গৃহদাহ

কিছুক্ষণের জন্য সুরেশ বোধ হয় তন্দ্রামগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল—তাহার সাড়া ছিল না। কিন্তু এমন করিয়া যে কতক্ষণ গেল, কি করিয়া বাহিরে যে সময় কাটিতে লাগিল, কি করিয়া যে রাত্রি প্রভাতের পথে অগ্রসর হইতেছিল, সেদিকেও অচলার চৈতন্য ছিল না। তাহার নিমীলিত চক্ষের কোণ বাহিয়া জল পড়িতেছিল, স্রস্ত হাতদুটি সুরেশের বালিশের উপর পড়িয়া, সে একান্ত-মনে বলিতেছিল, হে ঈশ্বর! আমি অনেক দুঃখ, অনেক ব্যথা পাইয়াছি, আজ আমার সকল দুঃখ, সকল ব্যথার পরিবর্তে একে তুমি ক্ষমা করিয়া কোলে তুলিয়া লও; আমার মা নাই, বাপ নাই, স্বামী নাই—এত বড় লজ্জা লইয়া কোথাও আমার দাঁড়াইবার স্থান নাই। আমি কত যে সহিয়াছি, সে ত তুমি জান—আর আমাকে বাঁচিতে দিয়ো না প্রভো! আমাকেও তোমার কাছে টানিয়া লও!

কথাগুলি সে যে কতভাবে কতরকমে মনে মনে আবৃত্তি করিল, তাহার অবধি নাই—অশ্রুজলও যে কত ঝরিয়া পড়িল তাহারও সীমা নাই।

মাইজী।

তখন সবেমাত্র প্রভাত হইয়াছে, অচলা চমকিয়া দেখিল, রঘুবীর কাহার যেন প্রবেশের অপেক্ষায় সদর-দরজা উন্মুক্ত করিয়া দাঁড়াইয়াছে।

কি রঘুবীর? বলিয়াই যাহার সহিত তাহার চোখে চোখে দেখা হইয়া গেল, সে মহিম। একবার সে কাঁপিয়া উঠিয়াই দৃষ্টি অবনত করিল।

দ্বারের কাছে মুহূর্তের জন্য মহিমের পা উঠিল না, এখানে এমন করিয়া যে আবার তাহার সহিত দেখা হইবে, ইহা সে প্রত্যাশা করে নাই। কিন্তু পরক্ষণেই ধীরে ধীরে সে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এখন সুরেশ কেমন আছে?

অচলা মুখ তুলিল না, কথা কহিল না, শুধু মাথা নাড়িয়া বোধ হয় ইহাই জানাইতে চাহিল, সে ইহার কিছুই জানে না।

মিনিট-খানেক স্থির থাকিয়া মহিম সুরেশের ললাট স্পর্শ করিতেই সে চোখ মেলিয়া চাহিল। সেই জ্যোতিহীন রক্তনেত্রের প্রতি চাহিয়া মহিমের গলা দিয়া সহসা স্বর ফুটিল না। তার পরে কহিল, কেমন আছ সুরেশ?

ভালো না—চললুম। তুমি আসবে আমি জানি—আমার সুমুখে এসে বস।

মহিম উঠিয়া গিয়া শয্যার একাংশে তাহার পায়ের কাছে বসিল। বলিল, ডিহরীতে ডাক্তার আছে, আমার এক্কায় কোনমতে—

সুরেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, না টানাটানি করো না, মজুরী পোষাবে না। আমাকে quietly যেতে দাও।

কিন্তু এখনো ত—

হ্যাঁ, এখনো হুঁশ আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল হচ্ছে। আমার জীবনটা গরীব-দুঃখীর কাজে লাগাতে পারলুম না, কিন্তু সম্পত্তিটা যেন তাদের কাজে লাগে মহিম। তাই কষ্ট দিয়ে এতদূর তোমাকে টানে এনেছি, নইলে মৃত্যুকালে ক্ষমা চেয়ে কাব্য করবার প্রবৃত্তি আমার নেই।

মহিম নীরব হইয়া রহিল।

সুরেশ বলিতে লাগিল, ও-সব আমি বিশ্বাসও করিনে, ভালও বাসিনে। একটা দিনের ক্ষমার প্রতি আমার লোভও নেই। ভাল কথা, একটা উইল আছে। অচলাকে আমি কিছুই দিইনি—আর তাকে অপমান করতে আমার হাত উঠল না। তবে দরকার বোঝ ত সামান্য কিছু দিয়ো।

মহিম ব্যাকুল হইয়া উঠিল, আর আমাকে কেন এর মধ্যে জড়াচ্ছো সুরেশ?

সুরেশ বলিল, ঠিক এই জন্যই যে, তোমাকে জড়ানো যায় না। যার লোভ নাই, যার ন্যায়ান্যায়ের বিচার—হঠাৎ উপরের দিকে দৃষ্টি তুলিয়া কহিল, কিন্তু সারারাত তুমি বসে আছ অচলা—যাও, হাতমুখ ধোও গে। মুনিয়ার মা সমস্ত দেখিয়ে দেবে—যাও—

সে উঠিয়া গেলে কহিল, কেবল একটা জিনিসের জন্য আমার ভারী দুঃখ হয়। অচলা যে তোমাকে কত ভালবাসত, সে আমিও বুঝিনি, তুমিও বোঝোনি—ও নিজেও বুঝতে পারেনি। সেটা তোমার দারিদ্র্যের সঙ্গে এমনি ঘুলিয়ে উঠল যে—যাক! এমন সুন্দর জিনিসটি মাটি করে ফেললুম—না পেলুম নিজে, না পেতে দিলুম অপরকে। কিন্তু কি আর করা যাবে! পিসীমাকে একটু দেখো—শোকটা তাঁর ভারী লাগবে।

বৃদ্ধ মুনিয়ার মা ঔষধের শিশি লইয়া কাছে দাঁড়াইতেই সে উত্ত্যক্তস্বরে বলিয়া উঠিল, না না, আর ঔষধ নয়। একটু জল দে। একটা নাটক লিখতে আরম্ভ করেছিলুম মহিম, আমার ড্রয়ারে আছে—পারো ত পড়ো।

মহিম তাহার মুখের পানে চাহিতে পারিতেছিল না, অধোমুখে শুনিতেছিল—এইবার চোখ তুলিয়া কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই সুরেশ থামাইয়া দিয়া বলিল, আর না মহিম, একটু ঘুমুই। খাবার-দাবার সমস্ত যোগাড় আছে, কিন্তু সে ত তোমাদের ভাল লাগবে না। বলিয়া সে চোখ বুজিল।

মহিম ক্ষণকাল চুপ করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমার শেষ অনুরোধ একটা রাখবে সুরেশ ?

কি?

তুমি ভগবানকে কোনদিন ভাবোনি, তাঁর কথা—ও আমার ভাল লাগে না। বলিয়া সুরেশ মুখখানা বিকৃত করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল। মহিম প্রাণপণে একটা অদম্য দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া লইয়া নির্বাক হইয়া রহিল।

ত্রিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

রামবাবু বাড়ি ছিলেন না। পরদিন বক্সার হইতে ফিরিয়া মহিমের চিঠি পড়িয়া বাহির হইতে মুহূর্ত বিলম্ব করিলেন না—সমস্ত পথ ঘোড়াটাকে নির্মম ছুটাইয়া আধমরা করিয়া তুলিয়া যখন মাঝুলিতে পৌঁছিলেন তখন বেলা অবসান হইতেছে। পুলিশের দারোগা ভাবিয়া দোকানী স্বয়ং পথ দেখাইয়া নন্দ পাঁড়ের নিমতলায় আনিয়া উপস্থিত করিল এবং এক্কা হইতে অবতরণকালে সসম্মানে ঘোড়ার লাগাম ধরিল। ইহারই কাছে খবর পাইয়া জানিলেন, অচলাও আসিয়াছে। সদর-দরজা খোলা ছিল, ভিতরে পা দিয়াই ব্যাপারটা বুঝিতে বাকি রহিল না। ঘণ্টা-দুই হইল সুরেশের মৃত্যু হইয়াছে। খাটিয়ার উপর তাহার মৃতদেহ আপাদমস্তক চাপা দেওয়া এবং অনতিদূরে পায়ের কাছে অচলা চুপ করিয়া বসিয়া।

অকস্মাৎ এই দৃশ্য বৃদ্ধ সহিতে পারিলেন না—মা গো! বলিয়া উচ্ছ্বসিত শোকে কাঁদিয়া উঠিলেন।

অচলা মুখ তুলিয়া একবার চাহিল মাত্র, তার পরে তেমনি অধোমুখে নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। এই আর্তকণ্ঠ যেন শুধু তাহার কানে গেল, কিন্তু ভিতরে পৌঁছিল না।

মহিম বাটীর মধ্যে কাঠের সন্ধান করিতেছিল, ক্রন্দনের শব্দে বাহির হইয়া আসিল। কহিল, সুরেশ এই কতক্ষণ মারা গেল রামবাবু! আপনি এসেছেন, ভালই হয়েছে, নইলে একলা বড় অসুবিধে হতো।

35 Shares