অরক্ষণীয়া

দুর্গার কথাটা জিজ্ঞাসা করিতে একটু বাধিল, কিন্তু মায়ের প্রাণ—না জিজ্ঞাসা করিয়াও থাকিতে পারিলেন না; কাছে বসিয়া মেয়ের রুক্ষ চুলগুলি আঙুল দিয়া নাড়িতে নাড়িতে আস্তে আস্তে বলিলেন, হাঁ মা, তোমার চিঠিটার মধ্যে বুঝি অতুল রাগ করেচে? জ্ঞানদা বিস্মিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া কহিল, আমার চিঠি আবার কোথায় মা? তোমাকেই তো লিখেছেন। দুর্গা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আমি দেখতে চাই না, শুনলেই সুখী। রাগ করেচে, সে ত আমি বুঝতেই পারচি—

না মা, আমাকে তিনি আলাদা চিঠিপত্র কিছুই লেখেন নি। যা লিখেছেন, তা ওই। বলিয়া মেয়ে পুনরায় পাশ ফিরিয়া শুইল।

সবে দু’ছত্র? আর কোন কথা নেই? বলিয়া দুর্গা স্তব্ধ হইয়া গেলেন। তাঁহার যে আঙুলগুলা এতক্ষণ মেয়ের চুলের মধ্যে নানাপ্রকার বিচিত্র গতিতে বিচরণ করিয়া ফিরিতেছিল, সেগুলাও যেন হাড়ের মত শক্ত হইয়া উঠিল; এইভাবে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন।

আবার দিন কাটিতে লাগিল।

পাঁচ

প্রথম অগ্রহায়ণের শীতের বাতাস বহিতেছিল। দুর্গার এক ছেলেবেলার সাথী বাপের বাড়ি আসিয়াছিল। আজ দুপুরবেলা মেয়েকে একটু ভাল দেখিয়া দুর্গা তাহার সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়াছিলেন। পথে ডাক-পিয়নের সাক্ষাৎ পাইয়া ডাকিয়া বলিলেন, হাঁ দাশু, আমার নামের চিঠিপত্র পাচ্ছিনে কেন?

দাশু হাসিয়া কহিল, চিঠি না এলে কি করে পাবে, দিদিঠাকরুন?

দুর্গা সন্দিগ্ধস্বরে বলিলেন, আমার কিংবা আমার মেয়ে জ্ঞানদা দেবী—কারু নামেই কি চিঠি আসে না?

দাশু কহিল, এলে ত আমিই দিয়ে যেতাম দিদিঠাকরুন?

দুর্গা বলিলেন, না দাশু তোমার ব্যাগটা একটু ভাল করে দেখো—আসতেও পারে। তিন-তিনখানা চিঠির জবাব দেবে না,—আমার অতুল ত তেমন ছেলে নয়।

দাশু বৃথা পরিশ্রম না করিয়া কহিল, না দিদি, নেই—এলেই পাবে। বলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে দুর্গা বাধা দিয়া বলিলেন, হাঁ দাশু, এমনও ত হতে পারে—তোমার পোস্টাফিসেই পড়ে আছে—পোস্টমাস্টার আমাদের নাম জানে না। হয়ত বা টেবিলের তলায় ঘোঁজে- ঘাঁজে কোথাও পড়ে গেছে, তোমরা কেউ দেখতে পাওনি। আমাকে ত এখানে সবাই জানে, আমি নিজে গিয়ে কি একবার খুঁজতে পারিনে?

ব্যাকুলতা দেখিয়া দাশু সদয়চিত্তে কহিল, কেন পারবে না দিদিঠাকরুন—কিন্তু সে মিছে খোঁজা হবে। আচ্ছা, আমি গিয়ে আজ একবার খুঁজে দেখব। যদি পাই দিয়ে যাবো। বলিয়া সে আর সময় নষ্ট না করিয়া চলিয়া গেল।

দুর্গা ঠাকুর-দেবতার চরণে বিশ্বের ঐশ্বর্য মানত করিতে করিতে চলিলেন—হে মা দুর্গা, হে মা কালী, একখানি চিঠিও যেন খুঁজে পাওয়া যায়। জ্ঞানদার এত বড় অসুখ শুনিয়াও সে উত্তর লিখিবে না—এ কি কোনমতেই বিশ্বাস করা যায়! সে নিশ্চয় লিখিয়াছে; কিন্তু কোথাও গোলমাল হইয়া গেছে।

হায় রে মানুষের আশা! শত কোটি সম্ভব-অসম্ভব জল্পনা-কল্পনার মধ্যে এ কথাটা একবারও দুর্গার মনে উদয় হইল না যে, ইতিমধ্যে অতুলের মনের গতি বদলাইয়া যাইতেও পারে। একবারও ভাবিলেন না—অতুলের যে কামনা একদিন একান্ত সঙ্গোপনে সম্পূর্ণ আবরণের অন্তরে, শুধু নির্বিবাদেই বাড়িয়া উঠিতে পাইয়াছিল, তাহাকে এমন অসময়ে এতবড় অনাবৃত প্রকাশ্যতার মাঝখানে টানিয়া আনিলে, সে চক্ষের পলকে শুকাইয়া যাইতে পারে! এখন শত বিরুদ্ধ-শক্তি সজাগ হইয়া তাহাকে মুহূর্তের মধ্যে চাপিয়া মারিতে পারে! মানুষ এমনিই অন্ধ!

দুর্গা একটু সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া মেয়ের ঘরে ঢুকিয়া প্রথমেই প্রশ্ন করিলেন, হাঁ রে জ্ঞানদা, দাশু কোন চিঠিপত্র দিয়ে গেছে কি?

মেয়ে কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, না মা।

আজ দুই মাস হইতে উপর্যুপরি তিনখানি পত্রের জবাব আসিতেছে না। দুর্গা সংশয়ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কহিলেন, তুই হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলি। তোর সাড়া না পেয়ে দাশু হয়ত ফিরে গেছে। আমি বাড়িতে নেই—একদিন একটুখানি কি জেগে থাকতে পারিস নে বাছা? বলিয়া দুর্গা মুখ ভার করিয়া চলিয়া গেলেন। জ্ঞানদা চুপ করিয়া রহিল। সে ঘুমায় নাই, জাগিয়াছিল বলিয়া তর্ক করিল না। মায়ের কাছে প্রত্যহ একই প্রশ্নের একই উত্তর দিতে দিতে সে নিজের লজ্জায় নিজেই মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতেছিল।

দুর্গা তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিয়া দ্বারের বাহির হইতে কহিলেন, কেন দাশু যে আমাকে বললে, সে খুঁজে এনে দিয়ে যাবে? আজ কেমন করিয়া যেন তাঁহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইয়াছিল, অতুলের চিঠিপত্র আসিয়াছেই।

মেয়ে কথা কহিল না—একটা মলিন কাঁথার মধ্যে মুখ লুকাইয়া পড়িয়া রহিল। কিন্তু দুর্গা এইখানেই থামিতে পারিলেন না। তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে পোস্টাফিসে পাঠাইয়া খবর লইয়া জানিলেন, দাশু আসে নাই।

পরের তিন-চারি দিন তিনি পত্রের প্রত্যাশায় অহোরাত্র যেন কণ্টকশয্যায় বসিয়া কাটাইলেন—তথাপি কিছু আসিল না। অবশেষে হতাশ হইয়া অতুলের জননীকে চিঠি লিখিলেন। তিনি প্রত্যুত্তরে সংক্ষেপে জানাইলেন, অতুল ভাল আছে এবং কলিকাতার বাসায় থাকিয়া পূর্ববৎ লেখাপড়া করিতেছে। তাঁহার চিঠির মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের সুরই যেন দুর্গার কানে বাজিল। এমনি করিয়া অঘ্রান গেল, পৌষ গেল, কিন্তু অতুলের চিঠি আসিল না। মাঘের মাঝামাঝি মেয়ে যদিবা একটু সারিয়া উঠিল, মা অসুখে পড়িলেন। এতবড় নিরাশার আঘাত তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। তা ছাড়া, বৌয়ের প্রতি তাঁহার বিদ্বেষের আর যেন অন্ত ছিল না। তাহার উল্লেখ করিতে হইলেই, ঘৃণাভরে কখনো বা ‘পোড়া কাঠ’ কখনো বা ‘তাড়কা’ বলিতেন এবং যত দিন যাইতে লাগিল, ঘৃণা যেন অপরিসীম হইয়া উঠিতে লাগিল। তাহার আরও একটা কারণ এই ছিল,—‘পোড়া কাঠ’ নিজের ধরনে জ্ঞানদাকে তাহার স্বাভাবিক মাধুর্যের জন্যই বোধ করি ভালবাসিয়াছিল, যত্নও করিত। কিন্তু এই যত্নের মধ্যে একটা উৎকট স্বার্থের গন্ধ পাইয়া দুর্গা বিষের জ্বালায় জ্বলিতে লাগিলেন। বড় দুঃখের দেহ, তাই অনেক সহিয়াছিল; কিন্তু আর সহিল না। মাঘের শেষে তিনি শয্যা আশ্রয় করিলেন। মেয়ে কাঁদিয়া বলিল, আর না মা, এইবার বাড়ি চল। যা হবার সেইখানেই হোক।

0 Shares