স্টেশনে রওনা করিয়া দিয়া আমরা বাসায় ফিরিলাম। আরাম কেদারায় অঙ্গ ছড়াইয়া দিয়া ব্যোমকেশ পরম সার্থকতার হাসি হাসিয়া বলিল, “আমি শুধু ভাবছি, বুড়ো যখন জানতে পারবে, তখন কি করবে?”

দিন কয়েক পরে কুমার বাহাদুরের নিকট হইতে একখানি ইন্সিওর করা খাম আসিল। চিঠির সঙ্গে একখানি চেক পিন দিয়া আঁটা। চেক-এ অঙ্কের হিসাবটা দেখিয়া চক্ষু ঝলসিয়া গেল। পত্রখানি এইরূপ –

প্রিয় ব্যোমকেশবাবু,

আমার চিরন্তন কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ যাহা পাঠাইলাম, জানি আপনার প্রতিভার তাহা যোগ্য নহে। তবু, আশা করি আপনার অমনোনীত হইবে না। ভবিষ্যতে আপনার সহিত সাক্ষাতের প্রত্যাশায় রহিলাম। এবার যখন কলিকাতায় যাইব, আপনার মুখে সমস্ত বিবরণ শুনিব।

অজিতবাবুকেও আমার ধন্যবাদ জানাইবেন। তিনি সাহিত্যিক, সুতরাং টাকার কথা তুলিয়া তাঁহার সাস্বত সাধনার অমর্যাদা করিতে চাই না। [হায় রে পোড়াকপালে সাহিত্যিক!] কিন্তু যদি তিনি নাম ধাম বদল করিয়া এই হীরা হরণের গল্পটা লিখিতে পরেন, তাহা হইলে আমার কোনও আপত্তি নাই জানিবেন। শ্রদ্ধা ও নমস্কার গ্রহণ করিবেন।

ইতি
প্রতিভামুগ্ধ
শ্রীত্রিদিবেন্দ্রনারায়ণ রায়

(সমাপ্ত)

0 Shares