গৃহদাহ

মৃণাল কহিল, তুমি নেবে না ত কে নেবে গো? তোমার বাড়ি ঝাঁট-পাট দেবার জন্যে কি ও-পাড়া থেকে পদির মাসী আসবে নাকি? নাও, কথা কয়ে সময় নষ্ট করতে হবে না, সন্ধ্যা হয়।

অচলা কাজ করিতে করিতে হাসিয়া কহিল, নিজেও একদণ্ড বসবে না, আমাকেও খাটিয়ে খাটিয়ে মারলে, সত্যি বলচি মৃণালদিদি, এই পাঁচ-ছ’দিন যে খাটান আমাকে খাটিয়েচ, চা-বাগানের কর্তারাও বোধ করি তাদের কুলীদের এত করে খাটায় না।

মৃণাল কাছে আসিয়া তাহার চিবুকের উপর আঙুলের একটা ঘা দিয়া বলিল, তাই ত, ঘরদোর দেখে মনে হচ্ছে, বাড়িতে লক্ষ্মীর আবির্ভাব হয়েছে, খাটুনি বলছিস ভাই সেজদি—যেদিন স্বামী-পুত্র ঘরকন্না নিয়ে, নাবার খাবার সময় পাবে না, শুধু তখনি ত এই মেয়েমানুষ-জন্মটা সার্থক হবে। ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি, একদিন যেন তোমার সেদিন আসে—এখুনি খাটুনির হয়েচে কি গিন্নী! বলিয়া হাসিতে গেল বটে, কিন্তু তাহার ঠোঁট কাঁপিয়া গেল।

হরির মা হঠাৎ ভ্যাক্‌ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, সেই আশীর্বাদ কর দিদি, শুধু সেই আশীর্বাদই কর। তাহার অচলার মাকে মনে পড়িয়া গিয়াছিল—সেই সাধ্বী অত্যন্ত অসময়ে যখন স্বর্গারোহণ করেন, তখন একরত্তি মেয়েকে হরির মায়ের হাতেই সঁপিয়া দিয়া গিয়াছিলেন। সেই মেয়ে এখন এতরড় হইয়া স্বামীর ঘর করিতে আসিয়াছে।

মৃণাল তাহাকে ধমক দিয়া বলিল, আ মর্‌! ছিঁচকাঁদুনী মাগী, কাঁদিস কেন?

হরির মা চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, কাঁদি কি সাধে দিদি! তোমার কথা শুনে কান্না যে কিছুতে ধরে রাখতে পারিনে। মাইরি বলচি, তুমি না এসে পড়লে এ বাড়িতে একটা রাতও যে আমাদের কি করে কাটত, তাই আমি ভেবে পাইনে।

আজ ছয় দিন হইল, মৃণাল এ বাটীতে আসিয়াছে। আসিয়া পর্যন্ত বাড়ি-ঘরদ্বার হইতে আরম্ভ করিয়া মানুষগুলোর পর্যন্ত চেহারা বদলাইয়া দিবার কার্যেই নিজেকে ব্যাপৃত রাখিয়াছে। কিন্তু তাহার সব কাজকর্ম, হাসিঠাট্টার মধ্যে হইতে একটা যাই-যাই ভাব অচলাকে পীড়া দিতেছিল। কারণ, মৃণালের কাজে কথায়, আচারে ব্যবহারে এতবড় একটা সহজ আত্মীয়তা ছিল, যাহার আড়ালে স্বচ্ছন্দে দাঁড়াইয়া অচলা উঁকি মারিয়া তাহার নূতন জীবনের অচেনা ঘরকন্নাকে চিনিয়া লইবার সময় পাইতেছিল এবং ইহার চেয়েও একটা বড় জিনিসকে তাহার ভাল করিয়া এবং বিশেষ করিয়া চিনিবার কৌতূহল হইয়াছিল, সে স্বয়ং মৃণালকে। তাহার সাংসারিক অবস্থা যে সচ্ছল নহে, তাহা তাহার সম্পূর্ণ অলঙ্কারবর্জিত হাত-দুখানির পানে চাহিলেই টের পাওয়া যায়। তাহাতে ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধ স্বামী—কোন দিক দিয়াই যাহাকে তাহার উপযুক্ত বলিয়া অচলার মনে হয় না; তাহার উপর বাড়িতে পরিশ্রমের অন্ত নাই—জরাজীর্ণ শাশুড়ি মর মর অবস্থায় অহর্নিশি গলায় ঝুলিতেছে; কারণে-অকারণে তাহার বকুনি-ঝকুনির বিরাম নাই—এ কথা সে মৃণালের নিজের মুখেই শুনিয়াছে-অথচ কোন প্রতিকূলতাই যেন দুঃখ দিয়া এই মেয়েটিকে তাহার জীবনযাত্রার পথে অবসন্ন করিয়া বসাইয়া দিতে পারে না। হৃদয়ের আনন্দ-নিরানন্দ ছাড়া বাহিরের কোন-কিছুর যেন অস্তিত্ব নাই—এমনি এই মূর্খ পাড়াগাঁয়ের মেয়েটার ভাব। অনুক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া সে বেশ বুঝিতেছিল, পদ্ম যেমন পাঁকের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াও মলিনতার অতীত, ঠিক তেমনি যেন এই লেখাপড়া না-জানা দরিদ্র পল্লী-লক্ষ্মীটিও সর্বপ্রকার সাংসারিক দুঃখ-দারিদ্র্যের ক্রোড়ে অহোরাত্র বাস করিয়াও সমস্ত বেদনা-যন্ত্রণার উপরে অবলীলাক্রমে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। না আছে তাহার দেহের ক্লান্তি, না আছে তাহার মুখের শ্রান্তি। সুতরাং অচলাকেও সে যে সকল অনভ্যস্ত কাজের মধ্যে অবিশ্রান্ত টানিয়া লইয়া ফিরিতেছিল, যদিচ তাহার কোনটার সহিত তাহার শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কারের সামঞ্জস্য ছিল না, তথাপি না বলিয়া মুখ ফিরাইয়া দাঁড়ানটা যেন অতি-বড় লজ্জার কথা, এমনই অচলার মনে হইতেছিল। নিজের ভাগ্যটাকেও যে একবার ধিক্কার দিবার জন্য সে একমুহূর্ত বসিয়া শোক করিবে, এ ছয়টা দিনের মধ্যে সে ফাঁকটুকু পর্যন্ত তাহার মিলে নাই—সমস্ত সময়টা সে কাজ দিয়া, হাসি-গল্প দিয়া এমনি ভরাট করিয়া গাঁথিয়া আনিতেছিল। তাই তাহার শ্বশুরবাড়ি ফিরিয়া যাইবার ইঙ্গিত মাত্রেই অচলার মনে হইতেছিল, সঙ্গে সঙ্গেই এই সমস্ত মেটেবাড়িটা তাহার দরজা-জানালা-দেয়ালসমেত যেন তাসের ঘরের মত চক্ষের নিমিষে উপুড় হইয়া পড়িয়া যাইবে, মৃণালদিদি চলিয়া গেলে এখানে সে একদণ্ডও তিষ্ঠিবে কি করিয়া?

সন্ধ্যার পর একসময়ে অচলা কহিল, কেবল যে পালাই পালাই করচ মৃণালদিদি, বাপের বাড়ি এসে কে এত শীঘ্র ফিরে যায় বল ত? তা হবে না—আমি যতদিন না কলকাতায় ফিরে যাব, ততদিন তোমাকে থাকতেই হবে।

মৃণাল কহিল, কি করব ভাই সেজদি, শাশুড়িবুড়ী না নিজে মরবে, না আমাকে একদণ্ড ছেড়ে দেবে। আমি বলি, বুড়ী তুই মর্‌। তোর ছেলের বয়স ষাট হতে চলল, শেষে তাকে খেয়ে তবে যাবি? তা এত যে দিবারাত্রি কাসে, দমটা ত একবারও আটকে যায় না!

অচলা হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, তোমাকে বুঝি তিনি দেখতে পারেন না?

মৃণাল মাথা নাড়িয়া কহিল, দুটি চক্ষে না।

অচলা কহিল, আর তুমি?

মৃণাল বলিল, আমিও না। বুড়ীকে গঙ্গাযাত্রা করিয়ে আমি পাঁচ-সিকের হরির-লুট দেব মানত করে রেখেচি যে!

অচলা মাথা নাড়িয়া কহিল, বিশ্বাস হয় না মৃণালদিদি! তুমি সংসারে কাকে যে দেখতে পারো না, তা তোমার মুখের কথা শুনে কিছুতেই বলবার জো নেই! হয়ত এই বুড়ীকেই তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাস।

মৃণাল হাসিমুখে কহিল, সবচেয়ে বেশি ভালবাসি? তা হবে। বলিয়া অচলার গাল টিপিয়া দিয়া কাজে চলিয়া গেল।

যাই-যাই করিয়া মৃণালের আবার কিছুদিন গড়াইয়া গেল। একদিন হঠাৎ অচলার চোখে পড়িল, যাবার দিকে তাহার মুখে যত তাড়া, কাজের দিকে তত নয়। সত্যই চলিয়া যাইতে সে যেন ঠিক এত উৎসুক নয়। এতদিন তাহার অন্তরালে দাঁড়াইয়া পৃথিবীকে সে যেভাবে চিনিয়া লইতেছিল, এখন তাহার আবরণের বাহিরে আসিয়া, পৃথিবীর সে চেহারা তাহার চোখে যেন আর রহিল না। এ বাটিতে পা দিয়া পর্যন্ত যখনই তাহাকে স্বামীর সঙ্গে কোন-একটা হাসি-তামাশা করিতে দেখিয়াছে, তখনই তাহার বুকের মধ্যে ছাঁৎ করিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে যেন সুচ ফুটিতে লাগিল। এ-সব কিছুই নয়, ইহার মধ্যে যথার্থ পরিহাস ভিন্ন আর কিছুই নাই—মন খারাপ করিবার কোন হেতু নাই—তাহার মন বড় অশুচি—এমনি করিয়া আপনাকে সে যতই শাসন করিবার চেষ্টা করে, ততই কোথা হইতে সংশয়ের বিপরীত তর্ক তাহার হৃদয়ের মধ্যে অনিচ্ছা-সত্ত্বেও বারংবার মুখ তুলিয়া তাহাকে ভ্যাঙচাইতে থাকে। মহিমের স্বাভাবিক গাম্ভীর্য এইখানে যেন অতিশয় বাড়াবাড়ি বলিয়া তাহার মনে হয়। সে এই বলিয়া বিতর্ক করিতে থাকে, ভিতরে যদি কিছুই নাই, তবে পরিহাসের জবাব পরিহাস দিয়া করিতেই বা দোষ কি! যে তামাশা করিয়া উত্তর দিতে পারে না, সে ত অন্ততঃ হাসিমুখে সেটা উপভোগ করিতেও পারে! অথচ সে যেন স্পষ্ট দেখিতে পায়, মৃণালের রহস্যালাপের সূত্রপাতেই মহিম লজ্জিতমুখে কোনমতে তাড়াতাড়ি অন্যত্র পলাইয়া বাঁচে। তাই কোথায় কি একটা যেন প্রচ্ছন্ন অন্যায় রহিয়াছে, আজকাল এ চিন্তা কোনমতেই সে মন হইতে সম্পূর্ণ তাড়াইতে পারে না। মৃণালের সঙ্গে একত্র কাজকর্ম করিতে করিতেও তাহার এক শ’বার মনে হয়, সে নিজে মেয়েমানুষ হইয়া যখন বুকের মধ্যে একটা ঈর্ষার বেদনা বহন করিতে থাকিয়াও ইহাকে কোনমতে ছাড়িয়া দিতে পারিতেছে না, একত্র এতকাল ঘর করিয়াও কি কোন পুরুষমানুষে এ মেয়েকে ভাল না বাসিয়া থাকিতে পারে?

35 Shares