গৃহদাহ

একদিন সমাজের দোরগোড়ায় কেদারবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তিনি স্পষ্টই বলিলেন, কাজটা তাঁহার ভাল হয় নাই। মহিমের সহিত বিবাহ দিতে ত গোড়াগুড়িই তাঁহার ইচ্ছা ছিল না—শুধু সে নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল বলিয়াই তিনি অবশেষে মত দিলেন। ঘরে আসিয়া তাহার মনের মধ্যে অভিশাপের মত জাগিতে লাগিল, এই বিবাহ দ্বারা তাহাদের কেহই যেন সুখী না হয়। নিজের অবস্থাকে অতিক্রম করার অপরাধ বন্ধুও অনুভব করুন, অচলাও যেন নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হইয়া মরে। কিন্তু তাই বলিয়া মন তাহার ছোট নয়। এই অকল্যাণ কামনার জন্য নিজেকে সে অনেকরকম করিয়া শাসিত করিতে লাগিল। কিন্তু তাহার পীড়িত প্রতারিত হৃদয় কিছুতেই বশ মানিল না—নিতান্ত একগুঁয়ে ছেলের মত নিরন্তর ঐ কথাই আবৃত্তি করিতে লাগিল। এমনি করিয়া মাস-খানেক সে কোনমতে কাটাইয়া দিয়া একদিন কৌতূহল আর দমন করিতে না পারিয়া অবশেষে ব্যাগ হাতে মহিমের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল।

সুরেশ বন্ধুর মুখের পানে চাহিয়া কহিল, এখন দেখতে পাচ্চো মহিম, আমার কথাটা কতখানি সত্যি?

মহিম জিজ্ঞাসা করিল, কোন্‌ কথাটা?

সুরেশ বিজ্ঞের মত বলিল, আমার পল্লীগ্রামে বাস নয় বটে, কিন্তু এর সমস্তই আমি জানি। আমি তথাপি কি সাবধান করে দিইনি যে, গ্রামের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে একটা ঘোরতর বিরোধ বাধবে?

মহিম সহজভাবে কহিল, কৈ, তেমন বিরোধ ত কিছু হয়নি।

বিরোধ আর বল কাকে? তোমার বাড়িতে কেউ খেলে কি? সেইটেই কি যথেষ্ট অশান্তি অপমান নয়?

আমি খেতে কাউকে বলিনি।

বলনি? আচ্ছা, কৈ, বৌভাতে আমাকে ত নেমন্তন্ন করনি মহিম?

ওটা হয়নি বলেই করিনি।

সুরেশ বিস্মিত হইয়া বলিল, বৌভাত হয়নি? ওঃ—তোমাদের যে আবার—কিন্তু এমন করে ক’টা উপদ্রব এড়ানো যাবে মহিম? আপদ-বিপদ আছে, ছেলেমেয়ের কাজ-কর্ম আছে—সংসার করতে গেলে নেই কি? আমি বলি—

যদুর হাতে চায়ের সরঞ্জাম এবং নিজে থালায় করিয়া মিষ্টান্ন লইয়া অচলা প্রবেশ করিল। সুরেশের শেষ কথাটা তাহার কানে গিয়াছিল; কিন্তু তাহার মুখের ভাবে সুরেশ তাহা ধরিতে পারিল না। দুই বন্ধুর জলযোগ এবং চা-পান শেষ হইলে মহিম কাঁধের উপর চাদরটা ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। গ্রামের জমিদার মুসলমান, তাঁহার ছেলেটিকে মহিম ইংরাজি পড়াইত। জমিদারসাহেব নিজে লেখাপড়া না জানিলেও তাঁহার ঔদার্য ছিল, মহিমের সহিত সদ্ভাবও যথেষ্ট ছিল। এইজন্য গ্রামের লোক সমাজের দোহাই দিয়া আজও তাহার উপর উপদ্রব করিতে সাহস করে নাই।

অচলা কহিল, আজ পড়াতে না গেলেই কি হতো না?

মহিম কহিল, কেন?

অচলার মনের জোর ও অন্তরের নির্মলতা যত বড়ই হোক, সুরেশের সহিত তাহার সম্বন্ধটা যেরূপ দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাতে তাহার আকস্মিক অভ্যাগমে কোন রমণীই সঙ্কোচ অনুভব না করিয়া থাকিতে পারে না। সুরেশকে সে ভাল করিয়াই চিনিত, তাহার হৃদয় যত মহৎই হোক, সে হৃদয়ের ঝোঁকের উপর তাহার কোন আস্থা ছিল না—এমন কি, ভয়ই করিত। এই সন্ধ্যায় তাহারই সহিত তাহাকে একাকী ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাবে সে মনে মনে উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল; কিন্তু বাহিরে তাহার লেশমাত্র প্রকাশ না করিয়া হাসিয়া কহিল, বাঃ, সে কি হয়? অতিথিকে একলা ফেলে—

মহিম কহিল, তাতে অতিথি সৎকারের কোন ত্রুটি হবে না। তা ছাড়া তুমি ত রইলে—

অচলা ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, কিন্তু আমিও থাকতে পারব না। সুরেশের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমাদের উড়ে বামুনটি এমনি পাকা রাঁধুনী যে, তার সঙ্গে না থাকলে কিছুই মুখে দেবার জো থাকবে না। আমি বলি, তুমি বরঞ্চ—

মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, তা হয় না। ঘণ্টা-দুই বৈ ত নয়। বলিয়া ঘরের কোণ হইতে সে লাঠিটা তুলিয়া লইল। একে ত মহিমের কাজের ধারা সহজে বিপর্যস্ত হয় না, তাহাতে এই একটা সামান্য কারণ লইয়া বারংবার নির্বন্ধ প্রকাশ করিতেও অচলার লজ্জা করিতে লাগিল, পাছে ভয়টা তাহার সুরেশের চোখে ধরা পড়িয়া লজ্জাটা শতগুণ হইয়া উঠে।

মহিম ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। তাহাকে শুনাইয়া সুরেশ অচলাকে হাসিয়া কহিল, কেন নিজের মুখ হেঁট করা! চিরকাল জানি, ও সে পাত্রই নয় যে, কারও কথা রাখবে।

তুমি বরং যা হোক একখানা বই আমাকে দিয়ে নিজের কাজে যাও—আমার দিব্যি সময় কেটে যাবে।

কথাটা হঠাৎ অচলাকে বাজিল যে, বাস্তবিকই মহিম কোনদিন কোন অনুরোধই তাহার রক্ষা করে না। হউক না ইহা তাহার সুমহৎ গুণ, কিন্তু তবুও সুরেশের মুখ হইতে স্বামীর এই আজন্ম কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় তাহারই সম্মুখে আজ তাহাকে অপমানকর উপেক্ষার আকারে বিঁধিল। কোন কথা না কহিয়া, সে নিজের ঘরে গিয়া, যদুকে দিয়া একখানা বাংলা বই পাঠাইয়া দিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।

অনেক রাত্রে শয়ন করিতে গিয়া মহিম জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশ কতদিন এখানে থাকবে তোমাকে বললে?

এমনি ত নানা কারণে আজ সারাদিনই স্বামীর উপর তাহার মন প্রসন্ন ছিল না; তাহাতে এই প্রশ্নের মধ্যে একটা কুৎসিত বিদ্রূপ নিহিত আছে কল্পনা করিয়া সে চক্ষের নিমেষে জ্বলিয়া উঠিল; কঠোর কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তার মানে?

মহিম অবাক হইয়া গেল। সে সোজাভাবেই কথাটা জানিতে চাহিয়াছিল, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কিছুই করে নাই। তাহাদের এতক্ষণের আলাপের মধ্যে এ প্রশ্নটা সে বন্ধুকে সঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই এবং সুরেশ নিজে হইতে তাহা বলে নাই। কিন্তু তাহার আশা ছিল, সুরেশ নিশ্চয়ই অচলাকে তাহা বলিয়াছে।

মহিমকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া অচলা নিজেই বলিল, এ কথার মানে এত সোজা যে, তোমাকে জিজ্ঞাসা করবারও দরকার নেই। তোমার বিশ্বাস যে, সুরেশবাবু কোন সঙ্কল্প নিয়েই এখনে এসেছেন, এবং তা সফল হতে কত দেরি হবে সে আমি জানি। এই ত?

মহিম আরও ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে বলিল, আমার ও-রকম কোন বিশ্বাস নেই। কিন্তু মৃণালের ব্যবহারে আজ তোমার মন ভাল নেই, তুমি কিছুই ধীরভাবে বুঝতে পারবে না। আজ শোও, কাল সে কথা হবে। বলিয়া নিজেই বিছানায় শুইয়া পাশ ফিরিয়া নিদ্রার উদ্যোগ করিল।

35 Shares