হেঁয়ালির ছন্দ

‘আজ সকালে থানায় যাচ্ছিলাম‌, যদি থানায় গিয়ে কিছু নতুন খবর পাই এই আশায়। বেরুবার সময় মনে হল‌, দেখি তো গলির মধ্যে নটবরের জানলার কাছে কোনো চিহ্ন পাই কিনা।

‘চিহ্ন পেলাম। ঠিক নটবরের জানলার নীচে ইট-বাঁধানো মেঝের ওপর পাটকা ফাটার পাশুটে দাগ। শুঁকে দেখলাম অল্প বারুদের গন্ধও রয়েছে। আর সন্দেহ রইল না। চমৎকার একটি অ্যালিবাই সাজানো হয়েছে। কে অ্যালিবাই সাজিয়েছে? ভূপেশবাবু ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। কারণ তিনিই জানলা খুলেছিলেন। রাসবিহারী এবং বনবিহারী জানলার কাছে এসেছিলেন আওয়াজ হওয়ার পরে।

‘সেদিন সন্ধ্যে ছাঁটার সময় ভূপেশবাবু অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে নিঃশব্দে নীচে নেমে গিয়েছিলেন। পিস্তল আগে থাকতেই যোগাড় করা ছিল‌, তিনি নটবরের ঘরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে গুলি করলেন। গলির দিকের জানলা খুলে দিয়ে সেখানে পিস্তল রেখে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। ভাগ্যক্রমে কেউ তাঁর যাতায়াত দেখতে পেল না। কিন্তু যদি কেউ দেখে ফেলে থাকে তাই অ্যালিবাই দরকার। তিনি নিজের ঘরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। দশ মিনিট পরে রাসবিহারী ও বনবিহারী তাস খেলতে এলেন। কিন্তু অজিত তখনো আসেনি‌, তাই তিনজনে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

‘তারপর ভূপেশবাবু সিঁড়িতে অজিতের চটির ফট্‌ফট্‌ শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি তৈরি ছিলেন‌, তাঁর মুঠোর মধ্যে ছিল একটি মার্বেলের মত পটকা। ঘরের বন্ধ হাওয়ার অজুহাতে তিনি গলির দিকের জানলা খুলে দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুঠি থেকে পটকাটি জানলার বাইরে ফেলে দিলেন। নীচে দুম করে শব্দ হল। রাসবিহারী ও বনবিহারী ছুটে জানলার কাছে গেলেন; ভূপেশবাবু তাঁদের বাদামী আলোয়ান গায়ে কাল্পনিক আততায়ী দেখালেন।

‘তারপর ভূপেশবাবুকে আর কিছু করতে হল না; স্বাভাবিক নিয়মে যথাসময়ে লাশ আবিষ্কৃত হল। পুলিস এল‌, লাশ নিয়ে চলে গেল। যবনিকা পতন।’

ব্যোমকেশ চুপ করিল। ভূপেশবাবু এতক্ষণ নির্বাত নিষ্কম্প বসিয়া শুনিতেছিলেন‌, এখনো নিশ্চল বসিয়া রছিলেনন। ব্যোমকেশ তাঁহার পানে ভ্রূ বাঁকাইয়া বলিল‌, ‘কোথাও ভুল পেলেন কি?’

ভূপেশবাবু এবার নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন‌, স্মিতমুখে মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘না‌, ভুল পাইনি। ভুল আমিই করেছিলাম‌, ব্যোমকেশবাবু। আপনি যে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম আপনি ফিরে আসতে আসতে নটবরের মামলা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল‌, বলিল‌, ‘দুটো প্রশ্নের উত্তর পাইনি। এক‌, আপনার মোটিভ কি। দুই‌, পিস্তলের আওয়াজ চাপা দিলেন কেমন করে। বন্ধ ঘরের মধ্যে পিস্তল ছুড়লেও আওয়াজ বাইরে যাবার সম্ভাবনা। এ বিষয়ে আপনি কি কোনো সতর্কতাই অবলম্বন করেননি?’

‘দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দিচ্ছি’–ভূপেশবাবু কাঁধ হইতে পাট-করা শাল লইয়া দুই হাতে আমাদের সামনে মেলিয়া ধরিলেন; দেখিলাম নুতন শালের গায়ে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র রহিয়াছে। তিনি বলিলেন, ‘এই শাল গায়ে জড়িয়ে নটবরের ঘরে গিয়েছিলাম, শালের ভিতর হাতে পিস্তলছিল। নটবরকে শালের ভিতর থেকে গুলি করেছিলাম; গুলির আওয়াজ শালের মধ্যেই চাপা পড়েছিল‌, বাইরে যেতে পারেনি।’

ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়িল। বলিল‌, ‘আর প্রথম প্রশ্নের উত্তর? আমি কতকটা আন্দাজ করেছি; কাল আপনি ছেলের ফটো দেখিয়েছিলেন। যাহোক‌, আপনি বলুন।’

ভূপেশবাবুর কপালের শিরা দপদপ করিয়া উঠিল‌, কিন্তু তিনি সংযত স্বরেই বলিলেন‌, ‘ছেলের ফটো দেখিয়েছিলাম‌, কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি সত্য আবিষ্কার করবেন। তাই আগে থেকে নিজের সাফাই গেয়ে রেখেছিলাম। ঢাকায় যেদিন দাঙ্গা বাধে সেদিন নটবর আমার ছেলেকে স্কুল থেকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যের পর সে আমার বাসায় এসে বলল‌, দশ হাজার টাকা পেলে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারে। নগদ দশ হাজার টাকা আমার কাছে ছিল না; যা ছিল সব দিলাম‌, আমার স্ত্রী গায়ের সমস্ত গয়না খুলে দিলেন। নটবর সব নিয়ে চলে গেল‌, কিন্তু আমি ছেলেকে ফিরে পেলাম না। নটবরের দেখাও আর পেলাম না। তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে‌, আমি স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে কলকাতায় চলে এসেছি‌, হঠাৎ একদিন রাস্তায় নটবরকে দেখতে পেলাম। তারপর-?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বুঝেছি। আর বলবার প্রয়োজন নেই‌, ভূপেশবাবু।’

ভূপেশবাবু কিছুক্ষণ নিশ্চেষ্ট থাকিয়া শেষে বলিলেন‌, ‘এখন আমার সম্বন্ধে আপনি কি করতে চান?’

ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বদিকে ক্ষণেক চাহিয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘সাহিত্য সম্রাট শরৎচন্দ্র কোথায় যেন একবার বলেছিলেন‌, ‘দাঁড় কাক মারলে ফাঁসি হয় না।’ আমার বিশ্বাস শকুনি মারলেও ফাঁসি হওয়া উচিত নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

(সমাপ্ত)

0 Shares