গৃহদাহ

কেদারবাবু ইহার সোজা জবাবটা না দিয়া কহিলেন, তা একরকম তাই বৈ কি। এ-সব বিষয়ে মুখোমুখি সওয়াল-জবাব করাটা সকলের পক্ষেই কষ্টকর। কিন্তু সে ত বড় হয়েছে, রীতিমত শিক্ষাও পেয়েছে; এ-সকল ব্যাপার দিন থাকতে পরিষ্কার করে না নিলে এর পাগলামিটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এ ত সে বোঝে। তাই ভাবচি, আজ রাত্রেই কাজটা সেরে ফেলব।

সুরেশ ম্লান হইয়া কহিল, এত তাড়াতাড়ি কেন? দু’দিন চিন্তা করাও ত উচিত।

কেদারবাবু বলিলেন, এর ভেতরে চিন্তা করব আর কোন্‌খানে? ওর হাতে মেয়ে দিতে পারব না, সে নিশ্চয়—তখন এই বিশ্রী ব্যাপারটা যত শীঘ্র শেষ হয়, ততই মঙ্গল।

সুরেশ জিজ্ঞাসা করিল, আমার উল্লেখ করাও কি প্রয়োজন?

কেদারবাবু হাসিয়া বলিলেন, বুড়ো হয়েচি, এইটুকু বিবেচনাও কি আমার নেই মনে কর? তোমার নাম কোনদিনও কেউ তুলবে না।

সুরেশের মুখ দিয়া একটা আরামের নিশ্বাস পড়িল, কিন্তু সে আর কোন কথা কহিল না, চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। এই নিশ্বাসটুকু কেদারবাবুর দৃষ্টি এড়াইল না। তিনি সুরেশের আরও দু-একটা আচরণ ইতিমধ্যে লক্ষ্য করিয়া মনে মনে একটা অনুমান খাড়া করিয়া লইয়াছিলেন। তাহার সত্যমিথ্যা যাচাই করিবার উদ্দেশ্যে অন্ধকারে একটা ঢিল ফেলিলেন; কহিলেন, মস্ত উপকার আমাদের যেমন তুমি করলে বাবা, কিন্তু এর চেয়েও বড় উপকার তোমার কাছে আমরা দু’জন প্রত্যাশা করচি। আমরা ব্রাহ্ম বটে, কিন্তু সে-রকম ব্রাহ্ম নয়। আর আমার মেয়ে ত তার মায়ের মত মনে মনে হিন্দুই রয়ে গেছে। সে আমাদের ব্রাহ্মগিরি-টিরি একেবারেই পছন্দ করে না।

সুরেশ বিস্ময়াপন্ন হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহার এই নীরব ঔৎসুক্য কেদারবাবু বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়া কহিতে লাগিলেন, তাই, মেয়েকে আমি কিছুতেই চিরকাল আইবুড়ো রাখতে পারি না। এ বিষয়ে আমি তোমাদের মতই সম্পূর্ণ হিন্দুমতাবলম্বী। একটি সম্বন্ধ যেমন তোমা হতে ভেঙ্গে গেল সুরেশ, তেমনই আর একটি তোমাকেই গড়ে তুলতে হবে বাবা।

সুরেশ কহিল, যে আজ্ঞে; আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব।

তাহার মুখের ভাব পড়িতে পড়িতে কেদারবাবু সন্দিগ্ধস্বরে কহিলেন, সমাজে এই নিয়ে যথেষ্ট গোলযোগ হবে দেখতে পাচ্চি। কিন্তু যত শীঘ্র পারা যায়, অচলার বিয়ে দিয়ে এই-সব আলোচনা থামিয়ে ফেলতে হবে। তবে একটা শক্ত কথা আছে, সুরেশ। বলিয়া একবার দরজার বাহিরে চাহিয়া, আরও একটু কাছে সরিয়া আসিয়া, গলা খাটো করিয়া বলিলেন, শক্ত হচ্চে এই যে, পাত্র রূপে-গুণে ভাল হলেই যে হিন্দুসমাজের মত তাকে ধরে এনে বিয়ে দিতে পারব, তা নয়। ও চিরকাল যে শিক্ষা-সংস্কারের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে, তাতে ওর অমতে কিছুই করা যাবে না। কিন্তু মত সে কোন মতেই দেবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না দু’জনের মধ্যে এমন একটা কিছু—বুঝলে না সুরেশ?

কথাবার্তার মধ্যেই সুরেশ কতকটা যেন বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল, এই প্রণয়-ইঙ্গিতটা যেন আর একবার নূতন করিয়া আঘাত করিয়া তাহাকে অচেতন করিয়া দিল। দুপুরবেলায় তাহার নিজের সেই উচ্ছৃঙ্খল প্রণয়-নিবেদনের বীভৎস উৎকট আচরণ স্মরণ হওয়ায় নিদারুণ লজ্জায় সমস্ত মুখখানা রাঙ্গা না হইয়া একেবারে কালিবর্ণ হইয়া গেল; এবং সকালের যে খবরের কাগজখানা এতক্ষণ পায়ের কাছে মেজেতে পড়িয়াছিল, সেইখানা তুলিয়া লইয়া তাহার বিজ্ঞাপনের পাতাটার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

কেদারবাবু ইহা দেখিতে পাইলেন, এবং এই আকস্মিক ভাবপরিবর্তনের সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ কল্পনা করিয়া মনে মনে অত্যন্ত পুলকিত হইলেন, এবং সুযোগ বুঝিয়া একটা বড়রকম চাল চালিয়া দিলেন; কহিলেন, আমি বরাবর এই বড় একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে আসচি সুরেশ, যে, কেন জানিনে, একটা লোককে আজন্ম কাছে পেয়েও একতিল বিশ্বাস হয় না, আর একটা মানুষকে হয়ত দু’ ঘণ্টা মাত্র কাছে পেয়েই মনে হয়, এর হাতে নিজের প্রাণটা পর্যন্ত সঁপে দিতে পারি। মনে হয়, যেন জন্মজন্মান্তরের আলাপ,—শুধু দু’ ঘণ্টার নয়। এই যেমন তুমি। কতক্ষণেরই বা পরিচয় বল দেখি?

ঠিক এমনি সময় অচলা ঘরে প্রবেশ করিল। সুরেশ মুহূর্তের জন্য চোখ তুলিয়াই আবার সংবাদপত্রের প্রতি মনঃসংযোগ করিল।

বাবা, তুমি এ বেলা চা, না কোকো খাবে?

আমি কোকোই খাব মা।

সুরেশবাবু, আপনি চা খাবেন ত?

সুরেশ কাগজের দিকে চোখ রাখিয়াই অস্ফুটস্বরে বলিল, আমাকে চা-ই দেবেন।

আপনার পেয়ালায় চিনি কম দিতে হবে না ত?

না, আর পাঁচজন যেমন খায় আমিও তেমনি খাই।

অচলা চলিয়া গেল। কেদারবাবু তাঁহার ছিন্ন প্রসঙ্গের সূত্র যোজনা করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, এই দেখ না সুরেশ, আমার এই মা-টির জন্যেই এই বুড়োবয়সে আমি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েচি, এ কথা তোমার কাছে ত গোপন রাখতে পারলুম না। নইলে, নিজের দুর্দশা-দুরবস্থার কাহিনী সহজে কি কেউ কখনো অপরের কানে তুলতে পারে! কখনও যা পারিনি, এত বন্ধুবান্ধব থাকতে সে কথা শুধু তোমার কাছেই বলতে কেন সঙ্কোচবোধ হচ্ছে না? এর কি কোন গূঢ় কারণ নেই মনে কর?

সুরেশ বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিয়া রহিল। কেদারবাবু বলিতে লাগিলেন, এ ভগবানের নির্দেশ—সাধ্য কি গোপন করি? আমাকে বলতেই হবে যে! বলিয়া চৌকির হাতলের উপর তিনি একটা চাপড় মারিলেন।

কিন্তু তাঁহার এই বিস্তৃত ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁহার দুর্দশা-দুরবস্থাটা যে মেয়ের জন্য কিরূপ দাঁড়াইয়াছে, তাহা সুরেশ আন্দাজ করিতে পারিল না। কেদারবাবু তখন সবিস্তারে বর্ণনা করিতে লাগিলেন, কি করিয়া তাঁহার অমন অর্ডার সাপ্লায়ের ব্যবসাটা নিছক প্রবঞ্চনা ও কৃতঘ্নতার আগুনে পুড়িয়া খাক হইয়া গেলেও তিনি অবিচলিত ধৈর্যের সহিত দাঁড়াইয়াছিলেন, এবং ঋণের পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়িয়া গেলেও একমাত্র কন্যার শিক্ষাসম্বন্ধে কিছুমাত্র ব্যয়সঙ্কোচ করেন নাই। তিনি বলিতে লাগিলেন, গুটি-পাঁচছয় ডিক্রীজারির ভয়ে তাঁহার আহার-বিহার বিষময় এবং খুচরা ঋণের তাগাদায় জীবন দুর্ভর হইয়া উঠিলেও তিনি মুখ ফুটিয়া কাহাকেও কিছু বলিতে পারেন না। অথচ এই কলিকাতা শহরেই এমন অনেক আছেন যাঁহারা টাকাটা অনায়াসেই ফেলিয়া দিতে পারেন।

35 Shares