অরক্ষণীয়া

দুর্গা রাজি হইলেন। তাঁহার সম্মতির এখন আর কোন বিশেষ কোন কারণ ছিল না; শুধু এই ‘পোড়া কাঠে’র যত্ন ও আত্মীয়তা হইতে বাহির হইবার জন্যই মন যেন তাঁহার অহরহ পালাই পালাই করিতে লাগিল।

যাত্রার উদ্যোগ হইতেছে শুনিয়া শম্ভু বাঁকিয়া বসিলেন। তখন সকাল সাতটা-আটটা, শম্ভু সন্ধ্যা-আহ্নিক সারিয়া খটখট শব্দে বাহিরে আসিয়া ডাকিলেন, দুর্গা!

দুর্গা দাওয়ার একপ্রান্তে খুঁটি ঠেস দিয়া মুখ ধুইতেছিলেন। জ্ঞানদা কাছে বসিয়া সাহায্য করিতেছিল। দাদার আহ্বানে দুর্গা সাড়া দিলেন।

শম্ভু কহিলেন, এখন ত তোমার যাওয়া হতে পারে না।

কেন দাদা?

কেন দাদা! আমি কি তোমার জন্যে কথা দিয়ে মিথ্যাবাদী হব নাকি? সে জন্ম আমার নয়। কথাটা না জানিয়াও দুর্গার বুকের ভিতরে তোলপাড় করিতে লাগিল। মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিসের কথা, দাদা?

শম্ভু কহিলেন, গেনির বিয়ের। আর ত আমি রাখতে পারিনে—কাজেই আমাদের নবীনের সঙ্গেই সামনের পাঁচুই ফাগুনে কথাবার্তা পাকা করে ফেলতে হ’ল। এদিকে গয়নাগাটিও মন্দ দেবে না বলচে। দেখতে শুনতে সবদিকেই ভাল হবে, দেখলাম কিনা।

খবর শুনিয়া দুর্গার মাথায় বাজ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কাঁদ-কাঁদ হইয়া কহিলেন, আমাকে না বলে কেন কথা দিলে, দাদা? এ বিয়ে ত আমি প্রাণ থাকতে দিতে পারব না।

শম্ভু ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, পারব না বললেই হবে? আমি মামা—আমি যা বলব, তাই হবে। তোর জন্যে কথার নড়চড় করব, তেমন বাপে আমাকে জন্ম দেয়নি—তা জানিস?

এইবার দুর্গা সত্যি সত্যিই কাঁদিয়া ফেলিলেন; কহিলেন, না দাদা, মেয়ের বিয়ে এখানে আমি মরে গেলেও দেব না—আমার জন্যে তুমি এতটুকু ভেব না দাদা—কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া কথাটা তিনি শেষ করিতেই পারিলেন না ৷

শম্ভু এই কান্না দেখিয়া মহাবিরক্ত হইয়া দাঁত খিঁচাইয়া কহিলেন, শুভকর্মে মিছে কাঁদিস নে ভ্যানভ্যান করে। যা হবার নয়, যা পারব না—

রঙ্গস্থলে ‘পোড়া কাঠ’ দেখা দিলেন। দুই হাত গোবর-মাখা—বোধ করি, তখনো গোয়ালঘরের ব্যবস্থাই করিতেছিলেন। উঠানের উপর আসিয়া স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া অকস্মাৎ ভাঙ্গা-কাঁসির মত খ্যানখ্যান করিয়া বাজিয়া উঠিলেন—বলি সুপাত্তরটি কে গা ঠাকুর? একবার শুনতে পাইনে?

শম্ভু স্ত্রীর ভাবগতিক দেখিয়া বিচলিত হইলেন। কিন্তু মুখের সাহস বজায় রাখিয়া কহিলেন, যেই হোক, তোর তাতে কি?

‘পোড়া কাঠ’ গোবর-মাখা হাত দু’খানা নাড়া দিয়া অর্ধেক উঠানটা যেন নাচিয়া আসিল। তেমনি সুমধুর-কণ্ঠে সমস্ত পাড়াটা সচকিত করিয়া কহিল, মামা! মামাত্বি ফলাতে এসেছেন! নবীনের সঙ্গে বিয়ে দেব! তা হলে একশ’ টাকা সুদে-আসলে শোধ যায়, না? তাই সে সুপাত্তর? আমার নিজের দাদা, আমি জানিনে? তাড়ি-গাঁজা খেয়ে পাঁচ ছেলের মা বৌটাকে আট মাস পেটের ওপর লাথি মেরে, মেরে ফেললে কিনা,—তাই অমন সুপাত্তর আর নেই? গলায় দেবার দড়ি জোটে না তোমার? ধিক! ধিক!

শম্ভু ভগিনী ভাগিনেয়ীর সমক্ষে ক্রোধ সংবরণ করিতে পারিলেন না। পায়ের খড়ম হাতে লইয়া চিৎকার করিলেন, চুপ কর্‌ বলচি, হারামজাদী!

‘পোড়া কাঠ’ এইবার ক্ষেপিয়া উঠিল। সে এমনি একটা ভয়ঙ্কর ভঙ্গী করিয়া চেঁচাইতে লাগিল যে, সে বস্তু চোখে না দেখিলে শুধু লেখা পড়িয়া বোঝা যায় না, কহিল, অ্যাঁ আমাকে হারামজাদী? ফের মুখে আনলে পোড়া কাঠ যদি না মুখে গুঁজে দি ত, পাঁচু ঘোষালের মেয়ে নই আমি। জোর করে বিয়ে দেবে? কেন, কে তুমি? ও এসেছে মেয়ে নিয়ে দু’দিন জুড়োতে, কেন তুমি ওকে রাতদিন ভয় দেখাবে? আঁশ-বটিটা আমার দেখে রেখো। শালা-ভগ্নীপোতের একসঙ্গে নাক-কান কেটে তবে ছাড়ব। আমার নাম ভামিনী, তা মনে রেখো।

সে মূর্তির সামনে শম্ভু আর কথা কহিলেন না—ঘরে চলিয়া গেলেন।

‘পোড়া কাঠ’ তখন দুর্গার পানে ফিরিয়া চাহিয়া কহিল, ও কি সোজা চামার, ঠাকুরঝি! তোমার আসা পর্যন্ত মতলব আঁটচে,—কি করে অমন সোনার প্রতিমা বাঁদরের হাতে দিয়ে ধার শোধ করে জমি খালাস করে নেবে। আবার বলে—মামা আমি!

একটুখানি দম লইয়া কহিতে লাগিল, বললে তুমি মনে কষ্ট করবে, আমি বলতাম না, ঠাকুরঝি। বললাম, মেয়েটা জ্বরে মরে যায়, একটা ভাল ডাক্তার আনো। বললে, অত পয়সা নেই আমার। সম্বলের মধ্যে সম্বল, একগাছি রূপার গোট ছিল আমার, তাই বাঁধা দিয়ে আমি ডাক্তার ডেকে আনলাম—আর ও বলে কিনা যা খুশি করব—আমি মামা! মুখপোড়া। আমি বেঁচে থাকতে ভয় কি ঠাকুরঝি! আমি আজই বন্দোবস্ত করে দিচ্চি, তুমি বাড়ি গিয়ে মেয়ের বিয়ে দাও গে—দিয়ে যখন খুশি আবার এসো।

দুর্গা খুঁটি ঠেস দিয়া তেমনি বসিয়া রহিলেন—তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া কেবল ঝরঝর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।

‘পোড়া কাঠ’ কণ্ঠস্বর কিঞ্চিৎ খাটো করিয়া অদৃশ্য স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, অনাথ বলে ওর ওপর জুলুম করবে কেন, মাথার ওপর ভগবান নেই কি? আমি বলি, যা তোমার আছে, তাই নিয়ে নাড়ো-চাড়ো খাও-দাও। পরের নিয়ে নিজের পেট মোটা করব কি জন্যে? ভগবান কখনো তার ভাল করেন না।

সেই দিনেই দুপুরবেলা যাত্রার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক হইয়া গেল।

গরুর গাড়িতে উঠিতে গিয়া দুর্গা ‘পোড়া কাঠে’র দু’পায়ের উপর মাথা পাতিয়া আজ সত্য সত্যই তাহা অশ্রুজলে ভিজাইয়া ফেলিলেন। কহিলেন, বৌ, বড় ভাজ তুমি, তোমাকে ত আশীর্বাদ করতে পারিনে—কিন্তু ভগবান তোমাকে যেন দেখেন। আমার জন্যে তুমি তোমার গোটছড়াটি পর্যন্ত নষ্ট করে ফেললে।

‘পোড়া কাঠ’ আদ্যন্ত মাড়ী বাহির করিয়া হাসিয়া কহিল, ছাই গোটছড়া! এই বল ঠাকুরঝি, হাতে নোয়া নিয়ে স্বামী-পুত্তরের, গো-ব্রাহ্মণের সেবা করে যেন যেতে পারি। নাও, রোগা শরীরে আর দাঁড়িয়ে থেকো না—গাড়িতে উঠে বসো। গেনি, মামা-মামীর ঘরে অনেক কষ্ট পেয়ে গেলি মা; কিন্তু আবার আসিস—ভুলিস নে যেন। বলিয়া তাহার হাতের মধ্যে জোর করিয়া দুটি টাকা গুঁজিয়া দিল।

0 Shares