কেদারবাবু সে কথার কোন জবাবও দিলেন না। তিনজনে বসিবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিতেই একজন প্রৌঢ়া রমণী দ্বারের অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া অচলার হাত ধরিয়া তাহাকে বাড়ির ভিতরে লইয়া গেলেন। তাঁহার নিজের ঘরের মেজের উপর একখানি কার্পেট বিছান ছিল, তাহারই উপর অচলাকে সযত্নে বসাইয়া আপনার পরিচয় দিলেন। বলিলেন, আমি সম্পর্কে তোমার শাশুড়ি হই বৌমা। আমি মহিমের পিসি।
অচলা প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইয়া সবিস্ময়ে তাঁহার মুখপানে চাহিয়া কহিল, আপনি এখানে কবে এলেন?
মহিমের যে পিসি ছিলেন, তাহা সে জানিত না। প্রৌঢ়া তাহার বিস্ময়ের কারণ অনুমান করিয়া, হাসিয়া কহিলেন, আমি এইখানেই থাকি মা, আমি সুরেশের পিসি; কিন্তু মহিমও পর নয়, তাই তারও আমি পিসি হই মা।
তাঁহার স্বভাব-কোমল কণ্ঠস্বরে এমনই একটা স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ পাইল যে, একমুহূর্তেই অচলার বুকের ভিতরটা আলোড়িত হইয়া উঠিল। তাহার মা নাই, সে অভাব এতটুকু পূর্ণ করে, বাড়িতে এমন কোন আত্মীয় স্ত্রীলোক কোনদিন নাই। তাহার জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত এতদিন সে পিতার স্নেহেই মানুষ হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু সে স্নেহ যে তাহার হৃদয়ের কতখানি খালি ফেলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা একমুহূর্তেই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল—আজ পরের বাড়ির পরের পিসিমা যখন ‘বৌমা’ বলিয়া ডাকিয়া তাহাকে আদর করিয়া কাছে বসাইলেন। প্রথমটা যে অভিনব সম্বোধনে একটুখানি লজ্জিত হইয়া পড়িল; কিন্তু ইহার মাধুর্য, ইহার গৌরব তাহার নারী-হৃদয়ের গভীর অন্তস্তলে বহুক্ষণ পর্যন্ত ধ্বনিত হইতে লাগিল।
দেখিতে দেখিতে দু’জনের কথা জমিয়া উঠিল। অচলা লজ্জিতমুখে প্রশ্ন করিল, আচ্ছা পিসিমা, আমাকে যে আপনি কাছে বসালেন, কৈ ব্রাহ্ম-মেয়ে বলে ত ঘৃণা করলেন না!
পিসিমা তাড়াতাড়ি আপনার অঙ্গুলির প্রান্ত দ্বারা তাহার চুম্বন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, তোমাকে ঘৃণা করব কেন মা? একটু হাসিয়া কহিলেন, আমরা হিন্দুর মেয়ে বলে কি এমন নির্বোধ, এত হীন বৌমা, যে, শুধু ধর্মমত আলাদা বলে তোমার মত মেয়েকেও কাছে বসাতে সঙ্কোচবোধ করব? ঘৃণা করা ত অনেক দুরের কথা মা!
অচলা অত্যন্ত লজ্জা পাইয়া বলিল, আমাকে মাপ করুন পিসিমা, আমি জানতুম না। আমাদের সমাজের বাইরে কোন মেয়েমানুষের সঙ্গেই কোনদিন আমি মিশতে পাইনি; শুধু শুনেছিলুম যে, তাঁরা আমাদের বড় ঘৃণা করেন; এমন কি, একসঙ্গে বসলে দাঁড়ালেও তাঁদের স্নান করতে হয়।
পিসিমা বলিলেন, সেটা ঘৃণা নয় মা, সে একটা আচার। আমাদের বাইরের আচরণ দেখে হয়ত তোমাদের অনেক সময় এই কথাই মনে হবে, কিন্তু সত্যি বলচি মা, সত্যিকারের ঘৃণা—আমরা কাউকে করিনে। আমাদের দেশের বাড়িতে আজও আমার বাগদী-জেঠাইমা বেঁচে আছে—তাকে কত যে ভালবাসি, তা বলতে পারিনে।
একটুখানি থামিয়া বলিলেন, আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি মা তোমাকে—এ কি সুরেশের মুখ থেকে শুনে, না আজ তোমার আমাকে দেখে এ কথা মনে পড়ল?
সুরেশের উল্লেখে অচলা ধীরে ধীরে বলিল, অনেকদিন আগে একবার তিনিও বলেছিলেন বটে।
পিসিমা বলিলেন, ঐ ওর স্বভাব। একটা মনে হলে আর রক্ষে নেই—ও তাই চারিদিকে বলে বেড়াবে। কোনদিন ব্রহ্মদের সঙ্গে না মিশেই ও ভেবে নিলে, তাদের ও ভারী ঘৃণা করে। এই নিয়ে মহিমের সঙ্গে ওর কতদিন ঝগড়া হবার উপক্রম হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ত তাকে একরকম মানুষ করেচি, আমি জানি সে কাউকে ঘৃণা করে না—করবার সাধ্যও ওর নেই। এই দেখ না মা, যেদিন থেকে সে তোমাদের দেখলে, সেদিন থেকে—
কিন্তু কথাটা শেষ করিতে পারিলেন না, অচলার মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়ায় হঠাৎ মাঝখানেই থামিয়া গেলেন। তিনি তাহাদের সম্বন্ধে কতদূর জানিয়াছেন, তাহা বুঝিতে না পারিলেও অচলার সন্দেহ হইল যে, অন্ততঃ কতকটা পিসিমার অবিদিত নাই। ক্ষণকালের জন্য উভয়েই মৌন হইয়া রহিল; অচলা নিজের জন্য লজ্জাটাকে কোনমতে দমন করিয়া অন্য কথা পাড়িল। জিজ্ঞাসা করিল, পিসিমা, আপনিই কি তবে সুরেশবাবুকে মানুষ করেছিলেন?
পিসিমা আবেগে পরিপূর্ণ হইয়া বলিলেন, হাঁ মা, আমিই তাকে মানুষ করেছি। দু’বছর বয়সে ও মা-বাপ হারিয়েছিল। আজও আমার সে কাজ সারা হয়নি—আজও সে বোঝা মাথা থেকে নামেনি, কারুর দুঃখ-কষ্ট কারুর আপদ-বিপদ ও সহ্য করতে পারে না, প্রাণের আশা-ভরসা ত্যাগ করে তার বিপদের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কত ভয়ে ভয়ে দিন-রাত থাকি বৌমা, সে তোমাকে আর বলতে পারিনে।
অচলা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, ফয়জাবাদের ঘটনাটা শুনেছেন?
পিসিমা ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, শুনেছি বৈ কি মা! ভগবানকে তাই সদাই বলি, ঠাকুর, আমি বেঁচে থাকতে যেন আমাকে আর সে দেখা দেখিয়ো না—মাথায় পা দিয়ে একেবারে আমাকে রসাতলে ডুবিয়ে দিয়ো না। এ আমি কোনমতে সহ্য করতে পারব না। বলিতে বলিতেই তাঁহার গলা ধরিয়া গেল। তাঁহার সেই মাতৃস্নেহমণ্ডিত মুখের সকাতর প্রার্থনা শুনিয়া অচলার নিজের চোখ-দু’টি সজল হইয়া উঠিল; করুণকণ্ঠে কহিল, আপনি নিষেধ করে দেন না কেন পিসিমা?
পিসিমা চোখের জলের ভিতর দিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, নিষেধ! আমার নিষেধে কি হবে মা? যার নিষেধে সত্যি সত্যি কাজ হবে, আমি তাকেই ত আজ কত বছর থেকে খুঁজে বেড়াচ্চি। কিন্তু সে ত যে-সে মেয়ের কাজ নয়। ওকে বাঁচাতে পারে, তেমন মেয়ে ভগবান না দিলে আমি কোথায় পাব মা?
অচলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার মনের মত মেয়ে কি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না?
পিসিমা কহিলেন, ঐ যে তোমাকে বললুম মা, ভগবান না দিলে কেউ পায় না। যে সুরেশ কখ্খনো এ কথায় কান দেয় না, সে নিজে এসে যেদিন বললে, পিসিমা, এইবার তোমার একটি দাসী এনে হাজির করে দেব, সেদিন আমার যে কি আনন্দ হয়েছিল, তা মুখে জানানো যায় না। মনে মনে আশীর্বাদ করে বললুম, তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক বাবা। সেদিন আমার কবে হবে যে, বৌ-ব্যাটা বরণ করে ঘরে তুলব। কত বললুম, সুরেশ, আমাকে একবার দেখিয়ে নিয়ে আয়, কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না, হেসে বললে, পিসিমা, আশীর্বাদের দিন একেবারে গিয়ে দিনস্থির করে এসো। তার পর হঠাৎ একদিন শুধু এসে বললে, সুবিধে হল না পিসিমা, আমি রাত্রির গাড়িতে পশ্চিমে চললুম। কত জিজ্ঞাসা করলুম, কিসের অসুবিধে আমাকে খুলে বল্, কিন্তু কোন কথাই বললে না, সেই রাত্রেই চলে গেল। মনে মনে ভাবলুম, শুধু আমার ছেলের ইচ্ছেতেই ত আর হতে পারে না—সে মেয়েরও ত জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যা থাকা চাই! কি বল মা?