অরক্ষণীয়া

ছোটবৌ ছিল না। একটা ব্যথার মত হওয়াতে আজ সে ঘর ছাড়িয়া বাহির হয় নাই। ফিরিবে ফিরিবে করিয়াও নিজের অজ্ঞাতসারে বোধ করি জ্ঞানদার একটু বিলম্ব ঘটিয়াছিল, অকস্মাৎ বজ্রাহতপ্রায় হইয়া দেখিল, সে যে ভয় করিয়াছিল ঠিক তাই,—মা হেলিয়া-দুলিয়া সেইদিকে চলিয়াছেন।

ছুটিয়া গিয়া দুই বাহু দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া ব্যাকুলকণ্ঠে কহিল, যেয়ো না মা, ফেরো।

দুর্গা চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিলেন, কেন?

কেন, জানিনে মা, তুমি ফেরো। তার ত কোন আশাই নেই মা—

আমাকে ছাড়্‌ হতভাগী—ছেড়ে দে! বলিয়া অমানুষিক বলে দুর্গা নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া অগ্রসর হইয়া গেলেন। জ্ঞানদা কলের পুতুলের মত তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। সবাই আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া দেখিল—মেজবৌ।

তাঁহার সেই কঙ্কালসার মুখমণ্ডলে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের দৃষ্টি ছিল। সে দুটা জ্বলন্ত চক্ষুর পানে চাহিয়া অতুল সভয়ে দৃষ্টি অবনত করিল।

দুর্গা বলিলেন, অতুল, আমরা তোমার কি করেছিলাম যে, এমন করে আমাদের সর্বনাশ করলে?

অতুল জবাব দিবে কি, অপরাধের ভারে ঘাড় তুলিতেই পারিল না।

সেই কাজটা করিলেন স্বর্ণ। হৃদয় বলিয়া তাহার ত কোন বালাই ছিল না; তাই অতি সহজেই মুখ তুলিয়া কহিলেন, কেন, কি সর্বনাশ করেচে শুনি?

দুর্গা বলিলেন, তোমাকে তার কি জবাব দেব, দিদি, যাকে বলচি সেই জানে সে কি করেচে।

স্বর্ণ কহিলেন, আমরাও ঘাস খাইনে মেজবৌ, কিন্তু, ও কি তোমার মেয়েকে বিয়ে করবে বলে লেখাপড়া করে দিয়েছিল যে, এত লোকের মাঝখানে তেড়ে এসেচ? যাও, ঘরে যাও—পাল-পার্বণ আমোদ-আহ্লাদের দিনে আমার বাড়িতে বসে অনাছিষ্টি কাণ্ড ক’রো না।

অনাছিষ্টি কাণ্ড আমি করতে আসিনি দিদি। বলিয়া অতুলের পানে চাহিয়া বলিলেন, যে করে আমাদের এই একটা বছর কেটেছে অতুল, সে তুমি জান না—কিন্তু ভগবান জানেন। কিন্তু, এই যদি তোমার মনে ছিল, কেন তাঁর মরণকালে আশা দিয়েছিলে? কেন তুমি তখনি জানালে না?

স্বর্ণ রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, বাছাকে তুমি ভগবান দেখিয়ো না বলচি, মেজবৌ ভাল হবে না। আমারা বেঁচে থাকতে কথা দেবার কর্তা ও নয়।

এত লোকের সমক্ষে অতুল নিজেকে অপমানিত বোধ করিতেছিল; মাসির জোর পাইয়া কহিল, আমি কি নিজে বিয়ে করব বলে কথা দিয়েছিলাম? আমার পা ছাড়ে না—পায়ের উপর পড়ে মাথা খুঁড়তে লাগল—বাবাকে নিজের মুখের কথা দাও| করি কি? অত লোকের সামনে আমি লজ্জায় বাঁচিনে—তাই পা ছাড়াবার জন্যে যদি একটা কৌশল করে থাকি, তাকে কি কথা দেওয়া বলে?

স্বর্ণ খিলখিল করিয়া হাসিয়া কহিলেন, ওমা কি ঘেন্নার কথা অতুল,—তুই বলিস কি রে? ছুঁড়ি নিজে পায়ে ধরে বলে—আমায় বিয়ে কর? অ্যাঁ?

অতুল কহিল, সত্যি কিনা, ওঁকেই জিজ্ঞাসা কর না? মেজমাসিমা নিজেই বলুন না, আমার পায়ের উপর মাথা খুঁড়তে দেখেছিলেন কিনা। নইলে ঐ মেয়েকে আমি বিয়ে করতে যাব? আমার কি মরবার দড়ি-কলসী জোটে না?

অতুলের সঙ্গীরা মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া উঠিল। দুর্গা উন্মাদের মত চেঁচাইয়া উঠিলেন, ওরে নিষ্ঠুর! ওরে কৃতঘ্ন! দড়ি-কলসী আমি কিনে দেব রে, তুই মর গে! তোর মরাই উচিত। যে মেয়েকে তুই এত লোকের সুমুখে এতবড় অপমান করলি, সেই মেয়েই যে তোকে যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল রে! সব ভুলে গেলি?

চিৎকার শুনিয়া ছোটবৌ ব্যথা ভুলিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখিল, স্বর্ণ লাফাইয়া উঠিয়াছে—তবে লো হতভাগী! বেরো আমার বাড়ি থেকে—বেরো বলচি।

জ্ঞানদা দাঁড়াইয়া ছিল। কিন্তু সে অচেতন পাথর হইয়া গিয়াছিল। লজ্জা, ঘৃণা, অভিমান, অপমান, ভালমন্দ কিছুই তাহাকে স্পর্শ করিতেছিল না। এ-সমস্তরই যেন সে একান্ত অতীত হইয়াই নীরবে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই অদৃষ্টপূর্ব মূর্তির প্রতি চাহিয়া ছোটবৌ সভয়ে একটা ঠেলা দিয়া ডাকিল,—জ্ঞানদা? সে ঘরের ভিতর হইতেই কলহের কিছু কিছু শুনিতে পাইয়াছিল।

জ্ঞানদা জবাব দিল, কেন খুড়ীমা!

আর কেন দাঁড়িয়ে মা, তোর মাকে ঘরে নিয়া যা।

মা চল, বলিয়া মায়ের হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে তাঁহাকে ঘরে লইয়া গেল।

স্বর্ণ কহিলেন, দেখলি ছোটবৌ, আস্পর্ধা! একেই বলে, বামন হয়ে চাঁদে হাত।

অতুল হাসিবার মত করিয়া দাঁত বাহির করিয়া কহিল, শুনলেন ছোটমাসিমা কাণ্ডটা? কি ভয়ানক লজ্জা!

স্বর্ণ খনখন করিয়া বলিলেন, একফোঁটা মেয়ে,—এ কি ঘোর কলি! ছোটবৌ একটুখানি হাসিয়া কহিল,—ঘোর কলি বলেই বাঁচোয়া দিদি! নইলে আর কোন কাল হলে, মা বসুন্ধরা এতক্ষণ লজ্জায় দু’ফাঁক হয়ে যেতেন অতুল। বলিয়া ঘরে চলিয়া গেল।

স্বর্ণ বিদ্রূপের তাৎপর্য না বুঝিয়া খুশি হইয়া বলিলেন, সেই কথাই ত বলচি ছোটবৌ!

কিন্তু অতুলের মুখ কালো হইয়া উঠিল। ছোটবৌয়ের কথার তাৎপর্য স্বর্ণ না বুঝিলেও সে বুঝিয়াছিল। তাই খানিকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিয়া যখন সে উঠিয়া গেল, তখন মনে হইল, এই হোলির দিনে কে যেন তাহার জামায় কাপড়ে লাল রঙ এবং মুখে গাঢ় কালি লেপিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে।

আসল কথাটা এতদিন অপ্রকাশ ছিল বটে, কিন্তু আর রহিল না। পাড়ার হিতাকাঙ্ক্ষিণীদের কথায় অচিরেই দুর্গার কানে গেল যে, এই বাড়িতেই অতুল আবদ্ধ হইয়াছে। অনাথেরই বড়মেয়ে মাধুরীর সঙ্গেই তাহার বিবাহ সম্বন্ধ স্থির হইয়াছে। ঘটকালি স্বর্ণ করিয়াছেন এবং মেয়ে দেখিয়া অতুলের ভারী পছন্দ হইয়াছে।

আট

মাধুরী শিশুকাল হইতেই কলিকাতায় মামার বাড়ি থাকে। মহাকালী পাঠশালায় পড়ে। ইংরাজী, বাংলা, সংস্কৃত শিখিয়াছে। গাহিতে, বাজাইতে, কার্পেট বুনিতেও জানে; আবার শিব গড়িতে, স্তোত্র আওড়াইতেও পারে। দেখিতেও অতিশয় সুশ্রী। এইবার পূজার সময় মাস-দুয়ের জন্য বাটী আসিয়াছিল; সেই সময়েই কথাবার্তা পাকা হইয়া গিয়াছে। অতুলের মত দুর্লভ পাত্র চেষ্টা করিয়া সংগ্রহ করিতে হয় নাই, পাত্র আপনিই ধরা দিয়াছে। অবশ্য স্বর্ণ মাঝখানে ছিলেন।

0 Shares