গৃহদাহ

এই শ্রেণীর ঠাট্টা-তামাশার সহিত অচলার কোনদিন পরিচয় ঘটে নাই। সমস্ত পরিহাসই তাহার কাছে এমনি কুরুচিপূর্ণ ও বিশ্রী ঠেকিতেছিল যে, লজ্জায় সে একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া উঠিয়াছিল। এত বড় নির্লজ্জ প্রগল্‌ভতা যে কোন স্ত্রীলোকের মধ্যে থাকিতে পারে, তাহা সে ভাবিতে পারিত না। সুতরাং সমস্ত রসিকতাই তাহার আজন্মের শিক্ষা ও সংস্কারের ভিত্তিতে গিয়া আঘাত করিতেছিল। কিন্তু তবুও তাহার মনে হইতে লাগিল, ইহার আগমনে তাহার নির্বাসনের অর্ধেক বেদনা যেন তিরোহিত হইয়া গেল; এবং এ কে, কোথা হইতে আসিল, তাহার সহিত কি সম্বন্ধ—সমস্ত জানিবার জন্য অচলা উৎসুক হইয়া উঠিল!

হরির মা কহিল, এ মেয়েটি কে দিদি? খুব আমুদে মানুষ।

অচলা ঘাড় নাড়িয়া শুধু বলিল, হাঁ।

ভিজে কাপড় ছাড়িয়া মৃণাল এ-ঘরে আসিয়া কহিল, কেবল ঠাট্টা-তামাশা করেই গেলুম ঠানদি, আমার আসল পরিচয়টা এখনো দেওয়া হয়নি। আর পরিচয় এমন কি-ই বা আছে? তোমার বর যিনি, তিনি হচ্চেন আমার মায়ের বাপ। আমি তাই ছেলেবেলা থেকে সেজদামশাই বলে ডাকি। বলিয়া একটুখানি স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিল, আমার বাবা আর তোমার শ্বশুর—দু’জনে ভারী বন্ধু ছিলেন। হঠাৎ একদিন গাড়ি চাপা পড়ে, ডান হাতটা ভেঙ্গে গিয়ে বাবার যখন চাকরি গেল, তখন তোমার শ্বশুর এই বাড়িতে তাঁদের আশ্রয় দিলেন। তার অনেক পরে আমার জন্ম হয়। সেজদা তখন আট বছরের ছেলে। তাঁর মা ত তাঁর জন্ম দিয়েই মারা যান; বড় দু’ ছেলে আগে ডিপথিরিয়া রোগে মারা গিয়েছিল। তাই আমার মা আসা পর্যন্তই হলেন এ বাড়ির গিন্নী। তার পরে বাবা মারা গেলেন, আমরা এ বাড়িতেই রইলুম। তার অনেক পরে তোমার শ্বশুর মারা গেলেন, আমরা কিন্তু রয়েই গেলুম। এই সবে পাঁচ বছর হল পলাশীর ঘোষাল-বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়ে সেজদা আমাকে দূর করে দিয়েছেন। মা বেঁচে থাকলেও যা হোক একটু জোর থাকত।

বড়বৌ এই ঘরে নাকি? বলিয়া একটি বৃদ্ধগোছের বেঁটেখাটো গৌরবর্ণ ভদ্রলোক দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

মৃণাল কহিল, এসো, এসো। অচলার পানে চাহিয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিল, ঐটি আমার কর্তা ঠানদি। আচ্ছা, তুমিই বল ত ভাই, ওই বাহাত্তুরে বুড়োর সঙ্গে আমাকে মানায়? এ জন্মের রূপ-যৌবন কি সব মাটি হয়ে গেল না ভাই?

অচলা জবাব দিবে কি, লজ্জায় মাথা হেঁট করিল।

ভদ্রলোকটির নাম ভবানী ঘোষাল। তিনি হাসিয়া কহিলেন, বিশ্বাস করবেন না ঠানদি—সব মিছে কথা। ওর কেবল চেষ্টা—আমাকে খেলো করে দেয়। নইলে, বয়স ত আমার এই সবে বায়ান্ন কি তি—

মৃণাল কহিল, চুপ করো, চুপ করো। এই সেজদাটি যে আমার কি শত্রু, তা ভগবানই জানেন। আমাকে সবদিকে মাটি করেছেন। আচ্ছা, এই বুড়োর হাতে দেওয়ার চেয়ে, হাত-পা বেঁধে কি আমায় জলে ফেলে দেওয়া ভাল হত না ঠানদি? সত্যিই বলো ভাই।

অচলা তেমনি আরক্তমুখে নীরব হইয়াই রহিল।

ঘোষাল ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া অচলার লজ্জানত মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া সহসা একটা মস্ত আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, বাঁচালেন ঠানদি, এ ছুঁড়ীর অহঙ্কার এতদিনে ভাঙল। রূপের দেমাকে এ চোখে-কানে দেখতেই পেত না।

স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, কেমন এইবার হল ত? বনদেশে এতদিন শিয়াল-রাজা ছিলে, শহরের রূপ কারে বলে, এইবার চেয়ে দেখো।

মৃণাল কহিল, তাই বৈ কি! আমার যেখানে অহঙ্কার সেখানে ভাঙতে যায়—সাধ্যি কার? বলিয়া স্বামীর প্রতি সে যে গোপন কটাক্ষ করিল, অচলার চোখে সহসা তাহা পড়িয়া গেল।

ঘোষাল হাসিয়া বলিলেন, শুনলেন ত ঠানদি,—একটু সাবধানে থাকবেন, দুজনের যে ভাব, যে আসা-যাওয়া, বলা যায় না—আর আমি ত বাহাত্তুরে বুড়ো, মাঝে থাকলেই বা কি, আর না থাকলেই বা কি! নিজেরটি সামলে চলবেন—হিতৈষী বুড়োর এই অনুরোধ।

মৃণাল, তোরা কি সারারাত্রি এই নিয়েই থাকবি?

কি করব সেজদা?

একবার রান্নাঘরের দিকেও যাবিনে?

মৃণাল লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, কি ভুল হয়েই গেছে সেজদা, উড়ে বামুনটাকে আমার আগে দেখে আসা উচিত ছিল। আচ্ছা, তোমরা বাইরে যাও, আমরা যাচ্চি।

মহিম জিজ্ঞাসা করিল, আমরা কে?

মৃণাল কহিল, আমি আর ঠানদি। অচলাকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, আমি যখন এসেচি, তখন এ সংসারের সমস্ত চার্জ তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তবে যাবো সেজদি।

মহিম এবং ভবানী বাহিরে চলিয়া গেল। মৃণাল অচলাকে পুনরায় কহিল, আমার দু’দিন আগে আসাই উচিত ছিল। কিন্তু শাশুড়ির হাঁপানির জ্বালায় কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে বেরুতে পারলুম না। আচ্ছা, তুমি কাপড় ছেড়ে প্রস্তুত হও সেজদি, আমি এখ্‌খুনি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। বলিয়া মৃণাল রান্নাঘরের উদ্দেশে প্রস্থান করিল।

তখন বৃষ্টি ধরিয়া গিয়াছিল এবং গাঢ় মেঘ কাটিয়া গিয়া নবমীর জ্যোৎস্নায় আকাশ অনেকটা স্বচ্ছ হইয়া উঠিতেছিল।

রান্নার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিয়া মৃণাল অচলার কাছে আসিয়া বসিল। তাহার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে লইয়া কহিল, ঠানদিদির চেয়ে সেজদি ডাকটা ভালো, কি বল সেজদি?

অচলা মৃদুস্বরে কহিল, হাঁ।

মৃণাল কহিল, সম্পর্কে তুমি বড় হলেও বয়সে আমি বড়। তাই ইচ্ছে হয়, আমাকেও তুমি মৃণালদিদি বলে ডেকো, কেমন?

অচলা কহিল, আচ্ছা।

মৃণাল কহিল, আজ তোমাকে রান্নাঘর দেখিয়ে আনলুম; কিন্তু কাল একেবারে ভাঁড়ারের চাবি আঁচলে বেঁধে দেব, কেমন?

অচলা কহিল, চাবিতে আমার কাজ নেই ভাই।

মৃণাল হাসিয়া কহিল, কাজ নেই? বাপ রে, ও কি কথা! ভাঁড়ারটা কি তুচ্ছ জিনিস সেজদি যে, বলচ—তার চাবিতে কাজ নেই? গিন্নীর রাজত্বের ওই ত হল রাজধানী গো।

অচলা কহিল, হোক রাজধানী, তাতে আমার লোভ নেই। কিন্তু তোমার ওপর আমার ভারী লোভ। শিগ্‌গির ছেড়ে দিচ্চিনে মৃণালদিদি।

মৃণাল দুই বাহু বাড়াইয়া অচলাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, সতীনকে ঝাঁটা মেরে বিদায় না করে, ঘরে ধরে রাখতে চাও—এ তোমার কি-রকম বুদ্ধি সেজদি?

35 Shares