একাদশী বৈরাগী

কাহিনী শুনিয়া সকলে দুঃখ প্রকাশ করিল, শুধু একাদশী চুপ করিয়া রহিল। একটু পরেই প্রশ্ন করিল, টাকার হাতচিটা আছে? যাও, তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করে এস।

ছেলেটি জিজ্ঞাসা করিয়া আসিয়া কহিল, কাগজ-পত্র কিচ্ছু নেই, সব পুড়ে গেছে।

একাদশী প্রশ্ন করিল, কত টাকা?

এবার বিধবা অগ্রসর হইয়া আসিয়া মাথার কাপড়টা সরাইয়া জবাব দিল, ঠাকুর মরবার আগে বলে গেছেন, পাঁচ শ টাকা তিনি জমা রেখে তীর্থযাত্রা করেন। বাবা আমরা বড় গরীব; সব টাকা না দাও, কিছু আমাদের ভিক্ষে দাও, বলিয়া বিধবা টিপিয়া টিপিয়া কাঁদিতে লাগিল। ঘোষালমশাই এতক্ষণ খাতা লেখা ছাড়িয়া একাগ্রচিত্তে শুনিতেছিলেন, তিনিই অগ্রসর হইয়া প্রশ্ন করিলেন, বলি কেউ সাক্ষী-টাক্ষী আছে?

বিধবা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। আমরাও জানতুম না। ঠাকুর গোপনে টাকা জমা রেখে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

ঘোষাল মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, শুধু কাঁদলেই ত হয় না বাপু! এ-সব মবলগ টাকাকড়ির কাণ্ড যে! সাক্ষী নেই, হাতচিটা নেই, তা হলে কি রকম হবে বল দেখি?

বিধবা ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল; কিন্তু কান্নার ফল যে কি হইবে তাহা কাহারও বুঝিতে বাকি রহিল না। একাদশী এবার কথা কহিল; ঘোষালের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমার মনে হচ্চে, যেন পাঁচ শ টাকা কে জমা রেখে আর নেয়নি। তুমি একবার পুরানো খাতাগুলো খুঁজে দেখ দিকি, কিছু লেখা-টেখা আছে নাকি?

ঘোষাল ঝঙ্কার দিয়া কহিল, কে এতবেলায় ভূতের ব্যাগার খাটতে যাবে বাপু? সাক্ষী নেই, রসিদ-পত্তর নেই—

কথাটা শেষ হইবার পূর্বেই দ্বারের অন্তরাল হইতে জবাব আসিল, রসিদ-পত্তর নেই বলে কি ব্রাহ্মণের টাকাটা ডুবে যাবে নাকি? পুরানো খাতা দেখুন, আপনি না পারেন আমাকে দিন, দেখে দিচ্চি।

সকলেই বিস্মিত হইয়া দ্বারের প্রতি চোখ তুলিল; কিন্তু যে হুকুম দিল তাহাকে দেখা গেল না।

ঘোষাল নরম হইয়া কহিল, কত বছর হয়ে গেল মা! এতদিনের খাতা খুঁজে বার করা ত সোজা নয়। খাতা-পত্তরের আণ্ডিল! তা জমা থাকে, পাওয়া যাবে বৈ কি! বিধবাকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, তুমি বাছা কেঁদো না, হক্কের টাকা হয় ত পাবে বৈ কি। আচ্ছা, কাল একবার আমার বাড়ি যেয়ো; সব কথা জিজ্ঞাসা করে খাতা দেখে বার করে দেব। আজ এতবেলায় ত আর হবে না।

বিধবা তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া কহিল, আচ্ছা বাবা, কাল সকালেই আপনার ওখানে যাব।

যেয়ো, বলিয়া ঘোষাল ঘাড় নাড়িয়া সম্মুখে খোলা খাতা সেদিনের মত বন্ধ করিয়া ফেলিল।

কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের ছলে বিধবাকে বাড়িতে আহ্বান করার অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। অন্তরাল হইতে গৌরী কহিল, আট বছর আগের—তাহলে ১৩০১ সালের খাতাটা একবার খুলে দেখুন ত, টাকা জমা আছে কি না?

ঘোষাল কহিলেন, এত তাড়াতাড়ি কিসের মা!

গৌরী কহিল, আমাকে দিন, আমি দেখে দিচ্চি। ব্রাহ্মণের মেয়ে দু’কোশ হেঁটে এসেচেন—দু’কোশ এই রৌদ্রে হেঁটে যাবেন, আবার কাল আপনার কাছে আসবেন; এত হাঙ্গামায় কাজ কি ঘোষালকাকা?

একাদশী কহিল, সত্যিই ত ঘোষালমশাই; ব্রাহ্মণের মেয়েকে মিছামিছি হাঁটান কি ভাল? বাপ রে! দাও, দাও, চটপট দেখে দাও।

ক্রুদ্ধ ঘোষাল তখন রুষ্টকন্ঠে উঠিয়া গিয়া পাশের ঘর হইতে ১৩০১ সালের খাতা বাহির করিয়া আনিলেন। মিনিট-দশেক পাতা উলটাইয়া হঠাৎ ভয়ানক খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, বাঃ! আমার গৌরীমায়ের কি সূক্ষ্ম বুদ্ধি! ঠিক এক সালের খাতাতেই জমা পাওয়া গেল! এই যে রামলোচন চাটুয্যের জমা পাঁচ শ’—

একাদশী কহিল, দাও, চটপট সুদটা কষে দাও ঘোষালমশাই।

ঘোষাল বিস্মিত হইয়া কহিল, আবার সুদ?

একাদশী কহিল, বেশ, দিতে হবে না! টাকাটা এতদিন খেটেচে ত, বসে ত থাকেনি। আট বছরের সুদ, এই ক’মাস সুদ বাদ পড়বে।

তখন সুদে-আসলে প্রায় সাড়ে-সাত শ টাকা হইল। একাদশী ভগিনীকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, দিদি টাকাটা তবে সিন্দুক থেকে বার করে আন। হাঁ বাছা, সব টাকাটাই একসঙ্গে নিয়ে যাবে ত?

বিধবার অন্তরের কথা অন্তর্যামী শুনিলেন; চোখ মুছিয়া প্রকাশ্যে কহিল, না বাবা, অত টাকায় আমার কাজ নেই; আমাকে পঞ্চাশটি টাকা এখন শুধু দাও।

তাই নিয়ে যাও মা। ঘোষালমশাই, খাতাটা একবার দাও, সই করে নেই; আর বাকি টাকার তুমি একটা চিঠি করে দাও।

ঘোষাল কহিল, আমি সই করে নিচ্চি। তুমি আবার—

একাদশী কহিল, না না, আমাকেই দাও না ঠাকুর, নিজের চোখে দেখে দিই। বলিয়া খাতা লইয়া অর্ধমিনিট চোখ বুলাইয়া হাসিয়া কহিল, ঘোষালমশাই, এই যে একজোড়া আসল মুক্তা ব্রাহ্মণের নামে জমা রয়েছে। আমি জানি কিনা, ঠাকুরমশাই আমাদের সব সময়ে চোখে দেখতে পায় না, বলিয়া একাদশী দরজার দিকে চাহিয়া একটু হাসিল। এতগুলি লোকের সুমুখে মনিবের সেই ব্যঙ্গোক্তিতে ঘোষালের মুখ কালি হইয়া গেল।

সেদিনের সমস্ত কর্ম নির্বাহ হইলে অপূর্ব সঙ্গীদের লইয়া যখন উত্তপ্ত পথের মধ্যে বাহির হইয়া পড়িল, তখন তাহার মনের মধ্যে একটা বিপ্লব চলিতেছিল। ঘোষাল সঙ্গে ছিল, সে সবিনয়ে আহ্বান করিয়া কহিল, আসুন, গরীবের ঘরে অন্ততঃ একটু গুড় দিয়েও জল খেতে যেতে হবে।

অপূর্ব কোন কথা না কহিয়া নীরবে অনুসরণ করিল। ঘোষালের গা জ্বলিয়া যাইতেছিল। সে একাদশীকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, দেখলেন, ছোটলোক ব্যাটার আস্পর্ধা? আপনাদের মত ব্রাহ্মণ-সন্তানের পায়ের ধূলো পড়েছে, হারামজাদার ষোল পুরুষের ভাগ্যি! ব্যাটা পিচেশ কিনা পাঁচ গণ্ডা পয়সা দিয়ে ভিখারী বিদেয় করতে চায়।

বিপিন কহিল, দু’দিন সবুর করুন না; হারামজাদা মহাপাপীর ধোপা-নাপতে বন্ধ করে পাঁচ গণ্ডা পয়সা দেওয়া বার করে দিচ্চি। রাখালবাবু আমাদের কুটুম, সে মনে রাখবেন ঘোষালমশাই।

ঘোষাল কহিল, আমি ব্রাহ্মণ। দু’বেলা সন্ধ্যা-আহ্নিক না করে জলগ্রহণ করিনে, দুটো মুক্তোর জন্যে কি-রকম অপমানটা দুপুরবেলায় আমাকে করলে চোখে দেখলেন ত। ব্যাটার ভাল হবে? মনেও করবেন না। সে-বেটী—যারে ছুঁলে নাইতে হয়, কিনা বামুনের ছেলের তেষ্টার জল নিয়ে আসে, টাকার গুমরটা কি রকম হয়েচে, একবার ভেবে দেখুন দেখি!

অপূর্ব এতক্ষণ একটা কথাতেও কথা যোগ করে নাই; সে হঠাৎ পথের মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িয়া কহিল, অনাথ আমি ফিরে চললুম ভাই, আমার ভারী তেষ্টা পেয়েচে।

ঘোষাল আশ্চর্য হইয়া কহিল, ফিরে কোথায় যাবেন? ঐ ত আমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে।

অপূর্ব মাথা নাড়িয়া বলিল, আপনি এদের নিয়ে যান, আমি যাচ্চি ঐ একাদশীর বাড়িতেই জল খেতে।

একাদশীর বাড়িতে জল খেতে! সকলেই চোখ কপালে তুলিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। বিপিন তাহার হাত ধরিয়া একটা টান দিয়া বলিল, চল, চল—দুপুর রোদ্দুরে রাস্তার মাঝখানে আর ঢঙ্ করতে হবে না। তুমি সেই পাত্রই বটে! তুমি খাবে একাদশীর বোনের ছোঁয়া জল!

অপূর্ব হাত টানিয়া লইয়া দৃঢ়স্বরে কহিল, সত্যিই আমি তার দেওয়া সেই জলটুকু খাবার জন্য ফিরে যাচ্ছি। তোমরা ঘোষালমশায়ের ওখানে থেকে খেয়ে এস, ঐ গাছতলায় আমি অপেক্ষা করে থাকব।

তাহার শান্ত স্থির কণ্ঠস্বরে হতবুদ্ধি হইয়া ঘোষাল কহিল, এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তা জানেন?

অনাথ কহিল, ক্ষেপে গেলে নাকি?

অপূর্ব কহিল, তা জানিনে? কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় সে তখন ধীরে-সুস্থে করা যাবে। কিন্তু এখন ত পারলাম না, বলিয়া সে এই খর-রৌদ্রের মধ্যে দ্রুতপদে একাদশীর বাড়ির উদ্দেশে প্রস্থান করিল।

(সমাপ্ত)

0 Shares