ম্যানেজার শিবকালীবাবু ব্রহ্মচারী ব্রতধারী পুরুষ, অর্থাৎ অবিবাহিত। পাঁচশ বছর ধরিয়া মেস চালাইতেছেন, সেই মেসই তাঁহার স্ত্রী-পুত্র পরিবার।…নটবর নস্কর প্রায় তিন বছর পূর্বে নীচের তলার এই ঘরটিতে বাসা বাঁধিয়াছিলেন, তদবধি এখানেই ছিলেন। তাঁহার বয়স অনুমান পঞ্চাশ, কাহারো সহিত বেশি মেলামেশা ছিল না। রামবাবু এবং বনমালীবাবু কালেভদ্রে তাঁহার ঘরে আসিতেন। শিবকালীবাবুর সহিত নটবর নস্করের অগ্ৰীতি ছিল না, কারণ নটবর প্রতি মাসের পয়লা তারিখে মেসের পাওনা চুকাইয়া দিতেন।–শিবকালীবাবু আজ বিকালে খবর পাইয়াছিলেন যে, কোনো এক গুদামে সস্তায় আলু পাওয়া যাইতেছে, তাই তিনি আলু কিনিতে গিয়াছিলেন। কিন্তু আলু পূর্বেই বিক্রি হইয়া গিয়াছিল, তাই তিনি শূন্য হাতে ফিরিয়া আসিয়াছেন।
ভূপেশবাবু বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেন, মাস দেড়েক হইল বদলি হইয়া কলিকাতায় আসিয়াছেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ, বিপত্নীক, নিঃসন্তান। গৃহ বলিতে কিছু নাই, কর্মসূত্রে ভারতের যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন। তাঁস খেলায় দল বাঁধা এবং আজ সন্ধ্যার ঘটনা ভূপেশবাবু যথাযথ বর্ণনা করিলেন, বাদামী আলোয়ান গায়ে লোকটারও উল্লেখ করিলেন। লোকটার মুখ তিনি ভাল করিয়া দেখিতে পান নাই, অপসারণশীল মানুষের মুখ পিছন হইতে দেখা যায় না; ভবিষ্যতে তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারিকেন এমন সম্ভাবনা কম।
রামচন্দ্র রায় ও বনমালী চন্দের এজাহার প্রায় একই প্রকার। লক্ষ্য করিলাম, রামবাবু ধীরস্থিরভাবে উত্তর দিলেও বনমালীবাবু একটু বিচলিত হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহারা পূর্বে ঢাকায় ছিলেন, একসঙ্গে একটি বিলাতি কোম্পানিতে চাকরি করিতেন। দেশ বিভাগের হাঙ্গামায় তাঁহাদের স্ত্রী-পুত্র পরিবার সকলেই নিহত হয়, তাঁহারা অতি কষ্ট্রে গুণ লইয়া পলুইয়া আসেন। রামবাবুর বয়স আটচল্লিশ, বনমালীবাবুর পয়তাল্লিশ। তাঁহারা কলিকাতায় আসিয়া এই মেসে আছেন এবং একটি ব্যাঙ্কে কাজ করিতেছেন। এইভাবে তিন বছর কাটিয়াছে।
তাঁহাদের ব্রিজ খেলার শখ আছে, কিন্তু কলিকাতায় আসার পর খেলার সুযোগ হয় নাই। কয়েকদিন আগে ভূপেশবাবু নিজের ঘরে ব্রিজ খেলার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; সেই অবধি বেশ আনন্দে সন্ধ্যা কাটিতেছিল। তারপর আজ তাঁহারা ভূপেশবাবুর ঘরে পদার্পণ করিবার পাঁচ মিনিট পরে হঠাৎ গলির মধ্যে দুম করিয়া আওয়াজ হইল!–নটবরবাবুর সহিত তাঁহাদের ঢাকায় আলাপ ছিল; সামান্য আলাপ, বেশি ঘনিষ্ঠতা নয়। নটবরবাবু ঢাকায় নানাপ্রকার দালালির কাজ করিতেন। এখানে একই মেসে থাকার জন্য তাঁহাদের মাঝে-মধ্যে দেখাশোনা হইত; রামবাবু ও বনমালীবাবু এই ঘরে আসিয়া গল্পসল্প করিতেন। নটবরবাবুর অন্য কোন বন্ধুবান্ধব আছে কিনা তাঁহারা জানেন না।–বাদামী আলোয়ান গায়ে লোকটাকে তাঁহারা গলির মোড়ে সন্ধ্যার আবছায়া আলোয় পালকের জন্য দেখিয়াছিলেন, আবার দেখিলে চিনিতে পারিবেন না।
মেসে অন্য যাঁহারা থাকেন তাঁহারা কেহ কিছু বলিতে পারিলেন না। দ্বিতলের অন্য প্রান্তে একটি ঘরে পাশার আডডা বসিয়াছিল; চারজন খেলুড়ে এবং আরো গুটিচারেক দর্শক সেখানে উপস্থিত ছিলেন; তাঁহারা বন্দুকের শব্দ শুনিতে পান নাই। মেসের কাহারো সঙ্গে নটবরবাবুর সামান্য মুখ চেনাচেনি ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক ছিল না।
কেবল মেসের ভূত্য হরিপদ একটা কথা বলিল যাহা অবান্তর হইতে পারে আবার অর্থপূর্ণ হইতে পারে। সন্ধ্যা ছয়টার সময় দ্বিতলের সুরেনবাবু হরিপদকে পাঠাইয়াছিলেন মোড়ের হোটেল হইতে আলুর চাপ কিনিয়া আনিতে। চপ কিনিয়া খিড়কির পথে ফিরিবার সময় হরিপদ শুনিতে পাইয়াছিল, নটবরবাবুর ঘরে কেহ আসিয়াছে এবং মৃদুগুঞ্জনে কথা বলিতেছে। নটবরবাবুর দরজা ভেজানো ছিল বলিয়া ঘরের ভিতর কে আছে হরিপদ দেখিতে পায় নাই; গলার স্বরও চিনিতে পারে নাই। নটবরবাবুর ঘরে কেহ বড় একটা আসে না, তাই হরিপদ বিশেষ করিয়া ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল। সময় সম্বন্ধে সে স্পষ্টভাবে কিছু বলিতে পারিল না, তবে সুরেনবাবু স্পষ্টীক্ষরে বলিলেন যে, তিনি সন্ধ্যা ছাঁটার সময় চাপ আনিতে দিয়াছিলেন।
অর্থাৎ মৃত্যুর আধা ঘণ্টা আগে নটবরবাবুর ঘরে লোক আসিয়াছিল। মেসের কেহ নয়, কারণ কেহই স্বীকার করিল না যে, সে নটবরবাবুর ঘরে গিয়াছিল। সুতরাং বাহিরের লোক। হয়তো বাদামী আলোয়ান গায়ে লোকটা। কিংবা অন্য কেহ; হরিপদর এজেহার হইতে কিছুই ধরা-ছোঁয়া যায় না।
সকলের এজেহার লিখিত হইবার পর প্রণব দারোগা বলিলেন, ‘আপনারা এখন যেতে পারেন, আমরা ঘর খানাতল্লাশ করব। হ্যাঁ, অজিতবাবু এবং শিবকালীবাবুকে জানিয়ে দিচ্ছি, যতদিন খুনের কিনারা না হয়, ততদিন আপনারা আমার অনুমতি না নিয়ে কলকাতার বাইরে যাবার চেষ্টা করবেন না।’
অবাক হইয়া বলিলাম, ‘তার মানে?’
প্রণব দরোগা বলিলেন, ‘তার মানে, আপনার এবং শিবকালীবাবুর গায়ে বাদামী রঙের আলোয়ান রয়েছে। খিক্খিক্।–আচ্ছা, আসুন।’
তিনি আমাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমরা যে যার কোটরে ফিরিয়া আসিলাম। তাস খেলার কথা মনেই রহিল না।
পরের দিনটা নিষ্ক্রিয় বৈচিত্র্যহীনভাবে কাটিয়া গেল। পুলিসের দিক হইতে সাড়াশব্দ নাই। প্রণব দরোগা গত রাত্ৰে নটবরবাবুর ঘর খানাতল্লাশ করিয়া দ্বারে তালা লাগাইয়া চলিয়া গিয়াছেন, কিছু কাগজপত্র লইয়া গিয়াছেন। লোকটি আমাদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন; কিন্তু এমন মিষ্টভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করেন যে, কিছু বলিবার থাকে না। তিনি জানেন আমার অকাট্য অ্যালিবাই আছে, তবু তুচ্ছ ছুতা করিয়া আমার উপর কলিকাতা ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া গেলেন। আমি ব্যোমকেশের বন্ধু, তাই আমাকে উত্ত্যক্ত করাই তাঁহার একমাত্র উদ্দেশ্য।