অরক্ষণীয়া

একটুখানি মৌন থাকিয়া পুনরায় পুলকিত-চিত্তে বলিতে লাগিলেন, এখন যেখানে আমাকে বলিস সেইখানেই যাব। কিন্তু তুই ত তার মত না নিয়ে যেতে পারিস নে বাছা। তাই বটে! তাই বটে! তাই বাবা আমার ফিরে এসেই, সকাল হতে না হতে দু’গাছি চুড়ি দেবার ছল করে মাকে আমার দেখতে এসেছিল। ওগো, আর একটা বছর কেন তুমি বেঁচে থেকে চোখে দেখে গেলে না! বলিয়া তিনি উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন বস্ত্রাঞ্চল দিয়া রোধ করিলেন।

বলি মেজবৌ?

দুর্গামণি তাড়াতাড়ি মেয়েকে বুক হইতে ঠেলিয়া দিয়া, চোখটা মুছিয়া লইয়া সাড়া দিলেন, কেন দিদি?

বড়বৌ একবার ঘরের ভিতর দৃষ্টিপাত করিয়া কঠিন-স্বরে বলিলেন, তোমাদের না হয় শোকের শরীরে ক্ষিদে-তেষ্টা নেই; কিন্তু বাড়ির আর সবাই ত উপোস করে থাকতে পারে না। বেরিয়ে একবার বেলার দিকে চেয়ে দেখ দেখি।

দুর্গামণি শশব্যস্তে ঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বেলার দিকে চাহিয়া লজ্জিতমুখে মেয়ের নাম করিয়া কি একটুখানি জবাবদিহি করিতেই, স্বর্ণমঞ্জরী তীক্ষ্ণভাবে বলিলেন, বেশ ত। হেঁসেলটা চুকিয়ে দিয়ে মেয়েকে কাছে বসিয়ে সারাদিন বোঝাও না— আমি কথাটিও কব না। কিন্তু আমার ছেলে-মেয়েগুলো যে পিত্তি পড়ে মারা যায়। না বাপু, এমনধারা সব অনাছিষ্টি কাণ্ড আমি সইতে পারব না। বলিয়া নিঃসন্তান বড়বৌ ছোটবধূর সন্তানদের প্রতি মাতৃস্নেহের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়া উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা না করিয়াই চলিয়া গেলেন।

অনাথের সংসার পুনরায় প্রবেশ করা অবধি দুর্গাকেই রান্নাঘরের সমস্ত ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। তাহাতে বড়বৌ এবং ছোটবৌ উভয়েই সমস্তদিনব্যাপী ছুটি পাইয়া, একজন পাড়া বেড়াইয়া এবং খরচপত্র অত্যন্ত বেশী হইতেছে বলিয়া কোন্দল করিয়া, এবং আর একজন ঘুমাইয়া, নভেল পড়িয়া, গল্প করিয়া দিন কাটাইতেছিলেন।

অনাথ সাড়ে-আটটার ডেলি প্যাসেঞ্জার। ভোরে উঠিয়া যথাসময়ে তাঁহার আহার্য প্রস্তুত করিয়া দেওয়া, এ-বাটীতে একটা নিদারুণ অশান্তির ব্যাপার ছিল। এই লইয়া বড় এবং ছোট জায়ে প্রায়ই কথা-কাটাকাটি এবং মন-কষাকষি চলিত। এ কয়দিন এই হাঙ্গামা হইতে নিস্তার পাইয়া, উভয়ের মধ্যে অনেক দিনের পর আবার একটা ভালবাসার গ্রন্থিবন্ধনের সূচনা হইতেছিল। কিন্তু আজ সকালে হঠাৎ সেই বাঁধনটা আর একবার ছিঁড়িয়া যাইবার উপক্রম হইল। তাহার কারণ এই যে, বেলা সাতটা বাজে, এবং ঝি আসিয়া সদ্যনিদ্রোত্থিত ছোটবধূকে জানাইল যে, কয়লার উনানের আঁচ উঠিয়া গিয়াছে, একটু তৎপর হইয়া রান্না চাপাইয়া দেওয়া আবশ্যক।

ছোটবৌ বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন, মেজদি কি করচে? বেলা সাতটা বাজে—আজ বুঝি তার সে হুঁশ নেই?

ঝি কহিল, হুঁশ কেন থাকবে না গা? ভোরে উঠে মায়ে-ঝিয়ে জিনিসপত্র গোছগাছ বাঁধাছাঁদা করচে—এই আটটার গাড়িতে হরিপাল না কোথায় যাবে যে!

ছোটবৌর কালকার কথা মনে পড়িল। কিন্তু কিছুমাত্র প্রসন্ন না হইয়া চেঁচাইয়া কহিল, যাবে বললেই যাবে নাকি? বাবুর হুকুম নিয়েচে? দিদিকে জানিয়েচে?

ঝি কহিল, বাবুর কথা জানিনে ছোটবৌমা, কিন্তু বড়মা ত নিজেই তাদের আজ যেতে বলেছিল।

তবে, তাকেই বল গে সাড়ে-আটটার ভাত দিতে—আমি জানিনে, বলিয়া ছোটবৌ ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হইয়া খানিকটা গুলগুঁড়ানো ঠোঁটের ভেতর পুরিয়া গামছাটা কাঁধে ফেলিয়া খিড়কির দিকে হনহন করিয়া চলিয়া গেল।

ঝি বলিল, থাকলে ত বলব! তিনি গেছে গঙ্গাচ্চান করতে—বলিয়া সে নিজের কাজে চলিয়া গেল।

ছোটবৌকে ফিরিতে হইল, কারণ অফিসের সাহেব তাহার রাগের মর্যাদা বুঝিবে না। হয় যা-হোক দুটা সিদ্ধ করিয়া দিতেই হইবে, না হয় স্বামীকে ঠিক সময়ে অভুক্তই যাইতে হইবে। দুটার একটা অপরিহার্য। ছোটবৌ ফিরিয়া আসিয়া দুর্গামণির দরজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, যাবেই ত। কিন্তু এমন খোলোমি করে না গেলেই কি হত না মেজদি?

এই অভাবনীয় আক্রমণে দুর্গামণি অবাক হইয়া গেলেন।

ছোটবৌ কহিল, আমরা কেউ জানিনে, তোমরা সকালেই যাবে। তিনি গেছেন গঙ্গা নাইতে। আমি ত এই উঠচি। টাইমের ভাত কি করে দিই বল দেখি?

প্রাতঃপেন্নাম হই মাসিমারা, বলিয়া অতুল বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।

ছোটবৌ ফিরিয়া আসিয়া কহিল, তুমি হঠাৎ যে অতুল?

অতুল কলিকাতার মেসে থাকে। সেখানে চিঠি পাইয়া ছুটাছুটি করিয়া এইমাত্র আসিয়া জুটিয়াছে—এখনও বাড়ি যায় নাই। কহিল, মেজমাসিমা হরিপালে গঙ্গাযাত্রা করবেন, আর শেষ দেখাটা একবার দেখতে আসব না? হরিপাল! অর্থাৎ ম্যালেরিয়ার ডিপো! তা এই আশ্বিনের শুরুতেই এমন সুবুদ্ধিটা তোমাকে কে দিলে বল দেখি, মেজমাসিমা? বাঃ—বাঁধাছাঁদা একেবারে কমপ্লিট যে! বলিয়া সে সহাস্যে ঘরের মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেই একপ্রান্ত হইতে একজোড়া জলেভরা আরক্ত চক্ষু্র টেলিগ্রাফ পাইয়া স্তব্ধ হইয়া থামিল।

ছোটবৌ প্রশ্ন করিল, তুমি কি করে খবর পেলে অতুল?

আমি? বাঃ—, বলিয়া অতুল তাহার কৈফিয়ত শেষ করিল।

অকস্মাৎ প্রাঙ্গণের কোন একটা অনির্দিষ্ট স্থান হইতে স্বর্ণমঞ্জরীর কণ্ঠস্বর শব্দভেদী বাণের মত আসিয়া প্রত্যেকের কানে বিঁধিল। অর্থাৎ তিনি গঙ্গাস্নানে শান্ত-শুচি হইয়া বাটীতে পা দিয়াই ঝির মুখে কয়লার উনুনের খবর পাইয়াছিলেন। সুতরাং মেজজায়ের সদ্য-বৈধব্যের যথার্থ হেতুটা মুক্তকণ্ঠে বলিতে বলিতে আসিতেছিলেন—চারপো পূর্ণ না হলে কি ভগবান কারু এমন সর্বনাশ করেন? করেন না। এ তাঁর ধর্মের সংসার—এখানে অধর্ম হবার জো নেই। সোজা চলিয়া আসিয়া ঘরের চৌকাঠের ভিতরে একটা পা দিয়া কহিলেন, মতলবটা ত তোমার এই, মেজবৌ—না খেয়ে উপোস করে ছোটকর্তা অফিসে যাক, সন্ধ্যাবেলা পিত্তি পরে জ্বর হয়ে বাড়ি আসুক। তারপর নিজের যেমন হয়েছে তেমনি সর্বনাশ আরো একজনের হোক।

0 Shares