অরক্ষণীয়া

কে একজন প্রশ্ন করিল, কে এমন ভূত সাজিয়ে দিলে বড়বৌ? বুড়োর পছন্দ হ’ল না বুঝি?

স্বর্ণ তাহার প্রতি চাহিয়া, তর্জন করিয়া কহিলেন,—নিজে সেজেছেন—আবার কে সাজাবে? মা ত অজ্ঞান-অচৈতন্য। বলে দিলাম, শুধু একখানি কাপড় পরে আয়। তা পছন্দ হ’ল না। ভাবলেন, সেজেগুজে না গেলে যদি বুড়োর মনে না ধরে? আর সাজের মধ্যে ত ঐ ছোপানো কাপড়খানি, আর অতুলের দেওয়া এই দু-গাছি চুড়ি। তা দিনের মধ্যে দশবার খুলে তুলে রাখচে, দশবার হাতে পরচে। কালীমুখীর ও-চুড়ি হাতে দিয়ে বার হতে লজ্জাও করে না? বেরো সুমুখ থেকে—দূর হয়ে যা—

বেহায়া মেয়েটার এই নির্লজ্জ চরিত্রের সবাই সমালোচনা করিয়া, ছি ছি করিয়া চলিয়া গেল; শুধু যাঁহার কাছে কিছুই অজ্ঞাত থাকে না, সেই অন্তর্যামীর চোখ দিয়া হয়ত বা একফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল। তিনিই শুধু জানিলেন,—যে মেয়েটা আজন্মকাল লজ্জায় কখনো মুখ তুলিয়া কথা কহিতেই পারিত না, সে কেমন করিয়া, আজ সকল লজ্জায় পদাঘাত করিয়া নিজের ওই স্বাস্থ্য-শ্রীহীন দেহটাকে স্বহস্তে সাজাইয়া আনিয়া ঐ অতিবৃদ্ধটার পদেই ঠকাইয়া বিক্রি করিতে গিয়াছিল! কিন্তু বিক্রি হইল না—ফাঁকি ধরা পড়িল। আজ তাই সবাই ছি ছি করিয়া ধিক্কার দিয়া গেল—কেহই ক্ষমা করিল না। কিন্তু অন্তরে বসিয়া যিনি সর্বকালে সর্বলোকের বিচারক, তিনি হয়ত দুর্ভাগা বালিকার এই অপরাধের ভার আপনার শ্রীহস্তেই গ্রহণ করিলেন।

জ্ঞানদা উঠিয়া দাঁড়াইল। কখনো সে পরের সমক্ষে কাঁদে নাই—আজ কিন্তু অতুলের সম্মুখে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। অথচ, একটা কথারও কৈফিয়ত দিল না, কাহারো পানে চাহিয়া দেখিল না—নীরবে চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেল।

কলিকাতা যাইবার আর গাড়ি ছিল না বলিয়া অতুল সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়া গেল। পথে সব কথা ছাপাইয়া ছোটমাসির সেই শেষ কথাটাই বারংবার মনে পড়িতে লাগিল। সেদিন বাপের বাড়ি যাইবার সময় অতুলকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, অতুল, হীরা ফেলে যে কাঁচ আঁচলে বাঁধে, তার মনস্তাপের আর অবধি থাকে না বাবা। সেদিন কথাটা ভাল বুঝিতে পারে নাই; কিন্তু আজ তাহার যেন নিঃসংশয়ে মনে হইল, কথাটা তাহাকেই লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছিল। লজ্জাহীনা বলিয়া যাহাকে আজ সবাই লাঞ্ছনা করিয়া বিদায় দিল, তাহারই লজ্জা-শরমের সীমারেখাটা যে কোন্‌খানে, আজ সে-কথাও তাহার স্মরণ হইল।

তখনো ভোর হয় নাই, অনাথ ডাকিতে আসিলেন,—মেজবৌকে দাহ করিতে হইবে।

চলুন যাই, বলিয়া অতুল বাহির হইয়া পড়িল। গিয়া দেখিল, দেড় বৎসর পূর্বে তুলসীমূলে পিতার পা-দুটি কোলে করিয়া যেমন বসিয়াছিল, আজও তেমনি নিঃশব্দে মায়ের পদ-দুটি কোলে লইয়া জ্ঞানদা বসিয়া আছে। শুধু একটিবার ছাড়া জীবনে কেহ কখনো তাহাকে চঞ্চল হইতে দেখে নাই––সেই যখন সে অতুলেরই পায়ের উপর পড়িয়া মাথা খুঁড়িয়াছিল। সুতরাং, তাহার এই নিবিড় নীরবতায় কেহ কিছুই মনে করিল না। সেদিকে কাহারও দৃষ্টিই ছিল না, সৎকারের উদ্যোগ-আয়োজনেই পাড়ার লোক ব্যস্ত।

যথাসময়ে তাহারা মৃতদেহ লইয়া শ্মশানে যাত্রা করিল। সকলের পিছনে জ্ঞানদাও গেল। দুঃখীর মেয়ে বলিয়া পাড়ার কোন মেয়েই তাহার সঙ্গে গেল না; যাবার কথাও কাহারো মনে হইল না।

বর্ষায় ভরা গঙ্গা শ্মশানের ঠিক নীচে দিয়াই খরবেগে বহিতেছিল। মায়ের শেষ কাজ মেয়ে নীরবে সাঙ্গ করিল। চিতা যখন ধুধু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল, তখন সে পুরুষের ভিড় হইতে সরিয়া নীচে নামিয়া একেবারে জলের ধারে গিয়া বসিল। কেহই নিষেধ করিল না; কারণ, নিষেধ করিবার কিছু ছিল না। বরঞ্চ এই গভীর শোকের দৃশ্যটাকে চোখের আড়াল করিতেই সে যে নামিয়া গেল, তাহা নিশ্চয় অনুভব করিয়া মুহূর্তের সমবেদনায় অনেকেই ‘আহা’ বলিয়া নিঃশ্বাস ফেলিল।

এই চিরদিন শান্ত পরমসহিষ্ণু মেয়েটি উৎকট কিছু যে করিয়া বসিতে পারে, সে ভয় কাহারও ছিল না। অতুলেরও না। তথাপি তাহাকে খরস্রোতের একান্ত সন্নিকটে গিয়া বসিতে দেখিয়া, তাহার বুকের ভিতরটা কেমন একরকম করিয়া উঠিল। একবার ভাবিল নিষেধ করে; একবার ভাবিল কাছে গিয়া দাঁড়ায়; কিন্তু লজ্জায়, কুণ্ঠায় কোনটাই পারিল না।

অগ্ন্যুত্তাপ বাঁচাইয়া সবাই গিয়া যেখানে বাসিয়াছিল, অতুলও গিয়া সেখানে বসিল। সম্মুখে প্রজ্জ্বলিত চিতার পানে চাহিয়া সহসা তাহার মনের মধ্যে সেই চিরদিনের পুরানো প্রশ্ন আবার নূতন করিয়া জাগিয়া উঠিল—কাল যে ছিল, আজ সে নাই; আজও যে ছিল, তাহারও ঐ নশ্বর দেহটা ধীরে ধীরে ভস্মসাৎ হইতেছে, আর তাহাকে চেনাই যায় না; অথচ, এই দেহটাকেই আশ্রয় করিয়া কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা, কত ভয়, কত ভাবনাই না ছিল! কোথায় গেল? এক নিমিষে কোথায় অন্তর্হিত হইল? তবে কি তার দাম? মরিতেই বা কতক্ষণ লাগে?

সহসা তাহার নিজেরই বিগত জীবন চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল। বছর-তিনেক পূর্বে সেও ত মরিতে বসিয়াছিল, কিন্তু মরে নাই। অজ্ঞাতসারে তাহার চোখের দৃষ্টি চিতার পিঙ্গল ধূসর ধূমের তরঙ্গিত যবনিকা ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। মনে পড়িল, সেদিন যে মরিতে দেয় নাই—সে ওই, ওই যে জাহ্নবীর ঘোলা জলে অস্পষ্ট ছায়া ফেলিয়া মূর্তিমতী শোকের মত বসিয়া আছে,––শুধু রুক্ষ কেশ ও মলিন অঞ্চল যাহার বাতাসে দুলিতেছে!

তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। মনে মনে বলিল, ছাই রূপ! রূপেরই যদি এত দাম, তবে তিন বৎসর পূর্বে রূপের হাটে সে নিজেই ত দেউলিয়া হইয়া গিয়াছিল। সেদিন পরমাত্মীয়েরাও ত ঘৃণায় তাহার পানে চাহিতে পারে নাই!

কেমন করিয়া যে সময় কাটিতেছিল, তাহার জ্ঞান ছিল না। কখন যে চিতা নিভিতেছিল, তাহাও সে দেখে নাই। সর্বক্ষণ তাহার সমস্ত দৃষ্টি শুধু ওই নিশ্চল মূর্তিটার প্রতি নিবদ্ধ হইয়া ছিল।

অনাথ কহিলেন, আর বসে কেন বাবা? এসো, শেষ কাজটা শেষ করে দিই।

0 Shares