হেঁয়ালির ছন্দ

বলিলাম‌, আপনারা কি মাসতুত ভাই?

দু’জনে চমকিয়া চাহিলেন; রামবাবু ঈষৎ রুক্ষস্থরে বলিলেন‌, ‘না। আমি বৈদ্য‌, বনমালীবাবু কায়স্থ।’

অপ্রতিভ হইয়া পড়িলাম। আমতা আমতা করিয়া কৈফিয়ত দিবার চেষ্টা করিতেছি‌, ভূপেশবাবু এক প্লেট শিঙাড়া আনিয়া আমাকে উদ্ধার করিলেন। তারপর চা আসিল। তাড়াতাড়ি চা-পর্ব শেষ করিয়া আমরা খেলিতে বসিলাম। মাসতুত ভাই-এর প্রসঙ্গ চাপা পড়িয়া গেল।

খেলিতে বসিয়া দেখিলাম। এতদিন পরেও ব্রিজ খেলা ভুলি নাই; খেলার এবং ডাকের কলাকৌশল সবই আয়ত্তের মধ্যে আছে। সামান্য বাজি রাখিয়া খেলা‌, খেলার শেষে বড়জোর চার আনা লাভ লোকসান থাকে। কিন্তু এই বাজিটুকু না থাকিলে খেলার রস জমে না।

প্রথম রাবারে আমি ও রামবাবু জুড়িদার হইলাম। রামবাবু একটি মোটা চুরুট ধরাইলেন; ভূপেশবাবু ও আমি সিগারেট জ্বলিলাম‌, বনমালীবাবু কেবল সুপুরি-লবঙ্গ মুখে দিলেন।

তারপর খেলা চলিতে লাগিল। একটা রাবার শেষ হইলে তাস কাটিয়া জুড়িদার বদল করিয়া আবার খেলা চলিল। এঁরা তিনজনেই ভাল খেলোয়াড়; কথাবার্তা বেশি হইতেছে না‌, সকলের মনই খেলায় মগ্ন। কেবল সিগারেট ও সিগারের আগুন আনিবাণ জ্বলিতেছে। ভূপেশবাবু এক সময় উঠিয়া গিয়া জানোলা খুলিয়া দিয়া নিঃশব্দে আসিয়া বসিলেন।

খেলা শেষ হইল তখন রাত্ৰি নটা বাজিয়া গিয়াছে‌, মেসের চাকর দু’বার খাওয়ার তাগাদা দিয়া গিয়াছে। হারজিতের অঙ্ক কষিয়া দেখা গেল‌, আমি দুই আনা জিতিয়াছি। মহানন্দে জিতের পয়সা পকেটস্থ করিয়া উঠিয়া পড়িলাম। ভূপেশবাবু স্মিতমুখে বলিলেন, কাল আবার বসবেন তো?’

বলিলাম‌, ‘বসব।’

উপরে আসিয়া সত্যবতীর কাছে একটু বকুনি খাইলাম। শীত ঋতুতে রাত্রি সওয়া নটা কম নয়। কিন্তু অনেকদিন পরে ব্রিজ খেলিয়া মনটা ভরাট ছিল, সত্যবতীর বকুনি হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম।

অতঃপর প্রত্যহ আমাদের তাসের আড্ডা বসিতে লাগিল; ঘরে সন্ধ্যাবাতি জ্বালার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সভা বসে‌, রাত্ৰি নটা পর্যন্ত চলে। পাঁচ-ছয় দিনে এই তিনটি মানুষ সম্বন্ধে একটা ধারণা জন্মিল। ভূপেশবাবু সহৃদয় মিষ্টভাষী অতিথিবৎসল‌, ব্রিজ খেলার প্রতি গাঢ় অনুরাগ। রামবাবু একটু গভীর প্রকৃতির; বেশি কথা বলেন না‌, কেহ খেলায় ভুল করিলে তর্ক করেন না। বনমালীবাবু রামবাবুকে অতিশয় শ্রদ্ধা করেন‌, তাঁহার অনুকরণে ভারিক্কি হইবার চেষ্টা করেন‌, কিন্তু পারেন না। দু’জনেই অল্পভাষী; তাস খেলার প্রতি গভীর আসক্তি। দু’জনেরই কথায় সামান্য পূর্ববঙ্গের টান আছে।

ছয় দিন আনন্দে তাস খেলিতেছি‌, আমাদের আড়ড়া একটি চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবার উপক্রম করিতেছে‌, এমন সময় নীচের তলায় একটি মারাত্মক ব্যাপার ঘটিয়া আমাদের সভাটিকে টলমল করিয়া দিল। নীচের তলার একমাত্র বাসিন্দা নটবর নস্কর হঠাৎ খুন হইলেন। তাঁহার সহিত অবশ্য আমাদের কোনই সম্পর্ক ছিল না‌, কিন্তু মাঝগঙ্গা দিয়া জাহাজ যাইলে তাহার ঢেউ তীরে আসিয়া লাগে।

সেদিন-সাড়ে ছাঁটার সময় একটি র‍্যাপার গায়ে জড়াইয়া আমি আড্ডায় যাইবার জন্য বাহির হইলাম। আমার একটু দেরি হইয়া গিয়াছে‌, তাই সিঁড়ি দিয়া চটি ফটফটু করিয়া তাড়াতাড়ি নামিতেছি। শেষের ধাপে পৌঁছিয়ছি। এমন সময় দুম করিয়া একটি শব্দ শুনিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। শব্দটা কোথা হইতে আসিল ঠিক ঠাহর করিতে পারিলাম না। রাস্তায় হয়তো মোটর ব্যাক-ফায়ার করিয়াছে‌, কিন্তু বেশ জোর আওয়াজ। রাস্ত হইতে এত জোর আওয়াজ আসিবে না।

ক্ষণকাল থামিয়া আমি আবার নামিয়া ভূপেশবাবুর ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরে আলো জ্বলিতেছে, দেখিলাম ভূপেশবাবু পাশের দিকের জানালার গরাদ ধরিয়া দাঁড়াইয়া বাহিরের পানে কিছু দেখিতেছেন, রামবাবু ও বনমালীবাবু তাঁহার পিছন হইতে জানোলা দিয়া উঁকি মারিবার চেষ্টা করিতেছেন। আমি যখন প্রবেশ করিলাম‌, তখন ভূপেশবাবু উত্তেজিত স্বরে বলিতেছেন‌, ‘ঐ-ঐ-গলি থেকে বেরিয়ে গেল‌, দেখতে পেলেন? গায়ে বাদামী রঙের আলোয়ান–’

আমি পিছন হইতে বলিলাম‌, ‘কি ব্যাপার?’

সকলে ভিতর দিকে ফিরিলেন। ভূপেশবাবু বলিলেন‌, ‘আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন? এই জানালার নীচের গলি থেকে এল। সবেমাত্র জানালাটি খুলেছি অমনি নীচে দুম করে শব্দ। গলা বাড়িয়ে দেখলাম একটা লোক তাড়াতাড়ি গলি থেকে বেরিয়ে গেল।’

আমাদের বাসাবাড়িটি সদর রাস্তার উপর। বাড়ির পাশ দিয়া একটি ইট-বাঁধানো সরু কানা গলি বাড়ির খিড়কির সহিত সদর রাস্তার যোগসাধন করিয়াছে; বাসার চাকর-বাকির সেই পথে যাতায়াত করে। আমার একটু খটকা লাগিল। বলিলাম‌, ‘এই ঘরের নীচের ঘরে এক ভদ্রলোক থাকেন। তাঁর ঘর থেকে শব্দটা আসেনি তো?’

ভূপেশবাবু বলিলেন‌, ‘কি জানি। আমার ঘরের নীচে এক ভদ্রলোক থাকেন বটে‌, কিন্তু তাঁর নাম জানি না।

রামবাবু ও বনমালীবাবু মুখ তাকোতাকি করিলেন‌, তারপর রামবাবু গলা ঝাড়া দিয়া বলিলেন‌, নীচের ঘরে থাকেন নটবর নস্কর।’

বলিলাম‌, ‘চলুন। তিনি যদি ঘরে থাকেন‌, বলতে পারবেন কিসের আওয়াজ।’

ওঁদের তিনজনের বিশেষ আগ্রহ ছিল না‌, কিন্তু আমি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের বন্ধু‌, আমি শব্দের মূল অনুসন্ধান না করিয়া ছাড়িব কেন? বলিলাম‌, চলুন‌, চলুন‌, একবারটি দেখে এসেই খেলায় বসা যাবে। শব্দটি যদি স্বাভাবিক শব্দ হতো তাহলে কথা ছিল না‌, কিন্তু গলি দিয়ে একটা লোক এসে যদি নটবরবাবুর ঘরে চীনে-পাটুকা ছুঁড়ে থাকে তাহলেও তো খোঁজ নেওয়া দরকার।’

অনিচ্ছাভরে তিনজন আমার সঙ্গে চলিলেন।

নীচের তলায় ম্যানেজার শিবকালীবাবুর অফিসে তালা ঝুলিতেছে‌, স্টোর-রুমের দ্বারাও বন্ধ। ভোজনকক্ষটি খোলা আছে‌, কারণ সেখানে কয়েকটি কাঠের পিড়ি ছাড়া আর কিছুই নাই। কেবল নটবরবাবুর দরজা ভেজানো রহিয়াছে‌, বাহিরে তালা লাগানো নাই। সুতরাং তিনি ঘরেই আছেন। এরূপ অনুমান করা অন্যায় হইবে না। আমি ডাক দিলাম‌, নটবরবাবু!’

0 Shares