অরক্ষণীয়া

প্রথমে আসিয়াই দুর্গা একদিন তাহার রান্নাবান্নার সাহায্য করিতে গিয়াছিলেন। তাহাতে সে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছিল—তুমি দু’দিনের জন্যে এসেচ ঠাকুরঝি, তোমাকে কাজ করতে হবে না। আমি রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর কাউকে দিতে পারব না। সেই অবধি দুর্গা এবিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন!

আজ বেলা দেখিয়া বৌ দোর-গোড়ায় স্বাভাবিক চিৎকারশব্দে প্রশ্ন করিল, আজ খাওয়া-দাওয়া কি হবে না ঠাকুরঝি? হেঁসেল নিয়ে বসে থাকব?

দুর্গা মুখ তুলিয়া বলিলেন, মেয়েটার ভারী জ্বর হয়েচে বৌ; তোমরা খাও গে, আমরা আজ আর কেউ খাব না। বৌ কহিল, মেয়ের জ্বর, তা তোমার কি হ’ল গো? জ্বর আবার কার না হয়? নাও, উঠে এসো। দুর্গা কাতরকণ্ঠে কহিলেন, না বৌ, আমাকে খেতে বল না—মেয়ে ফেলে আমি মুখে ভাত তুলতে পারব না।

তোমাদের সব আদিখ্যেতা, বলিয়া বৌ চলিয়া গেল। রান্নাঘর হইতে পুনরায় কহিল, জ্বর হয়েচে কবরেজ ডেকে পাঁচন সিদ্ধ করে দাও। ম্যালোয়ারী জ্বরে আবার খায় না কে? আমাদের দেশে ওসব উপোস-তিরেসের পাঠ নেই বাপু! বলিয়া সে নিজের কাজে মন দিল।

অপরাহ্নবেলায় সে নিজেই একবাটি পাঁচন সিদ্ধ করিয়া আনিয়া কহিল, ওলো ও গেনি, উঠে পাঁচন খা! ভাতে জল দিয়ে রেখেছি, চল, খাবি আয়।

মামীকে সে অত্যন্ত ভয় করিত। বিনাবাক্যে উঠিয়া খানিকটা তিক্ত পাঁচন গিলিয়া বমি করিয়া ফেলিয়া পুনরায় শুইয়া পড়িল। দুর্গা ঘরে ছিল না, বমির শব্দে ছুটিয়া আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিলেন। মামী রাগ করিয়া উঠানে গিয়া সমস্ত পাড়া শুনাইয়া বলিতে লাগিলেন, এ-সব বাবুমেয়ে নিয়ে আমাদের গরীব, দুঃখীর ঘরে আসা কেন বাপু?

সেই হইতেই জ্ঞানদার অসুখ উত্তরোত্তর বাড়িতেই লাগিল। তাহার ভামিনী-মামী সেই যে প্রথম দিনেই বলিয়াছিল, বাছা! পল্লীগ্রামে সাপের কামড়ে আর ক’টা লোক মরে, মরে যা তা ঐ ম্যালোয়ারীতে। একবার ধরলে আর রক্ষে নেই। তাহার কথাটার সত্যতা সপ্রমাণ হইতে বেশি বিলম্ব ঘটিল না, অনতিকালমধ্যেই জ্ঞানদাকে একেবারে শয্যাগত করিয়া ফেলিল। সেদিন কার্তিকের সংক্রান্তি; দুর্গা ঘরে ঢুকিয়া আশ্চর্য হইয়া দেখিলেন, বৌ জ্ঞানদার শিয়রে বসিয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে। একে ত সংসারের কাজ ছাড়িয়া এইসব বাজে কাজ করিবার তাহার অবসরই নাই, তাহাতে পরের মেয়ের প্রতি এই অযাচিত সেবাটা এমনি একটা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বিসদৃশ কাণ্ড বলিয়া দুর্গার মনে হইল যে, তিনি দাদার প্রস্তাবিত সেই বিবাহ-ব্যাপারটা স্মরণ করিয়া আশঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া উঠিলেন। ভামিনীর এই যত্নটা যে সেই জন্যই, তাহাতে আর সংশয়মাত্র রহিল না। কারণ, সে যে নিজের দাদার সহিত জ্ঞানদার বিবাহ ঘটাইবার জন্য স্বামীকে নিয়োজিত করিয়াছে এবং ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত করিতেছে, প্রথম হইতেই এই কথাটা দুর্গা স্বতঃসিদ্ধের মত মানিয়া লইয়াছিলেন। বৌ গলাটা আজ একটু খাটো করিয়াই কহিল, তারকেশ্বরে পাশ-করা ডাক্তার আছে—তোমার দাদাকে আনতে পাঠিয়ে দিয়েচি, ঠাকুরঝি। জ্বর যেন রোজ রোজ বেশিই হচ্চে—এ তো ভালো না। দুর্গা অব্যক্তস্বরে যাহা বলিলেন, তাহা শোনা গেল না, কারণ এই সুসংবাদ শুনিয়াও তিনি অন্তরের ভিতর হইতে প্রসন্ন হইতে পারিলেন না।

বৌ সংসারের কাজে চলিয়া গেল। জ্ঞানদা বালিশের তলা হইতে একখানি চিঠি বাহির করিয়া কহিল, জবাব দিয়েচেন।

কৈ দেখি, দেখি, বলিয়া মা সেখানি যেন কাড়িয়া লইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই অসহ্য আগ্রহ দমন করিয়া চিঠিখানা দুই মুঠার মধ্যে লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। একবার মনে করিলেন, খুলিয়া পড়ি। আবার ভাবিলেন, না, উচিত নয়। মেয়ে যেন হাতেই দিয়েছে, কিন্তু মা হইয়া তিনি পরিবেন কি করিয়া! মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি লিখেচে অতুল?

জ্ঞানদা ইতিমধ্যে পাশ ফিরিয়া শুইয়াছিল। সংক্ষেপে কহিল, আসা উচিত ছিল না—এই-সব। পত্রের এই দুটি কথা শুনিয়াই মায়ের দুই চক্ষে জল আসিয়া পড়িল। তিনি মনে মনে আবৃত্তি করিলেন, আসা উচিত ছিল না—এই সব। অতুলের মুখখানি স্মরণ করিয়া, তাহাকে অসংখ্য আশীর্বাদ করিয়া দুর্গা মাতৃস্নেহে বিগলিত হইয়া মনে মনে বলিলেন, না জানি, বাছার কতই না অভিমান, কতই না মর্মান্তিক ব্যথা, এই দুটি কথার মধ্যে লুকান আছে। এখানে আসিয়া জ্ঞানদা জ্বরে পড়িয়াছে—তাহাতেই ত বাছা সেদিন রাগ করিয়া বলিয়াছিল—ইহাদের গঙ্গাযাত্রা দেখিতে কলিকাতা হইতে আসিয়াছি। সত্যই ত!—আমি নিজে যাই করি এবং যেখানেই যাই, সে আলাদা কথা। কিন্তু মেয়ে লইয়া আমার যে কোনমতেই আসা উচিত ছিল না। যতই কষ্ট হোক, সব সহ্য করিয়াই ত সেখানে আমাদের পড়িয়া থাকা উচিত ছিল। কাগজখানি অপূর্ব মমতার সহিত মুঠার মধ্যে নাড়াচাড়া করিতে করিতে কত কথাই আজ তাঁহার মনে পড়িতে লাগিল। স্বামীর মৃত্যুশয্যায় অতুলের প্রতিজ্ঞা—সেই চুড়ি দু’গাছি দিবার ছলে মহাপ্রসাদ লইয়া আসা, বিশেষ করিয়া আসিবার দিনটায় মাসির সহিত তাহার কলহ। এ-কথা তাহার মা শুনিয়াছেন, পাড়ার লোকে শুনিয়াছে—এতদিনে সবাই জানিয়াছে কেন সে কলিকাতা হইতে ছুটিয়া আসিয়াছিল। আনন্দে গর্বে তাঁহার মাতৃবক্ষ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মনে মনে বলিলেন, কালো মেয়ে! আমার কালো মেয়ের গৌরব দেখুক সবাই! ওরে কোকিলও কালো, ভোমরাও কালো যে! ডাকিলেন—জ্ঞানদা, এখন কেমন আছিস মা?

ভাল আছি মা।

হাঁ রে, আমার কথা অতুল কিছু লিখেচে?

পড়ে দেখ না।

কৌতূহল আর তিনি সামলাইতে পারিলেন না। জানালার কাছে কাগজখানি মেলিয়া ধরিলেন। অতবড় কাগজের মধ্যে মাত্র দুইছত্র লেখা দেখিয়া প্রথমটা তাহার মনে হইল, মেয়ে কি দিতে, হয়ত কি দিয়াছে। পরক্ষণেই ‘শ্রীচরণেষু’ পাঠ দেখিয়া মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, তাইতেই পড়তে দিয়েছে—এ যে আমারই চিঠি। লেখা আছে—“সেই সময়েই বলিয়াছিলাম, ও জায়গা ম্যালেরিয়ার ডিপো। জ্ঞানদার জ্বর শুনিয়া দুঃখিত হইলাম—আশা করি, শীঘ্র আরোগ্য হইয়া যাইবে। আমরা ভাল আছি। আমার প্রণাম গ্রহণ করিবেন।” ইতি—

0 Shares