গৃহদাহ

তাই ভাল, বলিয়া মহিম উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, শোনবার ভারী কৌতূহল ছিল, কিন্তু তবু এখন তাঁর অপেক্ষায় বসে থাকবার সময় নেই। আমি চললুম—

সুরেশ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল—কোন কথা কহিল না।

মহিম বাহিরে আসিতে দেখিতে পাইল, সুমুখের রেলিং ধরিয়া, এই দিকে চাহিয়াই অন্ধকারে অচলা দাঁড়াইয়া আছে। কিন্তু সে কাছে আসিবার বা কথা কহিবার কিছুমাত্র চেষ্টা করিল না দেখিয়া সে-ও নীরবে সিঁড়ি বাহিয়া ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া গেল।

দশম পরিচ্ছেদ

কয়েকটা অত্যন্ত জরুরী ঔষধ কিনিতে মহিম কলিকাতায় আসিয়াছিল, সুতরাং রাত্রের গাড়িতেই বাড়ি ফিরিয়া গেল। সুরেশ সন্ধান লইয়া জানিল, মহিম তাহার বাসায় আসে নাই, দিন-চারেক পরে বিকালবেলায় কেদারবাবুর বসিবার ঘরে বসিয়া এই আলোচনাই বোধ করি চলিতেছিল। কেদারবাবু বায়স্কোপে নূতন মাতিয়াছিলেন; কথা ছিল, চা-খাওয়ার পরেই তাঁহারা আজও বাহির হইয়া পড়িবেন। সুরেশের গাড়ি দাঁড়াইয়াছিল—এমনি সময়ে দুর্গ্রহের মত ধীরে ধীরে মহিম আসিয়া অকস্মাৎ দ্বারের কাছে দাঁড়াইল।

সকলেই মুখ তুলিয়া চাহিল এবং সকলের মুখের ভাবেই একটা পরিবর্তন দেখা দিল।

কেদারবাবু বিরস-মুখে, জোর করিয়া একটু হাসিয়া অভ্যর্থনা করিলেন, এস মহিম। সব খবর ভাল?

মহিম নমস্কার করিয়া ভিতরে আসিয়া বসিল। বাড়িতে এতদিন বিলম্ব হইবার কারণ জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে শুধু জানাইল যে, বিশেষ কাজ ছিল।

সুরেশ টেবিলের উপর হইতে সেদিনের খবরের কাগজটা হাতে লইয়া পড়িতে লাগিল এবং অচলা পাশের চৌকি হইতে তাহার সেলাইটা তুলিয়া লইয়া তাহাতে মনোনিবেশ করিল। সুতরাং কথাবার্তা একা কেদারবাবু সঙ্গেই চলিতে লাগিল।

হঠাৎ এক সময়ে অচলা বাহিরে উঠিয়া গিয়া মিনিট-খানেক পরেই ফিরিয়া আসিয়া বসিল এবং ক্ষণেক পরেই মাথার উপরে টানা-পাখাটা নড়িয়া দুলিয়া ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। হঠাৎ বাতাস পাইয়া কেদারবাবু খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, তবু ভাল। পাখাওয়ালা ব্যাটার এতক্ষণে দয়া হল।

সুরেশ তীক্ষ্ণ বক্রদৃষ্টিতে দেখিয়া লইল, মহিমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়াছে। কেন অচলা উঠিয়া গিয়াছিল, কেন পাখাওয়ালার অকারণে দয়া প্রকাশ পাইল, সমস্ত ইতিহাসটা তাহার মনের মধ্যে বিদ্যুদ্বেগে খেলিয়া গিয়া, যে বাতাসে কেদারবাবু খুশি হইলেন, সেই বাতাসেই তাহার সর্বাঙ্গ পুড়িয়া যাইতে লাগিল। সে হঠাৎ ঘাড় তুলিয়া তিক্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, পাঁচটা বেজে গেছে—আর দেরি করলে চলবে না কেদারবাবু।

কেদারবাবু আলাপ বন্ধ করিয়া চায়ের জন্য হাঁকাহাঁকি করিতেই বেয়ারা সমস্ত সরঞ্জাম আনিয়া হাজির করিয়া দিল। সেলাই রাখিয়া দিয়া অচলা পেয়ালা-দুই চা তৈরি করিয়া সুরেশ ও পিতার সম্মুখে আগাইয়া দিতেই, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি খাবে না মা?

অচলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না বাবা, বড় গরম।

হঠাৎ তাঁহার মহিমের প্রতি দৃষ্টি পড়ায় ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ও কি, মহিমকে দিলে না যে! তুমি কি চা খাবে না মহিম?

সে জবাব দিবার পূর্বেই অচলা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া স্বাভাবিক মৃদুকণ্ঠে কহিল, না, এত গরমে তোমার খেয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া এবেলা ত তোমার চা সহ্য হয় না।

মহিমের বুকের উপর হইতে কে যেন অসহ্য গুরুভার পাষাণের বোঝা মায়ামন্ত্রে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল। সে কথা কহিতে পারিল না, শুধু অব্যক্ত বিস্ময়ে নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল।

অচলা কহিল, একটুখানি সবুর কর, আমি লাইম-জুস দিয়ে শরবত তৈরি করে আনচি। বলিয়া সম্মতির অপেক্ষা না করিয়াই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

সুরেশ আর একদিকে মুখ ফিরাইয়া কলের পুতুলের মত ধীরে ধীরে চা খাইতে লাগিল বটে, কিন্তু তাহার প্রতি বিন্দু তখন তাহার মুখে বিস্বাদ ও তিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

চা-পান শেষ করিয়া কেদারবাবু তাড়াতাড়ি কাপড় পরিয়া তৈরি হইয়া আসিয়া দেখিলেন, অচলা নিজের জায়গায় বসিয়া একমনে সেলাই করিতেছে। ব্যস্ত এবং আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, এখনো বসে কাপড় সেলাই করচ, তৈরি হয়ে নাওনি যে?

অচলা মুখ তুলিয়া শান্তভাবে কহিল, আমি যাব না বাবা।

যাবে না! সে কি কথা?

না বাবা, আজ তোমরা যাও—আমার ভাল লাগচে না। বলিয়া একটুখানি হাসিল।

সুরেশ অভিমান ও গূঢ় ক্রোধ দমন করিয়া কহিল, চলুন কেদারবাবু, আজ আমরাই যাই। ওঁর হয়ত শরীর ভাল নেই, কাজ কি পীড়াপীড়ি করে?

কেদারবাবু তাহার প্রতি চাহিয়াই তাহার ভিতরের ক্রোধ টের পাইলেন। মেয়েকে কহিলেন, তোমার কি কোনোরকম অসুখ করেচে?

অচলা কহিল, না বাবা, অসুখ করবে কেন, আমি ভাল আছি।

সুরেশ মহিমের দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহার মুখের ভাব লক্ষ্য করিল না, বলিল, আমরা যাই চলুন কেদারবাবু! ওঁর বাড়িতে কোনোরকম আবশ্যক থাকতে পারে—জোর করে নিয়ে যাবার দরকার কি?

কেদারবাবু কঠোরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, বাড়িতে তোমার কাজ আছে?

অচলা মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

কেদারবাবু অকস্মাৎ চেঁচাইয়া উঠিলেন, বলচি চল। অবাধ্য একগুঁয়ে মেয়ে!

অচলার হাতের সেলাই স্খলিত হইয়া নীচে পড়িয়া গেল। সে স্তম্ভিত-মুখে দুই চক্ষু ডাগর করিয়া প্রথমে সুরেশের, পরে তাহার পিতার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া, অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়া দ্রুতবেগে উঠিয়া চলিয়া গেল।

সুরেশ মুখ কালি করিয়া কহিল, আপনার সব-তাতেই জবরদস্তি। কিন্তু আমি আর দেরি করতে পারিনে—অনুমতি করেন ত যাই।

কেদারবাবু নিজের অভদ্র আচরণে মনে মনে লজ্জিত হইতেছিলেন—সুরেশের কথায় রাগিয়া উঠিলেন। কিন্তু রাগটা পড়িল মহিমের উপর। সে নিরতিশয় ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হইয়া উঠি-উঠি করিতেছিল। কেদারবাবু বলিলেন, তোমার কি কোন আবশ্যক আছে মহিম?

মহিম আত্মসংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না।

কেদারবাবু চলিতে উদ্যত হইয়া বলিলেন, তা হলে আজ আমরা একটু ব্যস্ত আছি, আর একদিন এলে—

35 Shares