গৃহদাহ

রামবাবু নীরবে চোখ মুছিতে লাগিলেন। তিনি কি করিবেন, কি বলিবেন, কি করিয়া ওই মেয়েটার চোখের উপর ঐ ভীষণ নিদারুণ কার্যে সাহায্য করিতে অগ্রসর হইবেন, তাহার কূলকিনারা ভাবিয়া পাইলেন না।

মহিম কহিল, নদী দূরে নয়, রঘুবীর কিছু কিছু কাঠ বয়ে নিয়ে গেছে, আরও কিছু কাঠ পাওয়া গেছে—সেইটে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা তিনজনেই ওকে নিয়ে যেতে পারবো। নইলে গ্রামে আর লোক নেই, থাকলেও বোধ হয় কেউ বাঙালীর মড়া ছোঁবে না।

রামবাবু তাহা জানিতেন। অচলার অগোচরে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলেন, আমরা দু’জন আর কে?

মহিম বলিল, রঘুবীরও হয়ত সাহায্য করতে পারে।

শুনিয়া বৃদ্ধ ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন, না না, সে কিছুতেই হলে চলবে না। ব্রাহ্মণের শব আর কাকেও আমি ছুঁতে দিতে পারব না। নদী যখন দূরে নয়, তখন আমাদের দু’জনকেই যেমন করে হোক নিয়ে যেতে হবে।

বেশ তাই, বলিয়া মহিম পুনরায় ভিতরে গিয়া কাষ্ঠ-সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইল। রামবাবু সেই বারান্দায় একপ্রান্তে মুখ ফিরাইয়া খুঁটি ঠেস দিয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন।

তাঁহার বয়স হইয়াছে; এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে অনেক মৃত্যু দেখিয়াছেন, অনেক গভীর শোকের মধ্যে দিয়াও তাঁহাকে ধীরে ধীরে পথ চলিতে হইয়াছে। সুদুঃসহ দুঃখের সে করুণ সুর একে একে তাঁহার হৃদয়-বীণায় বাঁধা হইয় গিয়াছে, আজিকার এই ব্যাপারটা সেই তারে ঘা দিয়া যেন কেবলি বেসুরে বাজিতে লাগিল। একদিন এই সুরমাই জ্যাঠামশাই বলিয়া তাঁহার বুকের উপর আছাড় খাইয়া পড়িয়াছিল—সে ছবি তিনি ভুলেন নাই। আজও তাঁহার পিতৃস্নেহ যেন সেই বস্তুটার লোভেই ভিতরে ভিতরে গুমরিয়া মরিতে লাগিল। তাহাকে কি সান্ত্বনা দিবেন তিনি জানেন না, তাহাকে প্রবোধ দিবার মত সংসারে কোথায় কি আছে তাহাও তিনি অবগত নন; তবুও তাঁহার শোকাতুর মন যেন কেবলি চাহিতে লাগিল, একবার মেয়েটাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলেন, ভয় কি মা! আজও যে আমি বাঁচিয়া আছি।

কিন্তু সে সুর বাজিল কৈ? তাঁহার সে তৃষ্ণা মিটাইতে কেহ ত একপদ অগ্রসর হইয়া আসিল না! সুরমা যে তেমনি নীরবে, তেমনি দূরতম অনাত্মীয়ের ব্যবধান দিয়া আপনাকে পৃথক্‌ করিয়া রাখিয়া দিল!

দুঃখের দিনে, বিপদের দিনে, ইহাদের অনেক দুর্জ্ঞেয় বেদনা, নির্বাক্‌ মর্মপীড়ার পাশ দিয়া তাঁহাকে চলিতে হইয়াছে, প্রছন্ন রহস্যের ইঙ্গিত মাঝে মাঝে তাঁহাকে খোঁচা দিয়া গিয়াছে, কিন্তু কোনদিন আপনাকে আহত হইতে দেন নাই—সমস্ত সংশয় স্নেহের আবরণে চাপা দিয়া, বাহিরের আকাশ নির্মল মেঘমুক্ত রাখিয়াছেন; কিন্তু আজ সদ্যবিধবার ওই একান্ত অপরিচিত নিষ্ঠুর ধৈর্য তাঁহার এতদিনের আড়াল-করা স্নেহের গা চিরিয়া কলুষের বাষ্পে হৃদয় যেন ভরিয়া দিতে লাগিল।

সূর্য অস্ত গেল। মহিম ওদিকের কাজ একপ্রকার শেষ করিয়া কাছে আসিয়া কহিল, রামবাবু, এইবার ত ওকে নিয়ে যেতে হয়। অচলার দিকে ফিরিয়া বলিল, আলোটা জ্বেলে দিয়েছি, তুমি মুনিয়ার মার কাছে বসে থাকো, আমাদের ফিরতে বোধ হয় খুব বিলম্ব হবে না।

অচলা কোন কথাই বলিল ন। রামবাবু আত্মসংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি মাথা নাড়িলেন। অচলার আনত মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রুদ্ধ স্বর পরিষ্কার করিয়া ভগ্নকণ্ঠে কহিলেন, মা, একথা বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু স্ত্রীর শেষ কর্তব্য ত তোমাকে করতে হবে। তোমাকেই ত মুখাগ্নি—বলিতে বলিতে তিনি হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।

অচলার শুষ্ক মুখ, ততোধিক শুষ্ক চোখ-দুটি বৃদ্ধের প্রতি নিবদ্ধ করিয়া মুহূর্তকাল স্থির হইয়া রহিল, তার পরে শান্ত মৃদুকণ্ঠে কহিল, মুখাগ্নির আবশ্যক হয় ত আমি করতে পারি। হিন্দুধর্মে এর যদি কোন সত্যকার ফল থাকে, তা আর আমি ব্যর্থ করতে চাইনে। আমি তাঁর স্ত্রী নই।

রামবাবু বজ্রাহতের ন্যায় পলকহীন চক্ষে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে আস্তে আস্তে বলিলেন, তুমি সুরেশের স্ত্রী নও?

অচলা তেমনি অবিচলিতস্বরে বলিল, না, উনি আমার স্বামী নন।

চক্ষের নিমিষে রামবাবুর সমস্ত ঘটনা স্মরণ হইয়া গেল। তাঁহার বাটীতে আশ্রয় গ্রহণ করা হইতে আরম্ভ করিয়া সেদিনের সে মূর্ছা পর্যন্ত যাবতীয় ব্যাপার বিদ্যুদ্বেগে বার বার তাঁহার মনের মধ্যে আবর্তিত হইয়া সংশয়ের ছায়ামাত্রও কোথাও অবশিষ্ট রহিল না। এ কে, কার মেয়ে, কি জাত—হয়ত-বা বেশ্যা—ইহাকে মা বলিয়াছেন, ইহার ছোঁয়া খাইয়াছেন—ইহার হাতের অন্ন তাঁহার ঠাকুরকে পর্যন্ত নিবেদন করিয়া দিয়াছেন। কথাগুলা মনে করিয়া ঘৃণায় যেন সর্বাঙ্গ তাঁহার ক্লেদসিক্ত হইয়া গেল এবং যে স্নেহ এতদিন তাঁহাকে শ্রদ্ধায় মাধুর্যে করুণায় অভিষিক্ত রাখিয়াছিল, মরুভূমির জলকণার ন্যায় সে যে কোথায় অন্তর্হিত হইল তাহার আভাস পর্যন্ত রহিল না।

কিন্তু কেবল তিনিই নন, মহিমও স্তম্ভিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া ছিল, সে চকিত হইয়া কহিল, সে যখন হবার জো নেই রামবাবু, চলুন, আমরা নিয়ে যাই।

চলুন, বলিয়া বৃদ্ধ স্বপ্নচালিতের ন্যায় অগ্রসর হইলেন। তাঁহার নিজের দুর্ঘটনার কাছে আর সমস্ত দুর্ঘটনাই একেবারে ছায়ার মত ম্লান হইয়া গিয়াছে— তাঁহার দুই কান জুড়িয়া কেবল বাজিতেছে— জাতি গেল, ধর্ম গেল, এই মানব— জন্মটাই যেন ব্যর্থ বৃথা হইয়া গেল।

সুরেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেমন তেমন করিয়া সমাধা করিতে অধিক সময় লাগিল না। সমস্তক্ষণ রামবাবু একটা কথাও কহিলেন না এবং ফিরিয়া আসিয়া সোজা এক্কা প্রস্তুত করিতে হুকুম দিলেন।

মহিম জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি যাচ্চেন?

রামবাবু কহিলেন, হাঁ। আমাকে ভোরের ট্রেনে কাশী যেতে হবে, এখন না বেরোলে সময়ে পৌঁছুতে পারব না।

তাঁহার মনের ভাব মহিমের অবিদিত ছিল না এবং প্রায়শ্চিত্তের জন্যই যে তিনি কাশী ছুটিতেছেন, ইহাও সে বুঝিয়াছিল; তাই অতিশয় সঙ্কোচের সহিত কহিল, আমি বিদেশী লোক, এদিকের কিছুই জানিনে। দয়া করে যদি এঁর কোন যাবার ব্যবস্থা—, কথাটা শেষ হইতে পাইল না। অচলাকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাবে বৃদ্ধ অগ্নির ন্যায় জ্বলিয়া উঠিলেন— দয়া! আপনি কি ক্ষেপে গেলেন মহিমবাবু?

35 Shares