অরক্ষণীয়া

ছোটবৌয়ের ভাইয়েরা অবস্থাপন্ন। মা বাঁচিয়া আছেন, আসন্ন-প্রসবা মেয়েকে তিনি বাড়ি লইয়া যাইবার জন্য লোক পাঠাইলেন, সঙ্গে মাধুরীও আসিল। মেজজ্যাঠাইকে সে অনেকদিন দেখে নাই, আসিয়াই প্রণাম করিতে আসিল।

দীর্ঘজীবী হও মা! বলিয়া আশীর্বাদ করিয়া দুর্গা নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া রহিলেন। একে সে সুন্দরী, তাহাতে মামী সাজাইয়া-গুছাইয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল। মামী কলিকাতার মেয়ে—কেমন করিয়া সাজাইয়া দিতে হয় জানে। গায়ে গুটি কয়েক বাছা বাছা স্বর্ণালঙ্কার; পরনে কোঁচানো চওড়া লালপেড়ে শাড়ি; পিঠের উপর চুল এলো করা; কপালে টিপ। চাহিয়া চাহিয়া দুর্গার চোখের পাতা আর পড়ে না। হঠাৎ একটা দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিল—আহা! মেয়ে ত নয়—যেন স্বর্ণ-প্রতিমা! এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার পদতলে উপবিষ্টা নিজের ঐ মলিন, শ্রীহীন মেয়েটার পানে চাহিয়া তাঁহার দু’চক্ষু সহসা যেন জ্বলিয়া গেল;—পাশ ফিরিয়া রুক্ষস্বরে কহিলেন, আর আমি মেয়ে পেটে ধরেচি যেন কাল্‌প্যাঁচা!

মাধুরী ঘরে ঢুকিবামাত্রই তাহার রূপ এবং সাজসজ্জার পানে চাহিয়া জ্ঞানদা নিজেই ত হীনতার সঙ্কোচে মাটির সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিল। মাধুরী কহিল, দিদি, চল না, একটু গল্প করি গে।

প্রত্যুত্তর জ্ঞানদা অব্যক্ত স্বরে কি কহিল, বোঝা গেল না। কিন্তু সেই শব্দটা মাত্র শুনিতে পাইয়াই দুর্গা তিক্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, ও পোড়ামুখ লোকের সামনে আর বার করিস নে গেনি—বসে থাক। জ্ঞানদা নীরবে বসিয়া রহিল।

মাধুরী চলিয়া গেলে, দুর্গা বোধ করি নিতান্তই মনের জ্বালায় বার-দুই আঃ উঃ করিলেন। জ্ঞানদা আস্তে আস্তে কহিল, কপালটা একটু টিপে দেব মা?

না।

ওষুধটা একবার—

ওলো, না, না, না। যা, আমার বিছানা থেকে উঠে যা, হারামজাদী! তোর মুখ দেখলেও আমার সর্বাঙ্গ যেন জ্বলেপুড়ে যায়। বলিয়া পা দিয়া তিনি মেয়েকে সজোরে ঠেলিয়া দিলেন।

জ্ঞানদা অনেক সহিয়াছিল; কিন্তু লাথিটা সহ্য করিতে পারিল না। নিঃশব্দে নীচে নামিয়া আসিয়া একেবারে মেঝের উপর উপুড় হইয়া পড়িল, এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাহার দু’চক্ষের জলে মাটি ভিজিয়া গেল। দুই হাত সম্মুখে প্রসারিত করিয়া দিয়া মনে মনে বলিতে লাগিল,—ভগবান! আমি কার কাছে কি দোষ করিয়াছি যে সকলেরই চক্ষুশূল। আমার রূপ নাই, বসন-ভূষণ নাই, আমার বাপ নাই, সে কি আমার দোষ? আমার রোগগ্রস্ত এই কঙ্কালসার দেহ, এই জীর্ণ পাণ্ডুর মুখ যে একজনকে আকর্ষণ করিতে পারিল না, সে কি আমার ত্রুটি? আমার বিবাহ দিতে কেহ নাই, তবুও আমার বয়স বাড়িয়া যাইতেছে—সেও কি আমার অপরাধ? প্রভু! এতই যদি আমার দোষ, তবে আমাকে আমার বাবার কাছে পাঠাইয়া দাও—তিনি আমাকে কখনও ফেলিতে পারিবেন না|

জ্ঞানদা! বলিয়া দুর্গা পাশ ফিরিলেন। মায়ের ডাকে সে চোখ মুছিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল।

রোগা শরীর, ভিজে মাটির ওপর কেন মা? বলিয়া দুর্গা উৎকণ্ঠায় নিজেই উঠিয়া বসিলেন।

ওঃ, বকেচি বুঝি মা! বলিয়া চক্ষের পলকে দুই হাত বাড়াইয়া মেয়েকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া ফুকারিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।

আজ সন্ধ্যার পরে হঠাৎ অনাথ দুর্গামণির ঘরে ঢুকিয়া বিমর্ষমুখে কহিল, আজ কেমন আছ মেজবৌঠান? থাক থাক, আর উঠো না। তা—তা ওষুধপত্র কিছুই খেতে চাও না শুনলাম—অমন করলে ত আরাম হতে পারবে না!

কথাটা সত্য। যদিচ ঔষধ যাহা দেওয়া হইতেছিল, তাহা না দিলেও ক্ষতি ছিল না; কিন্তু সেও তিনি একেবারে খাওয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার বাঁচিবার আশাও ছিল না, ইচ্ছাও ছিল না। কণ্ঠস্বর প্রতিদিন গহ্বরে ঢুকিতেছিল—খুব কাছে না আসিলে আজকাল আর শুনিতেই পাওয়া যাইত না। দেবরের আকস্মিক আত্মীয়তায় দুর্গা শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। তথাপি অব্যক্ত স্বরে প্রত্যুত্তরে যাহা কহিলেন, অনাথ ঘাড়টা কাত করিয়া, বিশেষ চেষ্টা করিয়া শুনিয়া, বলিলেন, সে ত সত্যি কথাই বৌঠান। বিধবা হয়ে আর বেঁচে লাভ কি,—কোন্‌ হিন্দুসন্তান এ কথার প্রতিবাদ করবে বল? তবে কিনা, আত্মহত্যাটা না করে কোনগতিকে ক’টা দিন সংসারে থাকা! তোমার আবার যে-রকম দেহের অবস্থা, তাতে এসব কথা আমার না বলাই উচিত, কিন্তু না বললেও যে নয় কিনা, তাই বলি কি, নিজেও দেখতে পাচ্চ—চেষ্টার আমি ত্রুটি করচি নে; কিন্তু কি হতভাগা মেয়ে—কোনমতেই কি একটা গাঁথচে না। ছ-সাতটা সম্বন্ধ—সব ক’টাই ভেঙ্গে গেল—মেয়ে দেখে আর কারুর পছন্দ হ’লো না।

দুর্গা কিছুই বলিলেন না। একটুখানি থামিয়া অনাথ পুনরায় কহিতে লাগিল, মেজদা মরে তুমি আবার আমার সংসারে এসেছ কিনা! গোল হচ্ছে ত তাই নিয়ে। নীলকণ্ঠ মুখুয্যেকে ত চেনই—বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেশ তালগোল পাকাচ্চে—তোমার ছুতো করে আমাকে কি করে ঠেলবে। আর, তাদের দোষই বা দিই কি করে, নিজেরাও ত মেয়ের বয়সটা দেখতে পাচ্চি! আবার তাও বলি, শহরে বাপু এত নেই—পোড়া পাড়াগাঁয়েই আমাদের যত হাঙ্গামা, যত বিচার। বলিয়া জোর করিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল।

দেবর যে কিসের ভূমিকা করিতেছেন, কোন্‌দিকে ইহার গতি—তাহা ধরিতে না পারিয়া দুর্গা তেমনি নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন; কিন্তু শীর্ণ মুখের উপর একটা অনিশ্চিত শঙ্কার ছায়া পড়িল।

একবার কাশিয়া একটু ইতস্ততঃ করিয়া অনাথ এইবার আসল কথা প্রকাশ করিল; কহিল, তোমার এ অবস্থায় সত্যিই ত আর কোথাও যাওয়া-আসা চলে না—সে আমি বলিনে; কিন্তু কি জান মেজবৌঠান—নিজের মেয়েটাও ত বিবাহযোগ্য হ’ল,—তাই আমি বলি কি জান,—সব দিক আমার বাঁচিয়ে চলা ত আবশ্যক,—আমি বলি কি—গেনিকে এ সময় আর কোথাও না পাঠালেই নয়। এ বাড়িতে আর ত তাকে রাখা যায় না। বড্ড হৈচৈ হচ্চে।

দুর্গার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ওষ্ঠাধরের মধ্যেই যেন মিলাইয়া গেল,—কোথায় সে যাবে ঠাকুরপো?

অনাথ কহিল, হরিপালেই যাক।

0 Shares