সাড়া নাই। আর একবার অপেক্ষাকৃত উচ্চকণ্ঠে ডাকিয়াও যখন উত্তর পাওয়া গেল না, তখন আমি আস্তে আস্তে দরজা ঠেলিলাম। দরজা একটু ফাঁক হইল।
ঘর অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না; কিন্তু একটা মৃদু গন্ধ নাকে আসিল। বারুদের গন্ধা! আমরা সচকিত দৃষ্টি বিনিময় করিলাম।
ভূপেশবাবু বললেন, ‘দোরের পাশে নিশ্চয় আলোর সুইচ আছে। দাঁড়ান, আমি আলো জ্বালছি।‘
তিনি আমাকে সরাইয়া ঘরের মধ্যে উঁকি মারিলেন, তারপর হাত বাড়াইয়া সুইচ খুঁজতে লাগিলেন। কট্ করিয়া শব্দ হইল, আলো জ্বলিয়া উঠিল।
মাথার উপর বিদ্যুতের নির্মম আলোকে প্রথম যে বস্তুটি চোখে পড়িল তোহা নটবরবাবুর মৃতদেহ। তিনি ঘরের মাঝখানে হাত-পা ছড়াইয়া চিত হইয়া পড়িয়া আছেন; পরিধানে সাদা সোয়েটার ও ধুতি। সোয়েটারের বুকের নিকট হইতে গাঢ় রক্ত গড়াইয়া পড়িয়াছে। নটবর নস্কর জীবিত অবস্থাতেও খুব সুদৰ্শন পুরুষ ছিলেন না, দোহারা পেটমোটা গোছের শরীর, হামদো মুখে গভীর বসন্তের দাগ, কিন্তু মৃত্যুতে তাঁহার মুখখানা আরো বীভৎস হইয়া উঠিয়াছে। সে বীভৎসতার বর্ণনা দিব না। মৃত্যুভয় যে কিরূপ কুৎসিত আবেগ তাহা তাঁহার মুখ দেখিয়া বোঝা যায়।
কিছুক্ষণ কাষ্ঠপুত্তলির ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকিবার পর রামবাবু গলার মধ্যে হেঁচুকি তোলার মত শব্দ করিলেন। দেখিলাম তিনি মোহাবিষ্ট অবিশ্বাস-ভরা চোখে মৃতদেহের প্রতি চাহিয়া আছেন। বনমালীবাবু হঠাৎ তাঁহার একটা হাত খামচাইয়া ধরিয়া রুদ্ধস্বরে বলিলেন, ‘দাদা, নটবর নস্কর মরে গেছে।’ তাঁহার অভিব্যক্তি দুঃখের কিংবা বিস্ময়ের কিংবা আনন্দের ঠিক ধরিতে পারিলাম না।
ভূপেশবাবু শুষ্কমুখে বলিলেন, ‘মরে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। বন্দুকের গুলিতে মরেছে!— ঐ যে। ঐ যে। জানালার ওপর দেখতে পাচ্ছেন?’
গরাদ-যুক্ত জানালা খোলা রহিয়াছে, তাহার পৈঁঠার উপর একটি পিস্তল। চিত্রটি স্পষ্ট হইয়া উঠিল : জানালার বাহিরের গলিতে দাঁড়াইয়া আততায়ী নটবর নস্করকে গুলি করিল, তারপর পিস্তলটি জানালার পৈঁঠার উপর রাখিয়া প্রস্থান করিল।
এই সময় পিছন দিকে দ্রুত পদশব্দ শুনিয়া ঘাড় ফিরাইলাম। মেসের ম্যানেজার শিবকালী চক্রবর্তী আসিতেছেন। তাঁহার চিমড়ে চেহারা, গতি অকারণে ক্ষিপ্র, চোখের দৃষ্টি অকারণে ব্যাকুল; কথা বলিবার সময় একই কথা একাধিকবার উচ্চারণ না করিয়া শান্তি পান না। তিনি। আমাদের কাছে আসিয়া বলিলেন, ‘আপনারা এখানে? এখানে? কি হয়েছে? কি হয়েছে?’
‘নিজের চোখেই দেখুন’—আমরা দ্বারের সম্মুখ হইতে সরিয়া দাঁড়াইলাম। শিবকালীবাবু রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখিয়া অতিকাইয়া উঠিলেন, ‘অ্যাঁ! এ কি-এ কি। নটবর নস্কর মারা গেছেন। রক্ত, রক্ত! কি করে মারা গেলেন?’
পিস্তল দেখিয়া শিবকালীবাবু আবার ত্ৰাসোক্তি করিলেন, ‘অ্যাঁ–পিস্তল–পিস্তল। পিস্তলের গুলিতে নটবরবাবু খুন হয়েছেন! কে খুন করেছে–কখন খুন করেছে?’
বলিলাম, ‘কে খুন করেছে জানি না, কিন্তু কখন খুন করেছে বলতে পারি। মিনিট পাঁচেক আগে।’
সংক্ষেপে পরিস্থিতি বুঝাইয়া দিলাম। তিনি ব্যাকুল নেত্ৰে মৃতদেহের পানে চাহিয়া রহিলেন।
এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই, হঠাৎ চোখে পড়িল, শিবকালীবাবুর গায়ে বাদামী রঙের আলোয়ান। বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল। বুকের ধড়ফড়ানি দমন করিয়া বলিলাম, ‘আপনি কি বাসায় ছিলেন না? বেরিয়েছিলেন?’
তিনি উদভ্ৰান্তভাবে বলিলেন, ‘অ্যাঁ–আমি কাজে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু–কিন্তু—এখন উপায়? কৰ্তব্য কী-কর্তব্য?’
বলিলাম, ‘প্রথম কর্তব্য পুলিসকে খবর দেওয়া।’
শিবকালীবাবু বলিলেন, ‘তাই তো, তাই তো। ঠিক কথা— ঠিক কথা! কিন্তু আমার তো টেলিফোন নেই। অজিতবাবু্, আপনাদের টেলিফোন আছে, আপনি যদি–
আমি বলিলাম, ‘এখনি পুলিসকে টেলিফোন করছি। — আপনারা কিন্তু ঘরে ঢুকবেন না, যতক্ষণ না পুলিস আসে এইখানে দাঁড়িয়ে থাকুন।’
আমি তাড়াতাড়ি উপরে উঠিয়া আসিলাম।। ঘরে প্রবেশ করিতে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব চোখে পড়িল। আমার গায়েও বাদামী রঙের আলোয়ান।
আমাদের পাড়ার তৎকালীন দারোগা প্রণব গুহ মহাশয়ের সহিত আমাদের পরিচয় ছিল। কর্মপটু বয়স্থ লোক, কিন্তু ব্যোমকেশের প্রতি তিনি প্রসন্ন ছিলেন না। অবশ্য তাঁহার প্রসন্নতা কোনো প্রকার বাক-পারুষ্য বা রূঢ়তার মাধ্যমে প্রকাশ পাইত না, ব্যোমকেশকে তিনি অতিরিক্ত সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক কথা বলিয়া কথার শেষে অনুচ্চস্বরে একটু হাসিতেন। বোধ হয় দুইজনের মনের ধাতুগত বিরোধ ছিল; তা ছাড়া সরকারী কার্যকলাপে বে-সরকারী স্কুল হস্তাবলোপ প্রণববাবু পছন্দ করিতেন না।
টেলিফোনে আমার বাত শুনিয়া তিনি ব্যঙ্গভরে বলিলেন, ‘বলেন কি! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা, সর্ষের মধ্যে ভূত! তা ব্যোমকেশবাবু যখন রয়েছেন তখন আমাকে আর কী দরকার? তিনিই তদন্ত করুন।’
বিরক্ত হইয়া বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ কলকাতায় নেই, থাকলে অবশ্য করত।’
প্রণব দারোগা বলিলেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, তাহলে আমি যাচ্ছি।’ খিক্ খিক্ হাস্য করিয়া তিনি ফোন রাখিয়া দিলেন। আমি আবার নীচের তলায় নামিয়া গেলাম।
আধা ঘণ্টা পরে প্রণববাবু দলবল লইয়া আসিলেন। আমাকে দেখিয়া খিক্ খিক্ হাসিলেন, তারপর গভীর হইয়া লাশ। তদারক করিলেন। জানালা হইতে পিস্তলটি রুমালে জড়াইয়া সন্তর্পণে পকেটে রাখিলেন। অবশেষে লাশ চালান দিয়া ঘরের একটি মাত্র চেয়ারে বসিয়া বাসার সকলকে জেরা আরম্ভ করিলেন।
আমি যাহা জানিতাম বলিলাম। বাকি সকলের বয়ান সংক্ষেপে লিখিতেছি।–