হেঁয়ালির ছন্দ

প্রণব দারোগার দুষ্টবুদ্ধি এতক্ষণে আবার চাড়া দিয়াছে‌, তিনি মিটমিটি চাহিয়া বলিলেন‌, ‘আমি যা-যা দেখেছি আপনিও তাই দেখলেন। আসামীর নাম-ধাম সব জানতে পেরে গেছেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ, পেরেছি।’

ভ্রূ আকাশে তুলিয়া প্রণববাবু বলিলেন‌, ‘বলেন কি! এরি মধ্যে! আপনার তো ভারি বুদ্ধি! তা দয়া করে আসামীর নামটা আমায় বলুন‌, আমি তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলি?’

ব্যোমকেশ চোয়াল শক্ত করিয়া বলিল‌, ‘আসামীর নাম আপনাকে বলব না দারোগাবাবু; ওটা আমার নিজস্ব আবিষ্কার। আপনি এই কাজের জন্যে মাইনে খান‌, আপনাকে নিজে থেকে খুঁজে বার করতে হবে। তবে একটু সাহায্য করতে পারি। মেসের পাশের গলিটা খুঁজে দেখবেন।’

‘সেখানে আসামী তার পদচিহ্ন রেখে গেছে নাকি! খিক্‌ খিক্‌।’

‘না‌, পদচিহ্নের চেয়েও গুরুতর চিহ্ন রেখে গেছে।—আর একটা কথা জানিয়ে যাই। দুচার দিনের মধ্যেই আমি অজিতকে নিয়ে কটকে চলে যাব। আপনার যদি সাহস থাকে তাকে আটকে রাখুন।–চল অজিত।’

থানা হইতে বাহির হইয়া আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলিলাম‌, ‘কে আসামী‌, ধরতে পেরেছ?’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল‌, ‘থানায় আসার আগেই জানতে পেরেছি‌, কিন্তু প্রণব দরোগা একটা ইয়ে। বুদ্ধি নেই তা নয়‌, বিপরীত বুদ্ধি। ও কোনো কালে নটবর নস্করের খুনীকে ধরতে পারবে না।’

প্রশ্ন করিলাম‌, নটবর নস্করের খুনী কে? চেনা লোক?’

‘পরে বলব। আপাতত এইটুকু জেনে রাখো যে‌, নটবর নস্করের পেশা ছিল ব্ল্যাকমেল করা। তুমি বাসায় ফিরে যাও‌, আমি অফিস-পাড়ায় যাচ্ছি। কলকাতাতেও গডফ্রে ব্রাউনের প্রকাণ্ড ব্যবসা আছে‌, তাদের অফিসে কিছু খোঁজ-খবর পাওয়া যেতে পারে। আচ্ছা‌, আমার ফিরতে দেরি হবে।’ হাত নাড়িয়া সে চলিয়া গেল।

আমি একাকী বাসায় ফিরিলাম। ব্যোমকেশ ফিরিল বেলা তখন দেড়টা।

স্নানাহারের পর সে বলিল‌, ‘একটা কাজ করতে হবে; বিকেলবেলা তুমি গিয়ে রামবাবুকে‌, বনমালীবাবুকে এবং ভূপেশবাবুকে চায়ের নেমন্তন্ন করে আসবে। সন্ধ্যের পর এই ঘরে সভা বসবে।’

‘তথাস্তু। কিন্তু ব্যাপার কি! গডফ্রে ব্রাউনের অফিসে গিয়েছিলে কেন?’

‘থানায় নটবর নস্করের জিনিসগুলোর মধ্যে একটা আদালতের রায় ছিল। সেটা পড়ে দেখলাম রাসবিহারী বিশ্বাস এবং বনবিহারী বিশ্বাস নামে দুই ভাই গডফ্রে ব্ৰাউন কোম্পানির ঢাকা ব্ৰাঞ্চে যথাক্রমে খাজাঞ্চী ও তস্য সহকারী ছিল। সাত বছর আগে তারা অফিসের টাকা চুরির অপরাধে ধরা পড়ে। মামলা হয় এবং বনবিহারীর দু’বছর ও রাসবিহারীর তিন বছর জেল হয়। সেই মোকদ্দমার রায় নটবর নস্কর যোগাড় করেছিল। তারপর তার ডায়েরি খুলে দেখলাম‌, প্রতি মাসে সে রাসবিহারী ও বনবিহারী বিশ্বাসের কাছ থেকে আশি টাকা পায়। গডফ্রে ব্রাউনের অফিসে গিয়ে চুরি-ঘটিত মামলার কথা যাচাই করে এলাম। সত্যি ঘটনা। সন্দেহ রইল না‌, নটবর তাদের ব্ল্যাকমেলা করছিল।’

‘কিন্তু–রাসবিহারী বনবিহারী–এরা কারা? এদের কোথায় খুঁজে পাবে?’

‘বেশি দূর খুঁজতে হবে না‌, এই মেসের তিন নম্বর ঘরে তাঁদের পাওয়া যাবে।’

‘অ্যাঁ। রামবাবু আর বনমালীবাবু!’

‘হ্যাঁ। তুমি কাছাকাছি আন্দাজ করেছিলে। ওরা মাসতুত ভাই নয়‌, সাক্ষাৎ সহোদর ভাই। তবে যদি চোরে চোরে মাসতুত ভাই এই প্রবাদ-বাক্যের মর্যাদা রাখতে চাও তাহলে মাসতুত ভাই বলতে পার।’

‘কিন্তু–কিন্তু–এরা তো নটবর নস্করকে খুন করতে পারে না। নটবর যখন খুন হয় তখন তো ওরা—‘

হাত তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ধৈর্য ধারণ কর। আগাগোড়া কাহিনী আজ চায়ের সময় শুনতে পাবে।’

মাড়োয়ারীর দোকানের রকমারি ভাজা ভুজি ও চা দিয়া অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা হইয়াছে। প্রথমে দেখা দিলেন ভূপেশবাবু। ধুতি পাঞ্জাবির উপর কাঁধে পাট-করা ধূসর রঙের শাল‌, মুখে উৎসুক হাসি। বলিলেন‌, ‘ব্রিজ খেলার ব্যবস্থা আছে নাকি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনারা যদি খেলতে চান ব্যবস্থা করা যাবে।’

কিছুক্ষণ পরে রামবাবু ও বনমালীবাবু আসিলেন। গায়ে গলাবন্ধ কোট‌, চোখে সতর্ক দৃষ্টি। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আসুন আসুন।’

পানাহারের সঙ্গে ব্যোমকেশ সরস বাক্যালাপ করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করিলাম‌, রামবাবু ও বনমালীবাবুর আড়ষ্ট ভােব শিথিল হইয়াছে। তাঁহারা সহজভাবে কথাবাতায় যোগ দিতেছেন।

মিনিট কুড়ি পরে জলযোগ সমাপ্ত করিয়া রামবাবু চুরুট ধরাইলেন; ব্যোমকেশ ভূপেশবাবুকে সিগারেট দিয়া সিগারেটের টিন বনমালীবাবুর সামনে ধরিল‌, ‘আপনি একটা নিন‌, বনবিহারীবাবু।’

বনমালীবাবু বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে‌, আমি সিগারেট খাই না–বলিয়া একেবারে ফ্যাকাসে হইয়া গেলেন—‘আজ্ঞে—আমার নাম—‘

‘আপনাদের দুই ভায়েরই প্রকৃত নাম আমি জানি-রাসবিহারী এবং বনবিহারী বিশ্বাস।’–ব্যোমকেশ নিজের চেয়ারে গিয়া বসিল‌, ‘নটবর নস্কর আপনাদের ব্ল্যাকমেল করছিল। আপনারা মাসে মাসে তাকে আশি টাকা দিচ্ছিলেন–’

রাসবিহারী ও বনবিহারী দারুমুর্তির ন্যায় বসিয়া রহিলেন। ব্যোমকেশ নিজে সিগারেট ধরাইয়া ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল‌, ‘নটবর নস্কর লোকটা ছিল অতি বড় শয়তান। যখন ঢাকায় ছিল তখন প্রকাশ্যে দালালির কাজ করত‌, আর সুবিধা পেলে ব্ল্যাকমেলের ব্যবসা চালাত। আপনারা দুই ভাই যখন জেলে গেলেন তখন সে ভবিষ্যতের কথা ভেবে আদালতের রায়ের নকল যোগাড় করে রাখল। মতলব‌, আপনারা জেল থেকে বেরিয়ে আবার যখন চাকরি-বাকরি করবেন তখন আপনাদের রক্ত শোষণ করবে।

‘তারপর একদিন দেশ ভাগাভাগি হয়ে গেল। ঢাকায় নটবরের ব্যবসা আর চলল না‌, সে কলকাতায় পালিয়ে এল। কিন্তু এখানে তার জানা-শোনা লোকের সংখ্যা কম‌, বৈধ এবং অবৈধ কোনো রকম ব্যবসারই সুবিধে নেই‌, ব্ল্যাকমেল করার উপযুক্ত পোত্র নেই। তার ব্যবসায় ভাঁটা পড়ল। এই মেসে এসে একটা ঘর নিয়ে সে রইল; সামান্য যা টাকা সঙ্গে আনতে পেরেছিল তাই দিয়ে জীবন নির্বাহ করতে লাগিল।

0 Shares