গৃহদাহ

অচলা নীরবে ঘাড় নাড়িল। এতক্ষণে সে টের পাইল—মেয়েটি যে কে, পিসিমা তাহা জানেন না। তাহার একবার মনে হইল বটে—তাহার বুকের উপর হইতে একটা পাথর নামিয়া গেল—কিন্তু পাথরখানা যে সহজে যায় নাই, বুকের অনেকখানি ছিঁড়িয়া পিষিয়া দিয়া গিয়াছে, তাহা পরক্ষণেই আবার যেন স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিল।

আহারের আয়োজন হইলে পিসিমা অচলাকে আলাদা বসাইয়া খাওয়াইলেন এবং সঙ্গে করিয়া বাড়ির প্রত্যেক কক্ষ, প্রতি জিনিসপত্র ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখাইয়া আনিয়া, সহসা একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, মা, ভগবানের আশীর্বাদে অভাব কিছুরই নেই—কিন্তু এ যেন সেই লক্ষ্মীহীন বৈকুণ্ঠ। মাঝে মাঝে চোখে জল রাখতে পারিনে বৌমা।

চাকর আসিয়া খবর দিয়া গেল, বাহিরে কেদারবাবু যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। অচলা প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইতেই পিসিমা তাহার একটা হাত ধরিয়া একবার একটু দ্বিধা করিয়া চুপি চুপি বলিলেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, যদি কিছু না মনে কর মা!

অচলা তাঁহার মুখপানে চাহিয়া শুধু একটুখানি হাসিল।

পিসিমা বলিলেন, সুরেশের কাছে তোমার আর মহিমের সমস্ত কথা আমি শুনতে পেয়েচি মা। তার মুখেই শুনতে পেলুম, সে গরীব বলে নাকি তোমার বাবার ইচ্ছে ছিল না। শুধু তোমার জন্যেই—

অচলা ঘাড় হেঁট করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, সত্যি পিসিমা।

পিসিমা অকস্মাৎ যেন উচ্ছ্বসিত আবেগে অচলার হাত দুখানি চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, এই ত চাই মা! যাঁকে ভালবেসেচ তাঁর কাছে টাকাকড়ি, ধনদৌলত কতটুকু? মনে কোন ক্ষোভ রেখো না মা। আমি মহিমকে খুব জানি, সে এমনি ছেলে, যত কেন না দুঃখ তার জন্যে পাও—একদিন ভগবানের আশীর্বাদে সমস্ত সার্থক হবে। তিনি এত বড় ভালবাসার কিছুতেই অমর্যাদা করতে পারবেন না, এ আমি তোমাকে নিশ্চয় বলচি।

অচলা আর একবার হেঁট হইয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইল।

তিনি তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, আহা, এমনি একটি বৌ নিয়ে যদি আমি ঘর করতে পেতুম!

সুরেশ আসিয়া উভয়কে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া নিঃশব্দে নমস্কার করিয়া ফিরিয়া গেল। যাবার সময় লণ্ঠনের আলোকে পলকের জন্য তাহার মুখখানা অচলার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। সে মুখে যে কি ছিল, তাহা জগদীশ্বর জানেন, কিন্তু অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাস তাহার কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল, জুড়ি-গাড়ি দ্রুতপদে পথে আসিয়া পড়িল। রাস্তার জনস্রোত তখন মন্দীভূত হইয়াছে, সেইদিকে চাহিয়া তাহার হঠাৎ মনে হইল, এতক্ষণ সে যেন একটা মস্ত স্বপ্ন দেখিতেছিল। তাহা সুখের কিংবা দুঃখের তাহা বলা শক্ত। কেদারবাবু এতক্ষণ মৌন হইয়াই ছিলেন—বোধ করি সুরেশের ঐশ্বর্যের চেহারাটা তাঁহার মাথার মধ্যে ঘুরিতেছিল; সহসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, হাঁ, বড়লোক বটে!

মেয়ের তরফ হইতে কিন্তু এতটুকু সাড়া পাওয়া গেল না। উৎসাহের অভাবে বাকি পথটা তিনি চুপ করিয়াই রহিলেন।

গাড়ি আসিয়া যখন তাঁহার দ্বারে লাগিল এবং সহিস কবাট খুলিয়া দিয়া সরিয়া দাঁড়াইল, তখন আর একবার যেন তাঁহার চমক ভাঙ্গিয়া গেল। আবার একটা নিশ্বাস ফেলিয়া নিজের মনে মনেই বলিলেন, সুরেশকে আমরা কেউ চিনতে পারিনি! একটা দেবতা!

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

আজ অচলার বিবাহ। বিবাহ-সভার পথে পলকের জন্য সুরেশকে দেখা গিয়াছিল। তাহার পরে সে যে কোথায় অন্তর্ধান হইয়া গেল, সারা রাত্রির মধ্যে কেদারবাবুর বাটীতে আর তাহার উদ্দেশ পাওয়া গেল না।

বিবাহ হইয়া গেল। দুই-একটা দিন অচলার মনের মধ্যে বিপ্লব বহিতেছিল। সেই নিমন্ত্রণের রাত্রে সুরেশের পিসিমার কথা সে কোনমতেই ভুলিতে পারিতেছিল না; আজ তাহার নিবৃত্তি হইল।

মহিমের অটল গাম্ভীর্য আজও অক্ষুণ্ণ রহিল। আনন্দ-নিরানন্দের লেশমাত্র বাহ্য-প্রকাশ তাহার মুখের উপর দেখা দিল না। তবুও শুভদৃষ্টির সময় এই মুখ দেখিয়াই অচলার সমস্ত বক্ষ আনন্দে মাধুর্যে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। অন্তরের মধ্যে স্বামীর পদতলে মাথা পাতিয়া মনে মনে বলিল, প্রভু, আর আমি ভয় করিনে। তোমার সঙ্গে যেখানে যে অবস্থায় থাকিনে কেন, সেই আমার স্বর্গ; আজ থেকে চিরদিন তোমার কুটীরই আমার রাজপ্রাসাদ।

শ্বশুরবাটী যাত্রার দিন কেদারবাবু জামার হাতায় চোখ মুছিয়া কহিলেন, মা, আশীর্বাদ করি স্বামীর সঙ্গে দুঃখ-দারিদ্র্য বরণ করে জীবনের পথে, কর্তব্যের পথে নির্বিঘ্নে অগ্রসর হও। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করবেন। বলিয়া তেমনি চোখ মুছিতে মুছিতে পাশের ঘরে প্রবেশ করিলেন।

তাহার পরে, শ্রাবণের এক স্বল্পালোকিত দ্বিপ্রহরে মাথার উপর ক্ষান্ত-বর্ষণ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও নীচে সঙ্কীর্ণ কর্দমাচ্ছন্ন পিচ্ছিল গ্রাম্য পথ দিয়া পালকি চড়িয়া অচলা একদিন স্বামিগৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু এই পথটুকুর মধ্যেই যেন তাহার নব-বিবাহের অর্ধেক সৌন্দর্য তিরোহিত হইয়া গেল।

পল্লীগ্রামের সহিত তাহার ছাপার অক্ষরের ভিতর দিয়াই পরিচয় ছিল। সে পরিচয়ে দুঃখ-দারিদ্র্যের সহস্র ইঙ্গিতের মধ্যেও ছত্রে ছত্রে কবিতা ছিল, কল্পনার সৌরভ ছিল। পালকি হইতে নামিয়া সে বাড়ির ভিতরে আসিয়া একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল—কোথাও কোন দিক হইতে কবিত্বের এতটুকু তাহার হৃদয়ে আঘাত করিল না। তাহার কল্পনার পল্লীগ্রাম সাক্ষাৎ-দৃষ্টিতে যে এমনি নিরানন্দ, নির্জন—মেটেবাড়ির ঘরগুলা যে এরূপ স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার জানালা-দরজা যে এতই সঙ্কীর্ণ ক্ষুদ্র—উপরে বাঁশের আড়া ও মাচা এত কদাকার—ইহা সে স্বপ্নেও ভাবিতে পারিত না। এই কদর্য গৃহে জীবন-যাপন করিতে হইবে—উপলব্ধি করিয়া তাহার বুক যেন ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিল। স্বামিসুখ, বিবাহের আনন্দ সমস্তই একমুহূর্তে মায়ামরীচিকার মত তাহার হৃদয় হইতে বিলীন হইয়া গেল। বাটীতে শ্বশুর-শাশুড়ি জা-ননদ কেহই ছিল না। দূরসম্পর্কের এক ঠানদিদি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া বর-বধূ বরণ করিয়া ঘরে তুলিবার জন্য ও-পাড়া হইতে আসিয়াছিলেন। তিনি বিবাহের আজন্ম-পরিচিত সাজসজ্জার একান্ত অভাব লক্ষ্য করিয়া অব্যক্ত-বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন ; অবশেষে বধূর হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে আনিয়া বসাইয়া দিলেন। পাড়ার যাহারা বধূ দেখিতে ছুটিয়া আসিল, তাহারা অচলার বয়স অনুমান করিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি, গা টেপাটেপি করিল এবং প্রত্যাগমনকালে তাহাদের অস্ফুট কলরবের মধ্যে ‘বেহ্ম’ ‘মেলেচ্ছ’ প্রভৃতি দুই-একটা মিষ্ট কথা আসিয়াও অচলার কানে পৌঁছিল।

35 Shares