হেঁয়ালির ছন্দ

‘দেখি চেষ্টা করে।’

‘গলিটা’ মানে আমাদের বাসার পাশের গলি, যে গলি দিয়া বাদামী আলোয়ান গায়ে লোকটা নটবরবাবুকে গুলি করিয়া পলায়ন করিয়াছিল। অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ গলি, দুইজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটিতে পারে না।আমরা আগে পিছে গলিতে প্ৰবেশ করিলাম; ব্যোমকেশ ইট-বাঁধানো মেঝের উপর দৃষ্টি রাখিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল। তাহার মনে কী আছে জানি না, কিন্তু তিন দিন পরে গলির মধ্যে হত্যাকারীর কোনো নিশানা পাওয়া যাইবে ইহা আশা করাও দুরাশা।

নটবরবাবুর ঘরের জানালা বন্ধ। ব্যোমকেশ সেইখানে গিয়া ইট-বাঁধানো জমির উপর সন্ধানী চক্ষু বুলাইতে লাগিল। জানালাটি গলি হইতে চার ফুট উচুতে অবস্থিত, কপাট খোলা থাকিলে গলিতে দাঁড়াইয়া স্বচ্ছন্দে ঘরের মধ্যে গুলি চালানো যায়।

‘ওটা কিসের দাগ?’

ব্যোমকেশের অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করিয়া দেখিলাম‌, ঠিক জানালার নীচে ইট-বাঁধানো মেঝের উপর পাশুটে রঙের একটা দাগ রহিয়াছে; তিন ইঞ্চি ব্যাসের নক্ষত্রাকার একটা দাগ। গলিতে মাঝে মাঝে ঝাঁট পড়ে‌, কিন্তু সম্মার্জনীর তাড়না সত্ত্বেও দাগটা মুছিয়া যায় নাই। দুই তিন দিনের পুরানো দাগ মনে হয়।

কলিলাম‌, ‘কিসের দাগ?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না‌, হঠাৎ গলির মধ্যে ডন ফেলার ভঙ্গীতে লম্বা হইয়া দাগের উপর নাসিক স্থাপন করিল। বিস্মিত হইয়া বলিলাম‌, ‘ওকি! মাটিতে নাক ঘাষছ কেন?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল‌, ‘নাক ঘষিনি। শুকছিলাম।’

‘শুকছিলো! কেমন গন্ধ?’

‘যদি জানতে চাও তুমিও শুকে দেখতে পার।’

‘আমার দরকার নেই।’

‘তাহলে চল থানায়।’

গলি হইতে বাহির হইয়া থানার দিকে চলিলাম। দু’একবার ব্যোমকেশের মুখের পানে অপাঙ্গদৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম‌, কিন্তু রাস্তার গন্ধ শুকিয়া সে কিছু পাইয়াছে কিনা বোঝা গেল না।

থানায় প্রণব দারোগ ঘর আলো করিয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার চেহারা মোটের উপর জুলাই‌, দোহার উজ্জ্বল শামক শরীর; দোষের মধ্যে শরীরের খাড়াই মাত্র পাঁচ ফুট ভিন্ন

ব্যোমকেশকে দেখিয়া তাঁহার চোখে প্রথমে বিস্ময়‌, তারপর ছদ্মবিনয় ভাব ফুটিয়া উঠিল‌, তিনি বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু! উঠেই আপনার মুখ দেখলাম— কী সৌভাগ্য। খিকখিক।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার সৌভাগ্যও কম নয়। সকালবেলা বেঁটে মানুষ দেখলে কী ফল হয় তা শাস্ত্রেই লেখা আছে—ব্রথস্থং বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যুতে।’

প্রণব দরোগ থতমত খাইয়া গেলেন। ব্যোমকেশ চিরদিন প্রণব দারোগার ব্যঙ্গ বিদ্যুপ অগ্রাহ্য করিয়া চলিয়াছে‌, কিন্তু আজ তাহার মেজাজ অন্য রকম। প্রণববাবু প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত মুন্ন না‌, তিনি গভীর হইয়া বললেন‌, আমার চেহারা আকাশ পিন্ধিমের মত নয় তা স্বীকার ব্যোমকেশ হাসিল‌, ‘স্বীকার না করে উপায় নেই। আকাশ পিন্দিমের মাথায় আলো জ্বলে; ঐখানেই আপনার সঙ্গে তফাত।’

প্রণববাবুর মুখ কালো হইয়া উঠিল‌, তিনি চেষ্টাকৃত কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিলেন‌, ‘কি করব বলুন‌, সকলের মাথায় তো গ্যাস-লাইট জ্বলে না।–কিছু দরকার আছে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আছে। বইকি। প্রথমত‌, অজিত যে ফেরারী হয়নি তার প্রমাণস্বরূপ ওকে ধরে এনেছি। আপনি নিৰ্ভয়ে থাকুন‌, আমি ওর ওপর নজর রেখেছি‌, আমার দৃষ্টি এড়িয়ে ও পালাতে পারবে না।‘

প্রণববাবু অপ্রস্তুতভাবে হাসিবার চেষ্টা করিলেন। ব্যোমকেশ নির্দয়ভাবে বলিয়া চলিল‌, ‘আপনি অজিতকে শহরবন্দী করে রেখেছেন একথা শুনলে কমিশনার সাহেব কি বলবেন আমি জানি না‌, কিন্তু জানিবার আগ্রহ আছে। দেশে আইন আদালত আছে‌, জনসাধারণের স্বাধীনতার ওপর অকারণ হস্তক্ষেপ করলে পুলিস কর্মচারীরাও সাজা হতে পারে। যাহোক‌, এসব পরের কথা। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন‌, নটবর নস্করের মৃত্যু সম্বন্ধে আপনি কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে পেরেছেন। কিনা।’

প্রণববাবু এই প্রশ্নের রূঢ় উত্তর দিবেন। কিনা চিন্তা করিলেন। কিন্তু ব্যোমকেশকে তাহার বর্তমান মানসিক অবস্থায় ঘটানো উচিত হইবে না বুঝিয়া তিনি ধীরস্বরে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, এই কলকাতা শহরের জনসংখ্যা কত আপনার জানা আছে কি?’

ব্যোমকেশ তাচ্ছিল্যভারে বলিল‌, ‘কখনো গুনে দেখিনি‌, লাখ পঞ্চাশেক হবে।’ প্রণববাবু বলিলেন‌, ‘ধরুন পঞ্চাশ লাখ। এই অর্ধকোটি মানুষের মধ্যে থেকে বাদামী আলোয়ান গায়ে একটি লোককে ধরা কি সহজ? আপনি পারেন?’

‘সব খবর পেলে হয়তো পারি।’

‘বাইরের লোককে সব খবর জানানো যদিও আমাদের রীতি বিরুদ্ধ, তবু যতটুকু জানি আপনাকে বলতে পারি।’

‘বেশ‌, বলুন! নটবর নস্করের আত্মীয়-স্বজনের কোনো সন্ধান পাওয়া গেছে?’

‘না। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে‌, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।’

‘ময়না তদন্তের ফলাফল কি রকম?’

‘বুকের হাড় ফুটো করে গুলি হৃদযন্ত্রে ঢুকেছে। পিস্তলের সঙ্গে গুলি মিলিয়ে দেখা গেছে‌, গুলি ওই পিস্তল থেকেই বেরিয়েছে।’

‘আর কিছু?’ শিরীর সুস্থই ছিল‌, কিন্তু চোখে ছানি পড়বার উপক্রম হয়েছিল।’ ‘পিস্তলের মালিক কে?’ ‘মার্কিন ফৌজি পিস্তল‌, কালোবাজারে কিনতে পাওয়া যায়। মালিকের নাম জানার উপায় নেই।’

‘ঘর তল্লাশ করে কিছু পেয়েছেন?’

‘দরকারী জিনিস যা পেয়েছি তা ওই টেবিলের ওপর আছে। একটা ডায়েরি‌, গোটা পাঁচেক টাকা‌, ব্যাঙ্কের পাস-বুক‌, আর একটা আদালতের রায়ের বাজাপ্ত নকল। আপনি ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন।’

ঘরের কোণে একটা টেবিল ছিল‌, ব্যোমকেশ উঠিয়া সেইদিকে গেল‌, আমি গোলাম না। প্রণব দারোগা লোক ভাল নয়‌, তিনি যদি আপত্তি করেন একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হইবে। বসিয়া বসিয়া দেখিলাম, ব্যোমকেশ ব্যাঙ্কের খাতা পরীক্ষা করিল, ডায়েরির পাতা উল্টাইল, স্ট্যাম্প কাগজে লেখা আদালতী দলিল মন দিয়া পড়িল। তারপর ফিরিয়া আসিয়া বলিল‌, ‘দেখা হয়েছে।’

0 Shares