হেঁয়ালির ছন্দ

সকালবেলা মেসের বাবুরা নিজ নিজ অফিসে চলিয়া গেলেন। কাহারো মনে কোনো বিকার নাই। নটবর নস্কর নামক যে মানুষটি তিন বছর মেসে ছিলেন‌, তিনি যে বন্দুকের গুলিতে মারা গিয়াছেন। সেজন্য কাহারো আক্ষেপ নাই। ‘জন্মিলে মরিতে হবে‌, অমর কে কোথা কবে’–সকলেরই এইরূপ একটি পারমার্থিক মনোভাব।

সন্ধ্যাবেলা ভূপেশবাবুর ঘরে গেলাম। রামবাবু ও বনমালীবাবুও উপস্থিত হইয়াছেন। সকলেরই একটু নিস্তেজ অবস্থা। খেলার কথা আজ কেহ উল্লেখ করিল না। চা পান করিতে করিতে মনমরাভাবে নটবর নস্করের মৃত্যু সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া এবং পুলিসের অকৰ্মণ্যতার নিন্দা করিয়া সভা ভঙ্গ হইল।

সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে উঠিতে একটা আইডিয়া মাথায় আসিল। প্রণব দরোগা যত কর্মকুশলীই হোন। তাঁহার দ্বারা নটবরবাবুর খুনের কিনারা হইবে না। ব্যোমকেশ এখানে নাই; তাসের আড়া ত্ৰিয়মাণ‌, এ অবস্থায় নিষ্কমার মত বসিয়া না থাকিয়া আমি যদি ঘটনাটি লিখিয়া রাখি তাহা হইলে মন্দ হয় না। আমারো কিছু করা হইবে এবং ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া আমার লেখা পড়িলে হয়তো খুনের একটা হেস্তনেস্ত করিতে পারিবে।

রাত্রেই লিখিতে বসিয়া গেলাম। ব্যোমকেশ যাহাতে খুঁত ধরিবার সুযোগ না পায় এমনিভাবে ঘটনার ভূমিকা হইতে আরম্ভ করিয়া আমার দৃষ্টিকোণ হইতে সমস্ত খুঁটিনাটি লিপিবদ্ধ করিলাম। লেখা শেষ হইল পরদিন অপরাহ্নে।

লেখা শেষ হইল বটে। কিন্তু কাহিনীটি শেষ হইল না। কবে কোথায় গিয়া নটবরবাবুর হত্যা কাহিনী শেষ হইবে কে জানে। হয়তো হত্যাকারীর নাম চিরদিন অজ্ঞাত থাকিয়া যাইবে। একটু অপরিতৃপ্ত মন লইয়া সবেমাত্র সিগারেট ধরাইয়াছি। এমন সময় সুটকেশ হাতে গুটিগুটি ব্যোমকেশ প্রবেশ করিল।

আমি লাফাইয়া উঠিলাম‌, ‘আরে! তুমি ফিরে এসেছ! কাজ শেষ হয়ে গেল?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কাজ এখনো আরম্ভই হয়নি। সরকারের দুই দপ্তরে ঝগড়া বেধে গেছে। আগে কেবা প্ৰাণ করিবেক দান তারি লাগি কাড়াকড়ি। দেখে শুনে আমি চলে এলাম। ওদের কামড়া-কামড়ি থামলে আবার যাব।’

সত্যবতী ভিতর হইতে ব্যোমকেশের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়াছিল‌, আচিলে হাত মুছিতে মুছিতে ছুটিয়া আসিল। তাঁহাদের দাম্পত্য জীবন নূতন নয়‌, কিন্তু এখনো ব্যোমকেশকে অপ্রত্যাশিতভাবে কাছে পাইলে সত্যবতীর চোখে আনন্দবিহ্বল জ্যোতি ফুটিয়া ওঠে।

দাম্পত্য পুনর্মিলনের পালা শেষ হইলে আমি নটবর প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলাম এবং লেখাটি পড়িতে দিলাম। ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিতে দিতে পড়িল।

সন্ধ্যা ছটা বাজিলে সে লেখাটা আমাকে ফেরত দিয়া বলিল‌, ‘প্রণব দারোগা তোমাকে শহরবন্দী করে রেখেছে। লোকটা যে আমাদের কী চোখেই দেখেছে! কাল তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। চল‌, আজ ভুপেশীবাবুর সঙ্গে আলাপ করে আসি।’

বুঝিলাম ব্যোমকেশ আকৃষ্ট হইয়াছে। খুশি হইয়া বলিলাম‌, চল। রামবাবু আর বনমালীবাবুর সঙ্গেও দেখা হতে পারে।’

দ্বিতলে ভূপেশবাবুর ঘরে ব্যোমকেশকে লইয়া গেলাম। আমার অনুমান মিথ্যা নয়‌, রামবাবু ও বনমালীবাবু উপস্থিত আছেন। পরিচয় করাইয়া দিতে হইল না‌, সকলেই ব্যোমকেশের চেহারার সঙ্গে পরিচিত। ভূপেশবাবু সমাদ্দারের সহিত ব্যোমকেশকে অভ্যর্থনা করিলেন এবং চায়ের জল চড়াইলেন। রামবাবুর গভীর্য অটল রহিল‌, কিন্তু বনমালীবাবুর চোখে ত্রস্ত সতর্কতা উকিঝুকি মারিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ একটি চেয়ারে উপবেশন করিয়া বলিল‌, ‘আমারও এক সময় ব্রিজের নেশা ছিল। তারপর অজিত দাবা খেলতে শিখিয়েছিল। কিন্তু এখন আর খেলাধুলো ভাল লাগে না।’

ভূপেশবাবু স্টেভের উপর ফুটন্ত জলে চায়ের পাতা ছাড়িতে ছাড়িতে তাহার দিকে ঘাড় ফিরাইলেন‌, হাসিমুখে বলিলেন‌, ‘এখন শুধু পরাণের সাথে খেলিব আজকে মরণ খেলা।’

ভূপেশবাবুর মুখে রবীন্দ্ব কাব্য শুনিয়া একটু চমকিত হইলাম। তিনি বীমার অফিসে চাকরি করেন আবার কাব্যচৰ্চাও করেন।

ব্যোমকেশ শান্তভাবে বলিল‌, ‘ঠিক বলেছেন। মৃত্যুর সঙ্গে সারা জীবন খেলা করে করে এমন অবস্থা হয়েছে যে হালকা খেলায় আর মন বসে না।’

ভূপেশবাবু বলিলেন‌, ‘আপনার কথা স্বতন্ত্র। আমিও মৃত্যু নিয়ে কারবার করি‌, বীমার কাজ মৃত্যুর ব্যবসা ছাড়া আর কী বলুন? কিন্তু আমার এখনো ব্রিজ খেলতে ভাল লাগে।’

ব্যোমকেশ ভূপেশবাবুর সঙ্গে কথা বলিতেছিল বটে‌, কিন্তু তাহার চক্ষু রামবাবু এবং বনমালীবাবুর দিকেই ঘোরাফেরা করিতেছিল। তাঁহারা নির্বাক বসিয়াছিলেন এই ধরনের হাল্কা অথচ মার্জিত-রুচি বাক্যালাপের সঙ্গে তাঁহাদের ঘনিষ্ঠতা নাই।

ভূপেশবাবু চায়ের পেয়ালা এবং ক্রিমকেকার আনিয়া সম্মুখে রাখিলেন। ব্যোমকেশ যেন চিন্তা করিতে করিতে বলিল‌, ‘আপনিও স্বতন্ত্র প্রকৃতির মানুষ। ব্রিজ খেলা বুদ্ধির খেলা‌, যাদের বুদ্ধি আছে তারা স্বভাবতাই এই খেলার দিকে আকৃষ্ট হয়। কেউ কেউ জীবন-যন্ত্রণা থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তি পাবার আশায় তাস খেলতে বসে। আমি অনেক দিন আগে একজনকে জানতাম‌, সে পুত্রশোক ভোলবার জন্যে ব্রিজ খেলত।’

তিনজনের চক্ষু যেন যন্ত্রচালিতবৎ ব্যোমকেশের দিকে ফিরিল। কেহ কোনো কথা বলিলেন না‌, কেবল বিস্ফারিত চোখে চাহিয়া রহিলেন। ঘরের মধ্যে একটি গুরুভার নিস্তব্ধতা নামিয়া আসিল।

নীরবে চা-পান সম্পন্ন হইল। তারপর ব্যোমকেশ রুমালে মুখ মুছিয়া সহজ সুরে নীরবতা ভঙ্গ করিল‌, ‘আমি কটকে গিয়েছিলাম‌, আজই বিকেলবেলা ফিরেছি। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অজিত আমাকে নটবর নস্করের মৃত্যুর খবর জানালো। নটবরবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না‌, কিন্তু তাঁর মৃত্যু-সংবাদ শুনে কৌতূহল হল। নিজের দোরগোড়ায় হত্যাকাণ্ড বড় একটা দেখা যায় না। তাই ভাবলাম আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে আসি।’

0 Shares