হেঁয়ালির ছন্দ

‘এখানে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন সে আপনাদের দেখল এবং চিনতে পারল। আপনারা এই মেসেই থাকেন। খোঁজখবর নিয়ে সে জানতে পারল যে আপনারা ছদ্মনামে এক ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন। নটবর নস্কর রোজগারের একটা রাস্তা পেয়ে গেল। ভগবান যেন আপনাদের হাত-পা বেঁধে তার হাতে সঁপে দিলেন।

‘নটবর আপনাদের বলল‌, টাকা দাও‌, নইলে ব্যাঙ্কে তোমাদের প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে দেব। আপনারা নিরুপায় হয়ে মাসে মাসে টাকা গুনতে লাগলেন। টাকা অবশ্য বেশি নয়‌, মাসে আশি টাকা। কিন্তু নটাবরের পক্ষে তাই বা মন্দ কি। অন্তত মেসের খরচটা উঠে আসে।

‘এইভাবে চলছিল। আপনাদের প্রাণে সুখ নেই‌, কিন্তু নটবরের হাত ছাড়ানোর উপায়ও নেই। একমাত্র উপায়‌, যদি নটবরের মৃত্যু হয়।’

ব্যোমকেশ থামিল। রুদ্ধশ্বাস নীরবতা ভাঙিয়া বনবিহারী হাউমাউ করিয়া উঠিলেন‌, ‘দোহাই ব্যোমকেশবাবু‌, আমরা নটবর নস্করকে মারিনি। নটবর যখন মরে তখন আমরা ভূপেশবাবুর ঘরে ছিলাম।‘

‘তা বটে!’ ব্যোমকেশ চেয়ারে হেলান দিয়ে ঊর্ধ্বদিকে ধোঁয়া ছাড়িল‌, অবহেলাভরে বলিল‌, ‘কে নটবরকে খুন করেছে তা নিয়ে আমার মাথা-ব্যথা নেই। মাথা-ব্যথা পুলিসের। কিন্তু আপনারা ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। ব্যাঙ্কে যদি কোনো দিন টাকার গরমিল হয় তখন আমাকে আপনাদের আসল পরিচয় প্রকাশ করতে হবে।’

এবার রামবাবু ওরফে রাসবিহারীবাবু কথা বলিলেন‌, ‘ব্যাঙ্কের টাকার গরমিল হবে না। আমরা একবার যে-ভুল করেছি। দ্বিতীয়বার সে-ভুল করব না।’

‘ভাল কথা। তাহলে আমি আর অজিত নীরব থাকব।’ ব্যোমকেশ ভূপেশবাবুর পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনি?’

ভূপেশবাবুর মুখে বিচিত্র হাসি খেলিয়া গেল‌, তিনি মৃদুস্বরে বলিলেন‌, ‘আমিও নীরব। আমার মুখ দিয়ে একটি কথা বেরুবে না।’

অতঃপর ঘর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। তারপর রামবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, হাত জোড় করিয়া বলিলেন‌, ‘আপনাদের দয়া জীবনে ভুলব না। আচ্ছা‌, আজ আমরা যাই‌, আমার শরীর একটু অসুস্থ বোধ হচ্ছে।’

‘আসুন। ‘ ব্যোমকেশ তাঁহাদের দ্বার পর্যন্ত আগাইয়া দিল‌, তারপর দ্বার বন্ধ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল।

ভূপেশবাবু ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছেন দেখিলাম। ব্যোমকেশও প্রত্যুত্তরে হাসিল। ভূপেশবাবু বলিলেন‌, ‘রামবাবু আর বনমালীবাবুর সঙ্গে নটবর নস্করের অবৈধ যোগাযোগ আছে আমি জানতাম না‌, ব্যোমকেশবাবু। ওটা সমাপতন। আপনি বোধ হয় সবই বুঝতে পেরেছেন–কেমন?’

ব্যোমকেশ গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘সব বুঝতে পারিনি‌, তবে মোট কথা বুঝেছি।’

ভূপেশবাবু বলিলেন‌, ‘আপনি তাহলে গল্পটা বলুন। আমার যদি কিছু বলবার থাকে আমি পরে বলব।’

ব্যোমকেশ ভূপেশবাবুকে একটি সিগারেট দিল‌, নিজে একটি ধরাইয়া আমার পানে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল‌, ‘তুমি নটবরের মৃত্যুর একটা ব্বিরণ লিখেছি। সেটা পড়ে আমার খটকা লাগল। পিস্তলের আওয়াজ এত জোরে হয় না; এ যেন ছররা বন্দুকের আওয়াজ‌, কিম্বা বোমা ফাটার আওয়াজ। অথচ নটবর মরেছে পিস্তলের গুলিতে।

‘রামবাবু এবং বনমালীবাবুর মধ্যে চেহারার সাদৃশ্য তুমি লক্ষ্য করেছিলে। আমি তাঁদের সঙ্গে কথা কয়ে দেখলাম তাঁরা কিছু লুকোবার চেষ্টা করছেন। নটবরের ঘরে তাঁদের যাতায়াত ছিল‌, সুতরাং তাঁদের সম্বন্ধে আমার মনে কৌতূহল হল।

‘কিন্তু যখন বন্দুকের আওয়াজ হয় তখন ওঁরা দোতলায় ভূপেশবাবুর ঘরে ছিলেন। ভূপেশবাবুর ঘরের পরিস্থিতি আতিশয় নিরুদ্বেগ ও স্বাভাবিক। তিনি নিজের ঘরে আছেন‌, ছ’টা বেজে পঁচিশ মিনিটে রাসবিহারী ও বনবিহারী তাস খেলতে এলেন। কিন্তু অজিত না আসা পর্যন্ত তাস খেলা আরম্ভ হচ্ছে না। দুমিনিট পরে সিঁড়িতে অজিতের ফট্‌ফট্‌ চটির শব্দ শোনা গেল। ভূপেশবাবু উঠে গিয়ে গলির দিকের জানলা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গলিতে দুম করে শব্দ হল। রাসবিহারী ও বনবিহারী জানালার কাছে গেলেন। ভূপেশবাবু বলে উঠলেন‌, ‘ঐ-ঐ–গলি থেকে বেরিয়ে গেল‌, দেখতে পেলেন? গায়ে বাদামী রঙের আলোয়ান–?’

‘গলির মুখের কাছে সদর রাস্তা দিয়ে লোক যাতায়াত করছিল‌, রাসবিহারী ও বনবিহারী তাদেরই একজনকে দেখে ভাবলেন সে গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সন্দেহ রইল না যে‌, ভূপেশবাবু ঠিক কথাই বলছেন। তাঁদের বিশ্বাস হল যে‌, তাঁরাও লোকটাকে গলি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। এই ধরনের ভ্রান্তি চেষ্টা করলে সৃষ্টি করা যায়।

‘পরে নটবরের ঘরের জানলার ওপর পিস্তলটিা পাওয়া গেল। স্বভাবতাই প্রশ্ন জাগে‌, আততায়ী পিস্তলটিা ফেলে গেল কেন? অস্ত্র ফেলে যাওয়ার কোনো ন্যায্য কারণ নেই। আমার সন্দেহ হল এই সহজ স্বাভাবিক পরিস্থিতির আড়ালে মস্ত একটা ধাপ্পাবাজি রয়েছে।

‘মেসের চাকর হরিপদ সন্ধ্যে ছাঁটার সময় শুনেছিল নটবরের ঘরে লোক আছে। যদি সেই লোকটাই নটবরকে খুন করে থাকে? এবং নিজের অ্যালিবই তৈরি করার জন্যে মৃত্যুর সময়টা এগিয়ে এনে থাকে? পনেরো কুড়ি মিনিটের তফাত ময়না তদন্তে ধরা পড়ে না।

‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল‌, খুন যে-ই করুক‌, সে বাইরের লোক নয়‌, মেসের লোক। কিন্তু লোকটা কে? শিবকালীবাবু? রাসবিহারী-বনবিহারী? কিম্বা অন্য কেউ। কার মোটিভ আছে জানি না‌, কিন্তু সুযোগ আছে একমাত্র শিবকালীবাবুর। অন্য সকলের অকাট্য অ্যালিবাই আছে।

‘মনটা বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে রইল‌, কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। লক্ষ্য করেছিলাম যে‌, ভূপেশবাবুর ঘরের নীচে নটবরের ঘর এবং গলির দিকে ভূপেশেবাবুর জানলার নীচে নটবরের জানলা। কিন্তু পটকার কথা একেবারেই মনে আসেনি। হ্যাঁ‌, পটকা। যে পটকা আছাড় মারলে কিম্বা উঁচু থেকে শক্ত মেঝের উপর ফেললে আওয়াজ হয়। সেই পটকা।

0 Shares