গৃহদাহ

সংবাদদাতা অতঃপর লিখিয়াছেন, ইহার প্রাণরক্ষা করিতে কি করিয়া এই অসমসাহসী বাঙালী যুবক নিজের প্রাণ তুচ্ছ করিয়া জ্বলন্ত অগ্নিরাশির মধ্যে প্রবেশ করিয়া,—ইত্যাদি ইত্যাদি—

পড়া শেষ হইয়া গেল। কেদারবাবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, কিন্তু এ কি আমাদের সুরেশ বলেই তোমার মনে হয়?

অচলা শান্তভাবে বলিল, হাঁ বাবা, ইনি আমাদেরই সুরেশবাবু।

কেদারবাবু আর একবার চমকিয়া উঠিলেন। বোধ করি, নিজের অজ্ঞাতসারেই অচলার মুখ দিয়া এই ‘আমাদেরই’ কথাটার উপর একবার একটা অতিরিক্ত জোর প্রকাশ পাইয়াছিল। হয়ত সে শুধু একটা নিশ্চিত বিশ্বাস জানাইবার জন্যই, কিন্তু কেদারবাবুর বুকের মধ্যে তাহা আর একবার বাজিয়া উঠিল; এবং মজ্জমান ব্যক্তি যেভাবে তৃণ অবলম্বন করিতে দুই বাহু বাড়াইয়া দেয়, ঠিক তেমনি করিয়া বৃদ্ধ পিতা কন্যার মুখের এই একটিমাত্র কথাকেই নিবিড় আগ্রহে বুকে চাপিয়া ধরিলেন। এই একটি কথাই তাঁহার কানে কানে, চক্ষের নিমিষে কত কি অসম্ভব সম্ভাবনার দ্বারোদ্ঘাটনের সংবাদ শুনাইয়া গেল, তাহার সীমা রহিল না। তাঁহার মুখখানা আজ এতদিন পরে অকস্মাৎ আশার আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। বলিলেন, আচ্ছা মা, তোমার কি মনে হয় না যে—

পিতাকে সহসা থামিতে দেখিয়া অচলা মুখপানে চাহিয়া কহিল, কি মনে হয় না বাবা?

কেদারবাবু সাবধানে অগ্রসর হইবার জন্য মুখের কথাটা চাপিয়া গিয়া বলিলেন, তোমার কি মনে হয় না যে, সুরেশ যে ব্যবহার আমাদের সঙ্গে করে গেল, তার জন্য সে বিশেষ অনুতপ্ত?

অচলা তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিল, আমার তা নিশ্চয় মনে হয় বাবা।

কেদারবাবু প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, নিশ্চয়! নিশ্চয়! এক শ-বার। তা না হলে সে এভাবে পালাত না—কোথাকার একটা তুচ্ছ স্ত্রীলোককে বাঁচাতে আগুনের মধ্যে ঢুকত না। আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে, সে শুধু অনুতাপে দগ্ধ হয়েই নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে গিয়াছিল। সত্য কি না বল দেখি মা!

অচলা পিতার ঠিক জবাবটা এড়াইয়া গিয়া ধীরে ধীরে কহিল, শুনেছি, পরকে বাঁচাতে এইরকম আরও দু-একবার তিনি নিজের প্রাণ বিপদাপন্ন করেছিলেন।

কথাটা কেদারবাবুর তেমন ভাল লাগিল না। বলিলেন, সে আলাদা কথা অচলা। কিন্তু এ যে আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া! এ যে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা! দুটোর প্রভেদ দেখতে পাচ্চ না?

অচলা আর প্রতিবাদ না করিয়া বলিল, তা বটে। কিন্তু যারা মহৎপ্রাণ, তাঁদের যে-কোন অবস্থাতেই, পরের বিপদে নিজের বিপদ মনে থাকে না—

কেদারবাবু উৎসাহে লাফাইয়া উঠিলেন। দৃপ্তকণ্ঠে বলিলেন, ঠিক, ঠিক! তাই ত তোকে বলচি অচলা—সে একটা মহৎপ্রাণ। তার সঙ্গে কি আর কারো তুলনা চলে! এত লোক ত আছে, কিন্তু কে কারে পাঁচ-পাঁচ হাজার টাকা একটা কথায় ফেলে দিতে পারে, বল দেখি! সে যাই কেন না করে থাক, বড় দুঃখেই করে ফেলেচে—এ আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি।

কিন্তু শপথের কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। এ সত্য অচলা নিজে যত জানিত, তিনি তাহার শতাংশের একাংশও জানিতেন না। কিন্তু জবাব দিতে পারিল না—নিমিষের লজ্জা পাছে তাহার মুখে ধরা পড়ে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘাড় হেঁট করিয়া মৌন হইয়া রহিল। কিন্তু বৃদ্ধের সতৃষ্ণ-দৃষ্টির কাছে তাহা ফাঁকি পড়িল না। তিনি পুলকিত-চিত্তে বলিতে লাগিলেন, মানুষ ত দেবতা নয়—সে যে মানুষ! তার দেহ দোষে-গুণে জড়ানো; কিন্তু তাই বলে ত তার দুর্বল মুহূর্তের উত্তেজনাকে তার স্বভাব বলে ধরে নেওয়া চলে না! বাইরের লোক যে যা ইচ্ছে বলুক অচলা, কিন্তু আমরাও যদি এইটেকেই দোষ বলে বিচার করি, তাদের সঙ্গে আমাদের তফাত থাকে কোন্‌খানে বল দেখি? বড়লোক ত ঢের আছে, কিন্তু এমন করে দিতে জানে কে? কি লিখেচে ওইখানটায় আর-একবার পড় দেখি মা! আগুনের ভেতর থেকে তাকে নিরাপদে বার করে নিয়ে এল! ওঃ কি মহৎপ্রাণ! দেবতা আর বলে কাকে! বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিলেন।

অচলা তেমনি নিরুত্তর অধোমুখে বসিয়া রহিল।

কেদারবাবু ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, আচ্ছা, আমাদের একখানা টেলিগ্রাফ করে কি তার খবর নেওয়া উচিত নয়? তার এ বিপদের দিনেও কি আমাদের অভিমান করা সাজে?

এবার অচলা মুখ তুলিয়া কহিল, কিন্তু আমরা ত তাঁর ঠিকানা জানিনে বাবা।

কেদারবাবু বলিলেন, ঠিকানা! ফয়জাবাদ শহরে এমন কেউ কি আছে যে আমাদের সুরেশকে আজ চেনে না? তার ওপর আমার রাগ খুবই হয়েছিল, কিন্তু এখন আর আমার কিছু মনে নেই। একখানা টেলিগ্রাম লিখে এখ্‌খুনি পাঠিয়ে দাও মা; আমি তার সংবাদ জানবার জন্যে বড় ব্যাকুল হয়ে উঠেছি।

এখুনি দিচ্চি বাবা, বলিয়া সে একখানা টেলিগ্রাফের কাগজ আনিতে ঘরের বাহির হইয়া একেবারে সুরেশের সম্মুখেই পড়িয়া গেল।

অন্তরে গভীর দুঃখ বহন করার ক্লান্তি এত শীঘ্র মানুষের মুখকে যে এমন শুষ্ক, এমন শ্রীহীন করিয়া দিতে পারে, জীবনে আজ অচলা এই প্রথম দেখিতে পাইয়া চমকাইয়া উঠিল। খানিকক্ষণ পর্যন্ত কাহারও মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তার পরে সে-ই কথা কহিল। বলিল, বাবা বসে আছেন; আসুন, ঘরে আসুন। ফয়জাবাদ থেকে কবে এলেন? ভাল আছেন আপনি?

অজ্ঞাতসারে তাহার কণ্ঠস্বরে যে কতখানি স্নেহের বেদনা প্রকাশ পাইল, তাহা সে নিজে টের পাইল না; কিন্তু সুরেশ একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িবার মত হইল; কিন্তু তবুও আজ সে তাহার বিগত দিনের কঠোর শিক্ষাকে নিষ্ফল হইতে দিল না। সেই দুটি আরক্ত পদতলে তৎক্ষণাৎ জানু পাতিয়া বসিয়া পড়িয়া, তাহার অগাধ দুষ্কৃতির সমস্তটুকু নিঃশেষে উজাড় করিয়া দিবার দুর্জয় স্পৃহাকে আজ সে প্রাণপণ-বলে নিবারণ করিয়া লইয়া, সসম্ভ্রমে কহিল, আমার ফয়জাবাদে থাকবার কথা আপনি কি করে জানলেন?

অচলা তেমনি স্নেহার্দ্রস্বরে বলিল, খবরের কাগজে এইমাত্র দেখে বাবা আমাকে টেলিগ্রাফ করতে বলছিলেন। আপনার জন্যে তিনি বড় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন—আসুন একবার তাঁকে দেখা দেবেন, বলিয়া সে ফিরিবার উপক্রম করিতেই সুরেশ বলিয়া উঠিল, তিনি হয়ত পারেন, কিন্তু তুমি আমাকে কি করে মাপ করলে অচলা?

35 Shares