হেঁয়ালির ছন্দ

ভূপেশবাবু বলিলেন‌, ‘ভাগ্যিস হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছিল। তাই আমার ঘরে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল। আমি কিন্তু নটবর নস্কর সম্বন্ধে কিছু জানি না‌, জীবিত অবস্থায় তাকে চোখেও দেখিনি। রামবাবু আর বনমালীবাবুর সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল।’

ব্যোমকেশ রামবাবুর পানে তাকাইল। রামবাবুর গভীর্যের উপর যেন ঈষৎ শঙ্কার ছায়া পড়িয়াছে। তিনি উসখুসি করিলেন‌, একবার গলা ঝাড়া দিয়া কিছু বলিবার উপক্রম করিয়া আবার মুখ বন্ধ করিলেন। ব্যোমকেশ তখন বনমালীবাবুর দিকে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল‌, ‘নটবরবাবু কেমন লোক ছিলেন। আপনি নিশ্চয় জানেন?’

বনমালীবাবু চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন‌, ‘অ্যাঁ—তা—লোক মন্দ নয়–বেশ ভালই লোক ছিএলন—তবে–

এতক্ষণে রামবাবু বাকশক্তি ফিরিয়া পাইলেন‌, তিনি বনমালীবাবুর অসমাপ্ত কথার মাঝখানে বলিলেন‌, ‘দেখুন‌, নটবরবাবুর সঙ্গে আমাদের মোটেই ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তবে যখন ঢাকায় ছিলাম তখন নটবরবাবু পাশের বাড়িতে থাকতেন‌, তাই সামান্য মুখ চেনাচেনি ছিল। ওঁর চরিত্র সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘কতদিন আগে আপনারা ঢাকায় ছিলেন?’

রামবাবু ঢোক গিলিয়া বলিলেন‌, ‘পাঁচ-ছয় বছর আগে। তারপর দেশ ভাগাভাগির দাঙ্গা শুরু হল‌, আমরা পশ্চিমবঙ্গে চলে এলাম।’

ব্যোমকেশ বনমালীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ঢাকায় আপনারা দ’জনে একই অফিসে চাকরি করতেন বুঝি?’

বনমালীবাবু বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। গডফ্রে ব্ৰাউন কোম্পানির নাম শুনেছেন‌, মস্ত বিলিতি কোম্পানি। আমরা সেখানেই—‘

তাঁহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই রামবাবু সহসা উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, বলিলেন‌, ‘বনমালী! আজ সাতটার সময় নারায়ণবাবুর বাসায় যেতে হবে মনে আছে?–আচ্ছা‌, আজ আমরা উঠি।’

বনমালীকে সঙ্গে লইয়া রামবাবু দ্রুত নিস্ক্রাস্ত হইলেন। ব্যোমকেশ ঘাড় ফিরাইয়া তাঁহাদের নিষ্ক্রমণ ক্রিয়া দেখিল।

ভূপেশবাবু মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনার প্রশ্নগুলি শুনতে খুবই নিরীহ‌, কিন্তু রামবাবুর আঁতে ঘা লেগেছে।’

ব্যোমকেশ ভালমানুষের মত বলিল‌, ‘কেন আঁতে ঘা লাগল বুঝতে পারলাম না। আপনি কিছু জানেন?’

ভূপেশবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘কিছুই জানি না। দাঙ্গার সময় আমি অবশ্য ঢাকায় ছিলাম‌, কিন্তু ওঁদের সঙ্গে তখন পরিচয় ছিল না। ওঁদের অতীত সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না।’

‘দাঙ্গার সময় আপনিও ঢাকায় ছিলেন?’

‘হ্যাঁ। দাঙ্গার বছরখানেক আগে ঢাকায় বদলি হয়েছিলাম‌, দেশ ভাগ হবার পর ফিরে আসি।’

কিছুক্ষণ কোনো কথা হইল না। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল। ভূপেশবাবু কিছুক্ষণ তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি যে গল্প বললেন‌, পুত্রশোক ভোলবার জন্যে একজন ব্রিজ খেলত‌, সেটা কি সত্যি গল্প?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ, সত্যি গল্প। অনেক দিন আগের কথা আমি তখন কলেজে পড়তাম। কেন বলুন দেখি?’

ভূপেশবাবু উত্তর দিলেন না‌, উঠিয়া গিয়া দেরাজ হইতে একটি ফটোগ্রাফ আনিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিলেন। একটি নয়-দশ বছরের ছেলের ছবি; কৈশোরের লবণ্যে মুখখানি টুলটুল করিতেছে। ভূপেশবাবু অস্ফুট স্বরে বলিলেন, ‘আমার ছেলে?’

ছবি হইতে ভূপেশবাবুর মুখের পানে উৎকণ্ঠিত চক্ষু তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘ছেলে—‘

ভূপেশবাবুঘাড় নাড়িলেন, ‘মারা গেছে। ঢাকায় যেদিন দাঙ্গা শুরু হয় সেদিন স্কুলে গিয়েছিল, স্কুল থেকে আর ফিরে এল না। ’

দুৰ্বহ মৌন ভঙ্গ করিয়া ব্যোমকেশ অধোচ্চারিত প্রশ্ন করিল, ‘আপনার স্ত্রী—?’

ভূপেশবাবু বলিলেন, ‘সেও মারা গেছে। হার্ট দুর্বল ছিল, পুত্ৰশোক সইতে পারল না। আমি মরলাম না, ভুলতেও পারলাম না। পাঁচ ছয় বছর কেটে গেছে, এতদিনে ভুলে যাবার কথা। কিন্তু কাজ করি, তাস খেলি, হেসে খেলে বেড়াই, তবু ভুলতে পারি না। ব্যোমকেশবাবু, শোকের স্মৃতি মুছে ফেলবার কি কোনো ওষুধ আছে?

ব্যোমকেশ গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘একমাত্র ওষুধ মহাকাল।’

পরদিন সকালে চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, শ্ৰীমৎ প্রণবানন্দ স্বামীকে দর্শন করে আসা যাক।’

কাল রাত্রে ভূপেশবাবুর জীবনের ট্র্যাজেডি শুনিয়া মনটা ছায়াচ্ছন্ন হইয়া ছিল, প্রণব দারোগার সম্মুখীন হইতে হইবে শুনিয়া আরো দমিয়া গেলাম। বলিলাম, ‘প্রণবানন্দ বাবাজিকে দর্শন করা কি একান্ত দরকার?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘পুলিসের সন্দেহ থেকে যদি মুক্ত হতে না চাও তাহলে দরকার নেই।

‘চল।‘

সাড়ে ন’টার সময় সিঁড়ি দিয়া দ্বিতলে নামিয়া দেখিলাম ভূপেশবাবুর দ্বারে তালা লাগানো।তিনি নিশ্চয় অফিসে গিয়াছেন। তিন নম্বর ঘর হইতে রামবাবু ও বনমালীবাবু ধড়চূড়া পরিয়া বাহির হইতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া আবার ঘরে ঢুকিয়া পড়িলেন। ব্যোমকেশ আমার পানে চোখ বাঁকাইয়া হাসিল।

নীচের তলায় শিবকালীবাবু অফিসে বসিয়া হিসাব দেখিতেছিলেন, ব্যোমকেশকে দেখিতে পাইয়া লাফাইয়া দ্বারের কাছে আসিলেন, ব্যাকুল চক্ষে চাহিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু! কটক থেকে কবে এলেন— কখন এলেন? নটবর নস্করের কথা শুনেছেন তো! কি মুশকিল দেখুন দেখি, পুলিস আমাকে ধরে টানাটানি করছে— নাহিক টানাটানি করছে।‘

ব্যোমকেশ বলিল, ‘শুধু আপনাকে নয়, অজিতকে নিয়েও টানাটানি করছে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো। বাদামী র‍্যাপার। মানে হয় না— মানে হয় না।— আপনি একটা ব্যবস্থা করুন।‘

0 Shares