অনুপমার প্রেম

বিনা পয়সায় যখন এ সুবিধা পেয়েচি, তখন দোষ কি?

রাখালবাবু এ কথায় একেবারে অগ্নিশর্মা হইয়া উঠিলেন—নাস্তিক বেটা! দোষ কি? পরের পয়সায় যদি বিষ পাওয়া যায় ত কি খেতে হবে?

সে-কথায় এ-কথায় অনেক প্রভেদ।

প্রভেদ আর কোথায়? একদিকে জাত খোয়ান, স্লেচ্ছ হওয়া, আর অপরদিকে বিষভোজন, ঠিক এক নয় কি? চুল চুল মিলে গেল না কি?

সুরেশ আর কোন প্রতিবাদ না করিয়া নিরুত্তরে প্রস্থান করিল। সে চলিয়া যাইলে রাখালবাবু আপনা-আপনি হাসিয়া বলিলেন, বেটা পাতা-দুই ইংরেজি পড়ে আমাদের সঙ্গে তর্ক করতে আসে। কেমন কথাটা বললাম—পরের পয়সায় বিষ পেলে কি খেতে হবে? বাছাধন আর দ্বিতীয় কথাটি বলতে পারলে না। এ অকাট্য যুক্তি কি ও কাটতে পারে!

বিবাহের সমস্ত পাকা-রকম স্থির হইয়া যাইলে বড়বধূ একদিন অনুপমাকে বলিলেন, কি লো! বরের সুখ্যাতি যে গ্রামে ধরে না।

অনুপমা মৃদু হাসিয়া বলিল, যার সতীসাধ্বী স্ত্রী, জগতে তার সকল সুখের পথই উন্মুক্ত থাকে।

তবু ত এখনো বিয়ে হয়নি লো!

বিবাহ আমাদের অনেকদিন হয়েছে, জগৎ জানে না বটে, কিন্তু অন্তরে অন্তরে বহুদিন আমাদের পূর্ণমিলন হয়ে গিয়েছে।

বড়বধূ অল্প হাসিল, ওষ্ঠ ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া একটু থামিয়া বলিলেন, এ কথা আর কোথাও বলিস নে, আমরা বুড়ো মাগী, আমাদের ত বলা দূরে থাক—এমনধারা শুনলেও লজ্জা করে; সব কথায় তুই যেন থিয়েটারে অ্যাক্ট করতে থাকিস। এমন করলে লোকে পাগল বলবে যে!

আমি প্রেমে পাগল!

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বিবাহ

আজ ৫ই বৈশাখ। অনুপমার বিবাহ-উৎসবে আজ গ্রামটা তোলপাড় হইতেছে। জগবন্ধুবাবুর বাটীতে আজ ভিড় ধরে না। কত লোক যাইতেছে, কত লোক হাঁকাহাঁকি করিতেছে। কত খাওয়ান-দাওয়ানর ঘটা, কত বাজনা-বাদ্যের ধুম। যত সন্ধ্যা হইয়া আসিতে লাগিল, ধুমধাম তত বাড়িয়া উঠিতে লাগিল; সন্ধ্যা-লগ্নেই বিবাহ, এখনই বর আসিবে—সকলেই উৎসাহে আগ্রহে উন্মুখ হইয়া আছে।

কিন্তু বর কোথায় ? রাখালবাবুর বাটীতে সন্ধ্যার প্রাক্কালেই কলরব বাধিয়া উঠিয়াছে, সুরেশ গেল কোথায়? এখানে খোঁজ, ওখানে খোঁজ, এদিকে দেখ, ওদিকে দেখ। কিন্তু কেহই সুরেশকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিতেছে না। কুসংবাদ পঁহুছিতে বিলম্ব হয় না, বজ্রাগ্নির মত এ কথা জগবন্ধুবাবুর বাটীতে উড়িয়া আসিয়া পড়িল। বাড়িসুদ্ধ লোক সকলেই মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল; সে কি কথা!

আটটার সময় বিবাহের লগ্ন, কিন্তু নয়টা বাজিতে চলিল, কোথাও বরের সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। জগবন্ধুবাবু মাথা চাপড়াইয়া ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। গৃহিনী কাঁদিয়া আসিয়া তাঁহার নিকটে পড়িলেন, কি হবে গো?

কর্তার তখন অর্ধক্ষিপ্তাবস্থা। তিনি চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, হবে আমার শ্রাদ্ধ—আর কি হবে? এই হতভাগা মেয়ের জন্য বৃদ্ধবয়সে আমার মান গেল, যশ গেল, জাতি গেল, এখন একঘরে হয়ে থাকতে হবে। কেন মরতে বুড়ো বয়সে তোমাকে আবার বিয়ে করেছিলাম, তোমারই জন্য আজ এই অপমান। শাস্ত্রেই আছে, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। তোমার কথা শুনে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেচি। যাও, তোমার মেয়ে নিয়ে আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও।

আহা! গৃহিনীর দুঃখের কথা বলিয়া কাজ নেই। এদিকে এই, আর ওদিকে আর এক বিপদ। অনুপমা ঘন ঘন মূর্ছা যাইতেছে।

এদিকে রাত্রি বাড়িয়া চলিতেছে—দশটা, এগারটা, বারোটা করিয়া ক্রমশঃ একটা দুইটা বাজিয়া গেল; কিন্তু কোথাও সুরেশের সন্ধান হইল না।

সুরেশকে পাওয়া যাক আর না যাক, অনুপমার বিবাহ কিন্তু দিতেই হইবে। কেননা আজ রাত্রে বিবাহ না হইলে জগবন্ধুবাবুর জাতি যাইবে।

রাত্রি আন্দাজ তিনটার সময় পঞ্চাশদ্বর্ষীয় কাসরোগী রামদুলাল দত্তকে পাড়ার পাঁচজন—জগবন্ধুবাবুর হিতৈষী বন্ধু, বরবেশে খাড়া করিয়া লইয়া আসিল।

অনুপমা যখন শুনিল, এমনি করিয়া তাহার মাথা খাইবার উদ্যোগ হইতেছে, তখন মূর্চ্ছা ছাড়িয়া দিয়া জননীর পায়ে লুটাইয়া পড়িল—ও মা! আমায় রক্ষা কর, এমন করে আমার গলায় ছুরি দিও না। এ বিয়ে দিলে আমি নিশ্চয়ই আত্মঘাতী হব।

মা কাঁদিয়া বলিলেন, আমি কি করব মা!

মুখে যাহাই বলুন না, কন্যার দুঃখে ও আত্মগ্লানিতে তাঁহার হৃদয় পুড়িয়া যাইতেছিল, তাই কাঁদিয়া কাটিয়া আবার স্বামীর কাছে আসিলেন—ওগো, একবার শেষটা ভেবে দেখ, এ বিয়ে দিলে মেয়ে আমার বিষ খাবে।

কর্তা কোন কথা না কহিয়া একেবারে অনুপমার নিকটে আসিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, ওঠো, ভোর হয়ে যায়।

কোথায় যাব বাবা?

এখনই সম্প্রদান করব।

অনুপমা কাঁদিয়া ফেলিল—বাবা, আমাকে মেরে ফেল, আমি বিষ খাব।

যা ইচ্ছে হয় কাল খেয়ো মা, আজ বিয়ে দিয়ে আমার জাত বাঁচাই, তারপর যেমন খুশি করো, বিষ খেও, জলে ডুবে ম’রো, আমি একবারও বারণ করব না।

কি নিদারুণ কথা! এইবার যথার্থ-ই অনুপমার ভিতর পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিল—বাবা! আমার রক্ষা কর।

কত কাতরোক্তি, কত ক্রন্দন, কিন্তু কোন কথাই খাটিল না। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জগবন্ধুবাবু সেই রাত্রেই বৃদ্ধ রামদুলাল দত্তের হস্তে অনুপমাকে সম্প্রদান করিলেন।

বহুকাল বিপত্নীক বৃদ্ধ রামদুলালের আপনার বলিতে সংসারে আর কেহ নাই। দুইখানি পুরাতন ইষ্টকনির্মিত ঘর একটু শাক-সব্জির বাগান—ইহাই দত্তজীর সাংসারিক সম্পত্তি। বহুক্লেশে তাঁহার দিন গুজরান হয়। বিবাহ করিয়া পরদিন অনুপমাকে বাড়ি আনিলেন; সঙ্গে সঙ্গে অনেক খাদ্যদ্রব্য আসিল; অনেক দাসদাসী আসিল—কোন ক্লেশ নাই, ছয়-সাতদিন তাঁহার পরম সুখে অতিবাহিত হইল। বড়লোক শ্বশুর—আর তাঁহার কোনও ভাবনা নাই; বিবাহ করিয়া কপাল ফিরিয়াছে। কিন্তু অনুপমার স্বতন্ত্র কথা; আর দিন-দুই থাকিয়া সে পিত্রালয়ে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার মুখ দেখিয়া দাসদাসীরাও গোপনে চক্ষু মুছিল।

বাড়ি গিয়া প্রানত্যাগ করিব, এ পরামর্শ অনুপমা স্বামিভবন হইতেই স্থির করিয়া রাখিয়াছিল। এইবার যথার্থ মরিবার বাসনা হইয়াছে। অনেক রাত্রে সকলে নিদ্রিত হইলে সে নিঃশব্দে খিড়কির দ্বার খুলিয়া, বাগানের পুষ্করিনীর সোপানে আসিয়া বসিল। আজ তাহাকে মরিতে হইবে, মুখের মরা নয়, কাজের মরা মরিতে হইবে। অনুপমার মনে পড়িল, আর একদিন সে এইখানে মরিতে গিয়াছিল, সেও অধিকদিন নয়, কিন্তু তখন মরিতে পারে নাই; কেননা একজন ধরিয়া ফেলিয়াছিল। আজ সে কোথায়? জেলখানায় কয়েদ খাটিতেছে। কোন্‌ অপরাধে ? শুধু বলিতে আসিয়াছিল যে, সে তাহাকে ভালবাসে। কে জেলে দিল ? চন্দ্রবাবু। কেন ? তাহাকে দেখিতে পারিত না বলিয়া, সে মাতাল বলিয়া, সে অনধিকার প্রবেশ করিয়াছিল বলিয়া। কিন্তু অনুপমা কি বাঁচাইতে পারিত না? পারিত, কিন্ত তাহা করে নাই, বরং জেলে দিতে সহায়তাই করিয়াছে। আজ তাহার মনে হইল, ললিত কি যথার্থ-ই ভালবাসিত ? হয়ত বাসিত, হয়ত বাসিত না। না বাসুক, কিন্ত, তাহাকে দন্ডিত করিয়া তাহার কি ইষ্ট-সিদ্ধি হইয়াছে? জেলে পাথর ভাঙ্গিতেছে, ঘানি টানিতেছে, আরও কত কি নীচ কর্ম করিতে হইতেছে; ইহাতে হয়ত চন্দ্রবাবুর লাভ হইয়াছে, কিন্তু তাহার কি ? সে দন্ডিত না হইলে কি তাহাকে পাইতে পারিত?—যিনি এখন মনের আনন্দে নিজের উন্নতির জন্য জাহাজে চড়িয়া বিলাত যাইতেছেন? অনুপমা সেইখানে বসিয়া বহুক্ষণ ধরিয়া কাঁদিল, তাহার পর জলে নামিল। এক হাঁটু, এক বুক, গলা করিয়া, ক্রমশঃ ডুবন-জলে আসিয়া পড়িল। আধ মিনিট কাল জলতলে থাকিয়া অনেক জল খাইয়া সে আবার উপরে ভাসিয়া উঠিল; আবার ডুব দিল, আবার ভাসিয়া উঠিল।

0 Shares