গৃহদাহ

মৃণাল আসিলেই যে উড়ে বামুন তাহার রান্নাঘরের দায় হইতে মুক্তি পাইয়া বাঁচিত, এ কথা অচলা জানিত না। এবারেও সে ছুটি পাইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল ; কিন্তু অচলা কেবলই লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিল, মৃনাল নিজের হাতে রাঁধিয়া মহিমকে খাওয়াইতে যেন প্রাণ দিয়া ভালবাসে। আজ সকালে সে হঠাৎ বলিয়া বসিল, মৃণালদিদি, আজ তোমার ছুটি।

মৃণাল বুঝিতে না পারিয়া কহিল, কিসের ভাই সেজদি?

অচলা কহিল, রান্নার। আজ আমিই রাঁধব।

মৃণাল অবাক হইয়া বলিল, পোড়া কপাল! তুমি আবার রাঁধবে কি?

অচলা মাথা নাড়িয়া কহিল, বাঃ, আমি বুঝি জানিনে? বাড়িতে আমি ত কতদিন রেঁধেছি। সে হবে না মৃণালদি, আজ আমি রাঁধবই।

তাহার আগ্রহ দেখিয়া মৃণাল হঠাৎ ম্লান হইয়া গেল; কহিল, সে কি হয়, আমি থাকতে তুমি কি দুঃখে রান্নাঘরের ধুঁয়োর মধ্যে কষ্ট পেতে যাবে ভাই?

তাহার মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া অচলা জিদ করিয়া বলিল, তা হলে বামুন থাকতে তুমিই বা কেন কষ্ট কর? এবেলা আমি নিশ্চয় রাঁধব।

কেন যে তাহার এই আগ্রহ, মৃণাল তাহার কিছুই বুঝিল না। সে হাসি চাপিয়া কৃত্রিম অভিমানের সুরে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, বা রে মেয়ে। একে একে বুঝি তুমি আমার সব কেড়েকুড়ে নিতে চাও? সবই ত নিয়েছ, দুটো দিন রেঁধে খাইয়ে যাবো তাও বুঝি সইচে না? এখন থেকে সতীনের হিংসে শুরু হল বুঝি?

অচলার বুকের ভিতরটায় আবার ছাঁৎ করিয়া উঠিল। মৃণালের শেষ কথাটা গিয়া তাহার ঈর্ষার ব্যথায় সজোরে ঘা দিল। সে একমুহূর্তেই গম্ভীর হইয়া শুধু সংক্ষেপে কহিল, না, আজ আমিই রাঁধব।

এতক্ষণে মৃণাল দেখিতে পাইল, অচলা রাগ করিয়াছে। তাই আর তর্কাতর্কি না করিয়া বিষণ্ণমুখে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বেশ, তা হলে তুমিই রাঁধো গে। আচ্ছা চল, কোথায় কি আছে, দেখিয়ে দিয়ে আসি।

মহিম যে এতক্ষণ ঘরেই ছিল, তাহা দু’জনের কেহই জানিত না। সহসা তাহাকে সম্মুখে দেখিয়া উভয়েই অপ্রতিভ হইয়া গেল।

মহিম অচলাকে উদ্দেশ করিয়া ধীরে ধীরে বলিল, মৃণাল যে-ক’দিন আছে ওই রাঁধুক না।

কেন যে সে আপত্তি করিতেছিল, মহিম তাহা জানিত। কিন্তু সে কথা ত খুলিয়া বলা চলে না।

অচলা আরও জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু রাগ চাপিয়া শুধু কহিল, না, আমিই রাঁধতে যাচ্চি, বলিয়াই বাদানুবাদের অপেক্ষামাত্র না করিয়া দ্রুতপদে সরিয়া গেল।

অচলা জোর করিয়া রাঁধিতে গেল। রান্নার কাজে সে কাহারও চেয়েই খাটো ছিল না; কিন্তু এদিকে সে মন দিতেই পারিল না। বিগত দিনের সমস্ত কাহিনী নড়িতে চড়িতে কেবলই খচখচ করিয়া বিঁধিতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, হয়ত মহিম কোনদিনই তাহাকে তেমন করিয়া ভালবাসিতে পারে নাই। তাহার বিবাহের অনতিকাল পূর্বে সুরেশকে লইয়া যে সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, এই-সকল কথা খুঁটিয়া খুঁটিয়া মনে করিয়া আজ সহসা সে যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল, মহিম তাহার প্রতি চিরদিনই উদাসীন; এমন কি পিতার অভিমতে পূর্ব-সম্বন্ধ যখন একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম করিয়াছিল, তখনও মহিম যে কিছুমাত্র বিচলিত হয় নাই, ইহাতে তাহার যেন আর লেশমাত্র সংশয় রহিল না।

এখানে আসা অবধি মৃণাল ও অচলা একসঙ্গে আহারে বসিত। দুপুরবেলা হরির মাকে ডাকিতে পাঠাইয়া দিয়া অচলা মৃণালের জন্য অপেক্ষা করিতেছিল; সে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, মৃণালদিদির জ্বরের মত হয়েছে, তিনি খাবেন না।

অচলা কোন কথা না কহিয়া মৃণালের ঘরে আসিয়া ঢুকিল। মৃণাল চোখ বুজিয়া বিছানায় শুইয়া ছিল, অচলা কহিল, খাবে চল মৃণালদিদি।

মৃণাল চাহিয়া দেখিয়া, একটুখানি হাসিয়া বলিল, তুমি খাও গে ভাই সেজদি, আমার শরীর ভাল নেই।

অচলা শুষ্কস্বরে প্রশ্ন করিল, কি হয়েছে? জ্বর?

মৃণাল কহিল, তাই মনে হচ্চে। আজ উপোস করলেই সেরে যাবে।

অচলা হেঁট হইয়া হাত দিয়া মৃণালের কপালের উত্তাপ অনুভব করিয়া বলিল, আমি অত বোকা নই মৃণালদিদি, খাবে চল।

মৃণাল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, মাইরি বলচি, সেজদি, আমার খাবার জো নেই। কেন তুমি আবার কষ্ট করে ডাকতে এলে ভাই! বরং চল, আমি না হয় গিয়ে তোমার সুমুখে বসচি।

অচলা কঠিন হইয়া কহিল, একজন অভুক্ত বন্ধুকে মুখের সামনে বসিয়ে রেখে খাবার শিক্ষা আমরা পাইনি মৃণালদিদি।

মৃণাল তথাপি হাসিবার প্রয়াস করিয়া বলিল, আর বন্ধুর যদি ভোজনের উপায় না থাকে তা হলে?

অচলা তেমনিভাবে জবাব দিল, নেই কেন আগে শুনি? তোমার জ্বর হয়নি, হয়েছে রাগ। নিজে না খেয়ে আমাকেও শুকোবে, এই যদি তোমার ইচ্ছে হয়ে থাকে ত স্পষ্ট করে বল, আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না।

মৃণাল তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া ঝোঁকের মাথায় বলিয়া ফেলিল, স্বামীর দিব্য করে বলচি সেজদি, আমি এতটুকু রাগ করিনি। কিন্তু আমার খাবার জো নেই। চল দিদি, আমি তোমাকে কোলে করে বসে খাওয়াই গে।

অচলা কহিল, তা হলে জ্বর-টর নয়? ওটা শুধু ছল।

মৃণাল চুপ করিয়া রহিল। অচলা নিজেও কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া আস্তে আস্তে বলিল, এতক্ষণে বুঝলুম। কিন্তু গোড়াতেই যদি মুখ ফুটে বলে দিতে মৃণালদিদি, আমার ছোঁয়া তুমি ঘৃণায় মুখে দিতে পারবে না, তা হলে এই অন্যায় জিদ করে তোমাকে কষ্ট দিতুম না, নিজেও দাসী-চাকরের সামনে লজ্জায় পড়তুম না। তা সে যাক—আমাকে মাপ করো ভাই, কিন্তু দুধ ত ছোঁয়া যায় না শুনেছি, তাই এক বাটি এনে দি—আর যদু গিয়ে দোকান থেকে কিছু সন্দেশ কিনে আনুক। কি বল?

প্রথমটা মৃণাল হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া রহিল; খানিক পরে সে ভাব কাটিয়া গেলেও সে কথা কহিল না, অধোমুখে নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল।

অচলা পুনরায় খোঁচা দিয়া কহিল, কি বল?

মৃণাল আঁচলে চোখ মুছিয়া মৃদুকণ্ঠে শুধু কহিল, এখন থাক।

অচলা আরও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

মৃণাল মুখও তুলিল না, কথাও কহিল না। বুড়া শাশুড়িকে তাহার রাঁধিয়া দিতে হয়; তিনি অতিশয় শুচিবাই-প্রকৃতির লোক; এ কথা শুনিলে কোনকালে যে তাহার জলস্পর্শ করিবেন না, নিদারুণ অভিমানে এ কথা সে আভাসেও অচলার কাছে প্রকাশ করিল না।

35 Shares