গৃহদাহ

এমন করিয়া যে কতক্ষণ কাটিত বলা যায় না, কিন্তু বাহকদের আহ্বানে রঘুবীর বাহিরে চলিয়া গেলে, সেই শব্দে সুরেশ ধীরে ধীরে চোখ মেলিয়া চাহিল। কহিল, তুমি আমার চিঠি পেয়েছ? অচলা মুখ তুলিয়াই আস্তে আস্তে বলিল, না।

সুরেশ একটু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, চিঠি না পেয়েই এসেছ, আশ্চর্য! যাই হোক, এ ভালই হল যে একবার দেখা হল। বলিয়া একটা কথার জন্য তাহার আনত মুখের প্রতি একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া নিজেই কহিল, আমার জন্য তোমাকে অনেক দুঃখ পেতে হল—খুব সম্ভব যতদিন বাঁচবে, এর জের মিটবে না, কিন্তু সমস্ত ভুল হয়েছিল এই যে, মহিমকে তুমি যে এতটা বেশি ভালবাসতে তা আমিও বুঝিনি, বোধ হয় তুমিও কোনদিন বুঝতে পারোনি! না?

কিন্তু অচলা তেমনি অধোমুখে নিরুত্তরে বসিয়া রহিল দেখিয়া সে আবার বলিল, তা ছাড়া আমার বিশ্বাস, মানুষের মন বলে স্বতন্ত্র কোন একটা বস্তু নেই। যা আছে, সে এই দেহটার ধর্ম। ভালবাসাও তাই। ভেবেছিলাম, তোমার দেহটাকে কোনমতে পেলে মনটাও পাবো, তোমার ভালবাসাও দুষ্প্রাপ্য হবে না—কে জানে হয়ত সত্যিই কোনদিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো—হয়ত যা সর্বস্ব দিয়ে এমন করে চেয়েছিলাম, তাই তুমি একদিন নিজের ইচ্ছেয় আমাকে ভিক্ষে দিতে। কিন্তু আর তার সময় নেই; আমি অপেক্ষা করবার অবসর পেলাম না। বলিয়া সে পুনরায় কনুইয়ে ভর দিয়া মাথা তুলিল এবং সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোকের মধ্যে নিজের দুই চক্ষের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করিয়া অচলার আনত মুখের প্রতি নিবদ্ধ করিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।

একজনের এই একাগ্র দৃষ্টি আর একজনের সন্নত দৃষ্টিকে যেন আকর্ষণ করিয়া তুলিল—কিন্তু পলকমাত্র। অচলা তৎক্ষণাৎ চোখ নামাইয়া লইয়া অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে অত্যন্ত লজ্জার সহিত কহিল, এদেশ থেকে ত সবাই পালিয়েছে—এখানকার কাজ যদি তোমার শেষ হয়ে থাকে ত বাড়ি, কিংবা আরও কত দেশ আছে—তুমি চল, ডিহরীতে আর একদণ্ড টিকতে পাচ্চিনে।

সে আমার বেশি আর কে জানে? বলিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া সুরেশ বালিশে মাথা দিয়া শুইয়া পড়িল এবং কিছুক্ষণ নিঃশব্দে স্থিরভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, অনেক কষ্টে আজ সকালে দু’খানা চিঠি পাঠাতে পেরেছি। একখানা তোমাকে, আর একখানা মহিমকে। সে যদি না এর মধ্যে চলে গিয়ে থাকে ত নিশ্চয় আসবে, আমি জানি।

শুনিয়া অচলা ভয়ে, বিস্ময়ে চমকিয়া উঠল, কহিল, তাঁকে কেন?

সুরেশ তেমনি ধীরে ধীরে বলিল, এখন তাকেই আমার একমাত্র প্রয়োজন। ছেলেবেলা থেকে সংসারের মধ্যে অনেকদিন অনেক গ্রন্থিই পাকিয়েছি, আর তাদের খোলবার জন্যে এই মানুষটিকে চিরদিন আবশ্যক হয়েছে! তাই আজও তাকেই আমার ডাক দিতে হয়েছে। এত ধৈর্য পৃথিবীতে আর ত কারও নেই!

অচলার বুকের মধ্যে তোলপাড় করিতে লাগিল, কিন্তু সে অধোমুখে স্থির হইয়া শুনিতে লাগিল। সুরেশ বলিল, আমার চিঠির মধ্যে প্রায় সব কথাই লেখা আছে—পড়লেই টের পাবে। সেদিন তোমার হাতে আমার সমস্ত সম্পত্তির পাকা উইলখানাই দিয়েছি। ইচ্ছে করলে তার অনেক জিনিসই তুমি নিতে পারো, কিন্তু আমি বলি, নিয়ে কাজ নেই। বরঞ্চ আমি বেঁচে থাকলেও যেমন গরীব-দুঃখীরাই সমস্ত পেতো, আমার মরণের পরেও যেন তারাই পায়। আমার কিছুর সঙ্গেই আর তুমি নিজেকে জড়িয়ে রেখ না অচলা—তুমি নিশ্চিন্ত হও, নির্বিঘ্ন হও—আমার সমস্ত সংস্রব থেকে তুমি নিজেকে যেন সর্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারো। চেষ্টা করলে পৃথিবীতে অনেক দুঃখই সহা যায়—আমার দেওয়া দুঃখেও যেন একদিন তুমি অনায়াসে সইতে পারো।

তাহার আচরণে ও কথা বলার ভঙ্গিতে অচলার মনের মধ্যে আসিয়া পর্যন্তই কেমন যেন ভয় ভয় করিতেছিল, এই শেষের কথাটায় সে যথার্থই ভীত হইয়া বলিয়া উঠিল, তুমি এ-সব কথা তুলচ কেন? উঠে বস না! যাতে আমরা এখনি বার হয়ে পড়তে পারি, তার উদ্যোগ করে দাও না!

তাহার আশঙ্কা ও উত্তেজনা লক্ষ্য করিয়াও সুরেশ কোন উত্তর দিল না। যে বৃদ্ধা খুঁটি ঠেস দিয়া ঝিমাইতেছিল, সে সজাগ হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু এখন ঘরের মধ্যে যাবেন, না আলোটা বাইরে এনে দেবে—তাহারও কোন জবাব দিল না; মনে হইতে লাগিল, সহসা যেন সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। উদ্বিগ্ন অচলা তাহার পূর্ব প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিতে যাইতেছিল, সুরেশ চোখ মেলিয়া অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, এখনও তোমাকে আমার আসল কথাটাই বলা হয়নি অচলা, আমি মরতে বসেছি—আমার বাঁচবার বোধ করি আর কোন সম্ভাবনাই নেই।

প্রত্যুত্তরে শুধু একটা অস্ফুট, অব্যক্ত কণ্ঠস্বর অচলার গলা হইতে বাহির হইয়া আসিল, তার পরেই সে মূর্তির মত নিস্পন্দ হইয়া বসিয়া রহিল।

সুরেশ বলিতে লাগিল, আগে থেকেই আমি উইল করে রেখেছি বটে, কিন্তু কেউ যদি মনে করে, আমি ইচ্ছে করে মরচি, সে অন্যায়, সে মিথ্যা—সে আমার মরার বেশি ব্যথা হবে। আমি সতর্কতার এতটুকু ত্রুটি করিনি, কিন্তু কাজে লাগল না। যদি কখনো তোমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে, তাদের তুমি এই কথাটা বলো যে, সংসারে আরও পাঁচজনের যেমন মৃত্যু হয়, তাঁরও মৃত্যু তেমনি হয়েছে,—মরণকে কেবল এড়াতে পারেন নি বলেই মরেছেন, নইলে মরবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। মরণের মধ্যে আমার কোন হাত, কোন বিশেষত্ব ছিল, এই অপরাধটা আমাকে যেন কেউ না দেয়।

অচলা কিছুই বলিল না। কথা কহিবার শক্তি যে তাহার শুকাইয়া গিয়াছিল, এ কথা সেই প্রায়ান্ধকারের মধ্যে তাহার ভয়ার্ত মুখের প্রতি চাহিয়া সুরেশ ধরিতে পারিল না। ক্ষণকাল আপনাকে সে সংবরণ করিয়া লইয়া পুনরায় বলিতে লাগিল, আমি না এসে থাকতে পারিনে বলেই তোমাকে লুকিয়ে সেদিন ভোরবেলায় পালিয়ে এসেছিলুম। এসে দেখি, গ্রাম প্রায় শূন্য। এ বাড়িতে একটা চাকর মরেছে এবং তার কোন গতি না করেই বাড়িসুদ্ধ সবাই পালাতে উদ্যত হয়েছে। তাদের নিরস্ত করতে পারলুম না বটে; কিন্তু মড়াটার একটা উপায় হল। ফিরে এসে ভাবলুম, আমিও বাড়ি চলে যাই; কিন্তু দুপুরবেলা মামুদপুর থেকে একটা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে এসে জানালে, তার মায়ের খুব অসুখ। তাকে অস্ত্র করতে গিয়েই নিজের এই বিপদ ঘটালুম। এমন অনেক ত করেছি, আমি সাবধানও কম নই, কিন্তু এবার দুর্ভাগ্য এমনি যে, এক্কার চাকায় বুড়ো আঙুলের পিছনটা যে ঘষে গিয়েছিল, সেটা কেবল চোখে পড়ল হাতের রক্ত ধুতে গিয়ে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে যা করবার সমস্তই করলুম, বাড়ি যাবার উপায় থাকলে আমি চলেই যেতুম, কিছুতেই থাকতুম না, কিন্তু কোন উপায় করতে পারলুম না। কাল রাত্রে জ্বরবোধ হ’ল—এ যে কিসের জ্বর সে যখন বুঝতে আর বাকি রইল না, তখন অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায় একটা লোক দিয়ে তোমাদের দু’জনকে দু’খানা চিঠি লিখে পাঠিয়েছি।

35 Shares